রাজধানীতে যতগুলো খাল, ঝিল, জলাশয়, লেক ও নিচু জমি রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অথচ এই জলাধারগুলো হতে পারতো রাজধানীর সৌন্দর্যের প্রতীক। জলাশয়গুলেঅকে সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছ পানিপ্রবাহ এবং আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করা সম্ভব ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এমন আশা করা শুধু দুরাশাই নয়, অসম্ভবও বটে। অসম্ভব এ কারণে যে, এসব জলাধারের দায়িত্বে যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, এ নিয়ে তাদের যেমন কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি মাথাব্যথাও নেই। ফলে এগুলো পরিত্যক্ত এবং ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা, পরিবেশ দূষণ এবং মশার উপদ্রবের মূল কারণ হয়ে রয়েছে। নগরবাসীর জীবন যে মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, তার কারণ এসব ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে একশ্রেণীর দখলদার ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে, ধীরে ধীরে দখলও করে নিচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব জলাশয় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য প্রতি বছর মোটা অংকের বাজেট বরাদ্দ করা হলেও তা কাজে লাগানো হয় না। তাহলে এ বাজেট কেন করা হয় এবং বাজেটের অর্থ কোথায় যায়? নগরবাসীর ট্যাক্স দেবে অথচ সেবা পাবে না, এমন অনিয়ম কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।
ঢাকা নগরীর সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি কী তা নতুন করে বলার কিছু নেই। অনেক আগেই ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকোনোমিস্ট-এর ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর জরিপে বিশ্বের শীর্ষ বসবাসের অনুপযোগী, অসভ্য নগরী হিসেবে ঢাকা চিহ্নিত হয়েছে। বায়ু দূষণে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণেও প্রথম সারিতে রয়েছে। এসব সমস্যার সম্মিলিত ফল হিসেবে বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরের তালিকায় ঢাকা ঠাঁই পেয়েছে। ঢাকার অবস্থা কতটা শোচনীয় তা বুঝতে বিদেশি সংস্থার জরিপের প্রয়োজন পড়ে না। রাজধানীবাসী প্রতি মুহূর্তেই এর বাস্তব শিকার হচ্ছে। বায়ু দূষণের কথা যদি ধরা হয় তবে এর মধ্যে যেসব বিষাক্ত উপকরণ রয়েছে, সেগুলো যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, তা ইতোমধ্যে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড, মনোঅক্সাইড, শিষা থেকে শুরু করে মারাত্মক সব উপকরণ ঢাকার বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এসবের কারণে নগরবাসী শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, কিডনী রোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সারে পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। বাতাসে এই বিষ ছড়াচ্ছে, যানবাহনের কালো ধোয়া, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য এবং অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে সৃষ্ট ধুলোবালি। অন্যদিকে শব্দ দূষণ এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, অনেক মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত শব্দের সহনীয় মাত্রা ৩৫ ডেসিবল। স্থানভেদে এর হেরফের হয়। অথচ রাজধানীর প্রায় সর্বত্র এই মাত্রা ৬০ ডেসিবলের মতো। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে অনেক সময় মায়ের গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তা গত বছর নগরবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। আগামী বর্ষা মৌসুমেও এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। রাজধানীবাসীর চিরায়ত দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তারা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সেবা প্রদানের জন্য নির্ধারিত ট্যাক্স দিলেও তার ন্যূনতম সেবা পায় না। পানির বিল দ্বিগুণ দিয়ে পানযোগ্য পানি পাচ্ছে না, গ্যাসের বিলও দ্বিগুণ দিয়ে গ্যাস পাচ্ছে না, অতিরিক্ত বিদ্যুত বিল দিয়েও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেন পণ করেই বসেছে, সেবা পাক বা না পাক তাদের নির্ধারিত ট্যাক্স ও বিল দিতেই হবে। বিশ্বের কোনো রাজধানীতে এমন স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম রয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।
রাজধানী হচ্ছে, একটি দেশের সভ্যতা ও উন্নতির প্রতীক। একে বাড়ির ড্রইং রুম বা বৈঠকখানার সাথে তুলনা করা হয়। যে কোনো পরিবার বাড়ির বৈঠকখানাটি সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখে। এমনকি দরিদ্র একটি পরিবারও তার বাড়ির বৈঠকখানাটি সাধ্যমতো পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে সুন্দর করে সাজাতে চেষ্টার ত্রæটি করে না। বৈঠকখানার সৌন্দর্যের মধ্যেই একটি পরিবারের রুচি ও সভ্যতার প্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে একটি দেশের রাজধানী হচ্ছে, সে দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পীঠস্থান। এর চেহারার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকভাবে দেশের প্রকৃত চিত্র ও মর্যাদার প্রকাশ ঘটে। ঢাকার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সার্টিফিকেট লাভ করেছে। বেশ ঘটা করেই উন্নয়নশীল দেশের সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সরকারিভাবে উদযাপন করা হয়েছে। এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একবাক্যে এবং বিনা দ্বিধায় এ স্বীকৃতি লাভ সবাই স্বীকার করছে না। কারণ মানুষের বাস্তব জীবনমানের উন্নয়ন আর সূচকের উন্নয়নের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। মাথাপিছু আয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্বের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। অন্তত রাজধানীর সার্বিক চিত্র দেখলে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অথচ সবার আগে রাজধানীর সার্বিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর সৌন্দর্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরী ছিল। এদিকে সরকারের দৃষ্টি আছে বলা মনে হয় না। বলা যায়, অপরিচ্ছন্ন ও অসভ্য একটি নগরীতে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে রাজধানীকে আগে বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও সৌন্দর্যময় করে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এবং সরকার এদিকে যথাযথ দৃষ্টি দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। এটাও বলা জরুরী, রাজধানীকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য করে তুলতে নাগরিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন