নারীরা দেশে কৃষি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন। সবজি, হাঁস-মুরগী গরুর খামার করে নিজেদের দারিদ্রতা দূর করে শুধু সাবলম্বী হননি, সন্তানদের প্রতি পালন সংসারের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ এবং অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করছেন তারা। নারীদের এই কাজে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ‘উত্তরের জনপদের মত এই রকম সমতল ভূমি দেশের আর কোন অঞ্চলে নেই।’ আজ থেকে কয়েক বছর আগে এই জনপদে ইনকিলাবের প্রতিনিধি সম্মেলনে এসে বলে ছিলেন, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন। সত্যি কথা। তিনি সময় পেলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুঁটে বেড়ান। দেখেন নিবিড়ভাবে। তাঁর পর্যবেক্ষণের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে অভিভূত করেছে। সে দিন রাজশাহীতে প্রতিনিধি সম্মেলনে তাঁর এই কথা আমার মাথায় প্রোথিত হয়ে যায়। এই সংক্রান্ত কোন খবরে সুযোগ পেলেই সম্মানিত সম্পাদক মহোদয়ের ঐ কথাটি ‘আমি’ লেখার মধ্যে নিয়ে আসি।’ উত্তর জনপদের এই সমতল ভূমির মধ্যে পাবনা জেলা একটি। এই জেলার অন্যান্য উপজেলার চেয়ে ঈশ্বরদী উপজেলার নারী-পুরুষ বহুদিন আগেই কৃষি ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, বখতারপুর, মুলাডুলি প্রভৃতি। এইসব এলাকা ফল-ফলাদি, শাক-সবজি, (লাউ, সিম, চাল কুমড়া) আবাদ করে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। মৎস্য ও গরুর খামারে আটঘরিয়া, সুজানগর, সাঁথিয়া, বেড়া একাংশ, ফরিদপুর উপজেলা অনেক এগিয়ে গেছে। ঈশ্বরদীর বথতিয়ারপুর গ্রামে কৃষি ক্ষেত্রে একজন সফল নারী নূরন্নাহার। তিনি ১৯৯১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি শ্বশুর বাড়ির পেছনে সামান্য জায়গায় বসবাস করতেন। তার স্বামীর কোন কর্ম ছিল না। উচ্চ শিক্ষা এবং হাতে টাকা ছাড়া ভবিষৎ গড়ে তোলা এবং ভাগ্যেও পরির্বতন করা সম্ভব নয়। এই ভাবনায় দুখ-কষ্টে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছেন। তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ে সামান্য জায়গার কিছু অংশে সবজি আবাদ শুরু করেন। বাঁচতে হলে সৎপথে লড়তে হবে। শুরু হলো নূরন্নাহারের জীবন-সংগ্রাম করে বাঁচার লড়াই। তিনি কুমড়া, সবজি আবাদ করে বিক্রি করতে শুরু করলেন। তাঁর শয়ন ঘরের চারপাশের যতটুকু জমি খালি পড়ে ছিল, এরসবই আবাদের আওতায় আনলেন। এর জন্য টাকা দুই হাজার টাকা কর্জ নিতে হয়েছিল। উৎপাদিত কৃষি পন্য বিক্রি করে সেই কর্জ শোধ করে দিলেন। সংসারের খরচ-খরচা বাদে সামান্য অর্থ হাতে জমা হয়। নূরন্নাহার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিজের স্বপ্ন-লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এরপর কুমড়া চাষের পাশাপাশি বেগুণ আবাদ শুরু করলেন। বেগুনে বেশী লাভ হলো। তিনি প্রশিক্ষণের জন্য বলায় তাকে শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করতে হয়। তিনি তাঁর স্বামীর চাচার বাড়ির পাশে একটি নতুন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হলেন। এতে থেমে যাননি তিনি। চাচা আবাদ করার জন্য তাঁকে ছয় বিঘা জমি দেন। এই জমিতেই ভাগ্য ফেরে নূরন্নাহারের। তিনি এই জমিতে সবজি ছাড়াও ভূট্টা আবাদ করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চাচা শ্বশুরের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, তৎকালীন জেলা প্রশাসক, স্থানীয় প্রশাসকবৃন্দ এগিয়ে আসেন। কৃষি ক্ষেত্রে তাঁকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন তারা। কৃষি বিভাগের লোকজন কাঁচা সবজির রোগ-বালাই দূর করতে মাঝে মধ্যেই তাঁর কৃষি ক্ষেত্রে আসতেন এবং পরামর্শ দিতেন। নূরন্নাহার এখন ৪০ একর জমির মালিক।
ব্যাংক ঋণের সাহায্যে ধীরে ধীরে কৃষি ক্ষেত্রে একজন সফল নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে ১৩০ বিঘা জমিতে কৃষি খামার করেছে। এর মধ্যে ২৮ বিঘার মালিক তিনি নিজে। দশ বিঘা পরিমান জমিতে পুকুর, একটি কলার বাগান, গরুর দুগ্ধ খামার রয়েছে। নূরন্নাহার প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা আয় করেন। জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে তিনি সফল। আর্থিক কষ্টের দিন দূরে চলে গেছে। পাবনা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক বিভূতি ভূষণ সরকার নূরন্নাহারে বিষয়ে জানান “তিনি একজন দক্ষ নারী কৃষক এবং কৃষি ক্ষেত্রে আইডল। নূরন্নাহার কৃষি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ড মেডেল পুরষ্কারে ভূষিত হন।
নূরন্নাহার গ্রামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাঁর এই হাসপাতালে গ্রামের দরিদ্র মানুষ অল্প খরচে চিকিৎসা সেবা পাবে জানিয়েছেন। নূরন্নাহার চারপুত্র সন্তানের জননী। তাঁর একপুত্র রায়হান কবির হিরোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একজন কলেজ আর দুইজন স্কুলে পড়াশোনা করছে। নূরন্নাহার বিশ্বাস করেন, শুধু একাডেমিত সার্টিফিকেট বড় কথা নয়, বাস্তব জ্ঞানই বড়। তিনি লেখা তেমন করেননি। কৃষি ক্ষেত্রে বাস্তব জ্ঞানে প্রশিক্ষত হয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন