প্রায় ৫ লাখ লোকের বসবাস ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়, সরকারি নীতিমালার কোন রকম তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের ছত্র ছায়ায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অনুমোদন বিহীন প্রায় অর্ধশত ইটভাটা। এসব অনুমোদনবিহীন বেশির ভাগ ইটভাটাগুলো ফসলি জমির ওপর আবার কোন কোনটা সরকারি বনাঞ্চলে।
ভাটাগুলোর ইট তৈরীতে প্রয়োজন হচ্ছে প্রধান কাঁচামাল মাটি আর জীবাশ্ম জ্বালানী হিসেবে অহরহ পোড়ানো হচ্ছে অনুন্নত মানের কয়লা এবং পার্শবর্তী বনাঞ্চলসহ আশেপাশের এলাকা থেকে নির্বিচারে গাছপালা কেটে আনা লাকড়ি। স্থানীয় ক্ষুদ্র মাঝারি কাঠ ব্যবসায়ীরা লাকড়ির যোগান দিয়ে থাকে বিভিন্ন ভাটাগুলোতে।
ইট ভাটাগুলোতে জ্বালানীর জন্য প্রতিদিন ব্যাবহত হচ্ছে হাজার হাজার মন লাকড়ি। এই সব জীবাশ্ম জ্বালানীর ফলে প্রতিনিয়ত চুল্লি থেকে নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত কার্বন মিশ্রিত কালো ধোঁয়া যা দ্রুত বাতাসে ছড়িয়ে পরে। পরিবেশ দূষনের সংগে সংগে ব্যাপক ক্ষতি করছে কৃষকদের বিভিন্ন ফসলের আবাদী জমি। যার ফলশ্রুতীতে আগের তুলনায় কমতে শুরু করেছে ফসলের উৎপাদন। এত কিছুর পরও চোখে পরছে না সংশ্লিষ্ঠ প্রশাসনের।
আগামি ১০/১৫ বছর এরূপ চলতে থাকলে কৃষির আবাদি জমিগুলো ফসল নষ্ট সহ অনাবাদী হয়ে পড়ে উৎপাদন কমে যেতে পারে বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে কৃষি অফিসার ড.নাসরিন আক্তার বানু বলেন, ফসলি জমি থেকে ভাটার মালিকরা টপ সয়েল নিচ্ছে, এতে করে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই এলাকার ফসল উৎপাদন কমতে থাকবে। আবাদী জমি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন ইট ভাটা স্থাপনের নিয়ম নেই। আমার সময় আমি কোন নতুন ইট ভাটা স্থাপনের ছাড়পত্র দেই নি কিন্তু ফুলবাড়িয়া উপজেলার অধিকাংশ ভাটা অবৈধ্য ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহি অফিসার লীরা তরফদার বলেন, এবিষয়ে আমি অবগত আছি, অবৈধ ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরেজমিনে উপজেলার বালুঘাট, কেশরগঞ্জ বাজার, নাওগাও, রাধাকানাই, রঘুনাথপুর, ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকা, দেওখলা, লক্ষিপুর, আছিম, কালাইপাড়, বাশদিল, পুটিজানা, সুযাইতপুর, ভবানীপুর, জোরবাড়িয়া, এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০টির অধিক নামে বেনামে লাইসেন্স বিহীন অবৈধ্য ভাবে গড়ে উঠেছে ইট ভাটা। যেখানে কোন প্রকার সরকারের নিয়ম নীতি না মেনে অহরহ পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানী লাকড়ি। উপজেলার কেশরগঞ্জ বাজার, আছিম বাজর, এনায়েতপুর এলাকায় ভাটায় সরজমিনে গিয়ে রীতিমত আতকে উঠতে হয়। প্রথমেই চোখে পড়ে জমিয়ে রাখা কাঠের টুকরো আর লাকড়ির ¯ু‘প। শ্রমিকরা মুঠোয় মুঠোয় চুল্লিতে নিক্ষেপ করছে লাকড়ি আর চুিল্লর মুখ দিয়ে নির্গমন হচ্ছে কার্বন মিশ্রীত বিষাক্ত কালো ধোয়া। সন্তোষপুর বনাঞ্চলের মধ্যে বালুঘাট বাজার এলাকায় গড়ে ওঠা একটি ইট ভাটা এতে বনাঞ্চলসহ বন্য প্রানীর ব্যাপক ক্ষতি করছে।
অথচ “পরিবেশ সংরক্ষনের আইনে” জ্বালানী কাঠের নিষিদ্ধ সম্পর্কে উল্লেখ আছে, আপাতত বলবৎ অইনে, কোন আইনে যাহাই কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যাক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানী জন্য কোন জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
এছাড়াও কতপিয় স্থানে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ করন নিয়ন্ত্রনে বলা হয়, কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যাক্তি মালিকানাধীন অভয়ারন্য বাগান বা জলাভূমি, কৃষি জমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, ধান সহ আশেপাশের মৌসুমী ফসল যেমন, বিভিন্ন শাক-সবজীর ক্ষেতে দেখা দিচ্ছে নানান রোগ, শিম গাছের ফুল ঝরে পরে যাচ্ছে- সময় পেড়িয়ে গেলেও ধরছে না ফলন, পাতার গায়ে দেখা যাচ্ছে কালচে প্রলেপ। দীর্ঘদিন ধরে সবজী চাষ করে আসা স্থানীয় সবজী চাষী জামিল (৫০) বলেন, যখন আগে আমাদের এলাকায় এই সব ইটভাটা গুলো ছিলো না তখন আমাদের ক্ষেতে প্রচুর ধান ও সবজী উৎপাদন হতো, কিন্তু পরে আস্তে আস্তে আমাদের ক্ষেতের ফলন কমতে শুরু করে, এখন আমাদের সবজী গাছের ফুল-ফল দুটোই অংকুড়েই ঝড়ে পরে যায়, আজকাল আবাদ করে আর পোষায় না।
উপজেলার আছিম তিতারচালা এলাকার ইট প্রস্তুত কারী প্িরতষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী জানান, তাদের একটি ভাটায় মৌসুমে প্রায় ৪৫ লাখ ইট পোড়ানো হয়, যার জন্য জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কমপক্ষে ৯০হাজার মন লাকড়ি। হিসেব করে দেখা যায় শুধু একটি ভাটার জন্যই কম করে হলেও মৌসুমে প্রাপ্ত বয়স্ক ২৫ হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। খোজ নিয়ে চোখে পড়ে উপজেলার প্রতিটা ইট ভাটাগুলোর একী রকম চিত্র।
“বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়” ময়মনসিংহ’র পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রাধান অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের দেশে আইন ভাঙার একটি সংস্কৃতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে, তাই বেশির ভাগ ইট ভাটাই পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন আইন না মেনেই যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে। ফলে ভাটার চুল্লিতে যখন কিছু পোড়ানো হয় তখন সেখান খেকে থেকে শুধু কার্বনডাই অক্সাইডই নয় অনেক ধরনের ক্ষতিকর উপাদান বেড় হয়, সে গুলো ডাস্টের আকারে ফসলের উপরে গিয়ে পড়ে, ফলে সেই গাছটির উপরে যখন প্রলেপ পড়ে তখন সেই গাছের ফটো সেনসেসিক প্রসেস (সালোকসংশ্লেষন প্রক্রিয়া) বাধাগ্রস্থ হয়। কেননা পানি, কার্বন, আলো এই তিনটি উপাদান মাটি থেকে গাছের পুষ্টি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। তাই সবার আগে কৃষকদের সচেতন হবার পরামর্শ দেবার পাশাপাশি অতি দ্রুত, যত্রতত্র গড়ে ওঠা অবৈধ্য ইটভাটা বন্ধ করা সহ এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহনের পরামর্শ দেন এই পরিবেশবিদ।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক ইনকিলাবকে বলেন, ফুলবাড়িয়া উপজেলায় দুই একটা ব্যতীত আর কোন ইটভাটার লাইসেন্স নবায়ন নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন