এই নিবন্ধে, মানব জাতির চরম ও পরম আদর্শ, মহান আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী, নিখিল বিশ্বের অনন্ত কল্যাণ ও মৃর্ত আশীর্বাদ, পবিত্র কুরআন এর ধারক ও বাহক, বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লীল আলামীন, খাতামুন নাবীয়্যিন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম মি’রাজের রজনিতে মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে মোলাকাত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা কালে ঊর্ধ্ব জগতে যে সকল নবী গণের সাথে সাক্ষাত ও তার রহস্য উদঘটিত হয়েছিল সে সম্পর্কে সামান্ন কিছু উপস্থাপনা করব, ইনশাআল্লাহ।
মি’রাজ অর্থ, তারিখ ও সময় ঃ মি’রাজ শব্দটি আরবি। অর্থ উর্ধ্বে উঠার সিঁড়ি বা বাহন। ইসলামি পরিভাষায়, বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পবিত্র হায়াতে তাইয়্যেবার ৫১ বছর ৯ মাস বয়সে ৬২১ ইসায়ী সনের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৯ শত ৯৯ জন নবীর ইমাম হয়ে , ইমামুল মুরছালিন হয়ে, প্রথম আকাশ, দ্বিতীয় আকাশ, তৃতীয় আকাশ, চতুর্থ আকাশ, পঞ্চম আকাশ, ষষ্ট আকাশ, সপ্তম আকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা, লা-মাকান, লা-কামান এরপর ৭০ হাজার নূরের পর্দা বেধ করে আরশে আজীমে মহান আল্লাহ তা’আলার স্বাক্ষাতে হাজির হওয়ার ঐতিহাসিক অসাধারণ ঘটনাকে মি’রাজ বলা হয়। এ মি’রাজের রজনীটিকে লাইলাতুল মি’রাজ বা শব-ই-মি’রাজ বলা হয়।
নবী গণের সাথে সাক্ষাত ও তার রহস্য ঃ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বোরাকে আরোহন কালে অল্প সময়ের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে একে একে সাত আসমান ভ্রমণ করে সিদরাতুল মুনতাহা পৌছেন। সেখান থেকে বিভিন্ন মঞ্জিল অতিক্রম করে আরশে আযীমে পৌঁছেন। সপ্ত আসমান ভ্রমন কালে প্রত্যেক আসমানে এক বা একাধিক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পয়গাম্বরের সাথে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় এবং কথোপকথন হয়। এ সাক্ষাতের পিছনে অনেক হিকমত নিহিত রয়েছে। নিম্নে ধারবাহিক ভাবে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
এক. প্রথম আসমানে হযরত আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাতের রহস্য হলো, হযরত আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম সর্ব প্রথম পিতা ও সর্ব প্রথম নবী। তাই সর্ব প্রথম সাক্ষাত তার সাথে হয়েছিল। এ সাক্ষাতের আর একটি রহস্য হল এ সাক্ষাতে হিযরতের দিকে ইশারা রয়েছে। অর্থাৎ যেমনি ভাবে হযরত আদম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম তার শত্রæ ইবলিশ এর কারণে জান্নাত থেকে হিযরত করে জমিনে এসেছেন। তেমনি ভাবে দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম দুশনদের অত্যাচারে মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনায় যাবেন।
দুই. দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। সাক্ষাতের রহস্য হলো- (১) হাদীসে আছে রাসূল আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এরশাদ ফরমান, আমি সমস্ত নবীদের মধ্যে ঈসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর অতি নিকট বর্তী। কারণ, আমার আর তার মধ্যে কোন নবীর ব্যবধান নেই। তার পরেই আমি নবী। (২) হযরত ইসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম শেষ যামানার দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য আসমান থেকে অবতরণ করবেন। তিনি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর একজন অস্থায়ী উম্মত গণ্য হয়ে সংস্কারক হিসেবে তাঁর শরীয়ত বাস্তবায়ন করবেন। (৩) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম হলেন বনি ইসরাঈলদের শেষ নবী।
তিন. তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাতের রহস্য হলো। (১) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর উম্মতগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তারা হযরত ইউসুফ আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর আকৃতি ধারন করবে। (২) পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেমনি ভাবে ইউসুফ আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম কে তার ভাইয়েরা কষ্ট দিয়েছে, আর আল্লাহ তা’য়ালা তাকে রক্ষা করেছেন। এত কিছুর পরেও অবশেষে ইউসুফ আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তেমনি ভাবে আপনাকেও (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে) কুরাইশরা কষ্ট দিবে। আল্লাহ তা’আলা হেফাযত করবেন। অবশেষে আপনিও ইউসুফ আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর ন্যায় তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। বাস্তবে তাই ঘটেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন কুরাইশদেরকে লক্ষ্য করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন- আজ তোমাদের উপর কোন তিরস্কার নেই। আল্লাহ পাক তোমাদেরকে ক্ষমা করুন, তিনিই বড় দয়ালু। যাও, তোমরা মুক্ত।
চার. চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হলো। এ সাক্ষাতের রহস্য হলো। (১) যেমনি ভাবে ইদ্রিস আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম কে আল্লাহ তায়ালা উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত করেছেন, তেমনিভাবে আপনাকেও উচ্চ সম্মান ও মার্যাদায় সম্মানিত করবেন। (২) হযরত ইদ্রিস আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম ও বিভিন্ন দেশের বাদশাহদের কাছে ইমানের দাওয়াত মূলক চিঠি পত্র দিবেন। এটা বাস্তব হয় ষষ্ট হিযরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর।
পাঁচ. পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাত এর রহস্য হলো- যেমনি ভাবে বনী ইসরাইলরা হযরত হারুন আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর কথা অমান্য করার কারণে তাদেরকে নিহত হতে হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে কুরাইশরা আপনার কথা মানবে না। আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবেনা। যে কারণে তাদেরকে হত্যা করা হবে ও শাস্তি দেয়া হবে। উল্লেখ্য বদর যুদ্ধে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এ যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জনকে হত্যা করা হয়েছে ও ৭০ জনকে বন্দি করা হয়েছে।
ছয়. ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাতের রহস্য হলো, যেমনি ভাবে মুসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম ‘জাব্বারীন’ তথা শক্তিমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সিরিয়া গিয়েছিলেন। অনুরূপ ভাবে আপনিও জিহাদের উদ্দেশ্যে সিরিয়া প্রবেশ করবেন। এটা বাস্তবায়ন হয় তাবুকের যুদ্ধের মাধ্যমে, কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এ যুদ্ধের সময় সিরিয়া প্রবেশ করেছিলেন।
উল্লেখ্য, মুসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর পরে ইসা আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর হাতে সিরিয়া বিজয় হয়েছিল। তদ্রæপ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ইন্তেকালের পরে হযরত ওমর রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু এর হাতে সিরিয়া পূর্নভাবে মুসলমানদের দখলে আসে।
সাত. সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত হয়। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম বাইতুল মামুর এর সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। বায়তুল মামুর সপ্তম আকাশে অবস্থিত একটি মসজিদ যা ফিরিশতাদের কাবা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রত্যহ ৭০ হাজার ফিরিশতা ঐ ঘরে হজ্জ এবং তাওয়াফ করেন। কেয়ামত পর্যন্ত যাদের কখন হজ্জ ও তাওয়াফ করার সুযোগ হবে না। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম খানায়ে কা’বার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যে কারণে ফিরিশতাদের কা’বার সাথে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম কে বসিয়ে রেখে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেন।
এ শেষ সাক্ষাতের বিদায় হজ্জের দিকে ইশারা করা হয়েছে।
অর্থাৎ, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইন্তেকালের পূর্বে হজ্জ করবেন। এখানে একটা কথা স্মরণ যোগ্য, স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারী আলেমগণ বলেন, হযরত ইব্রাহিম আলাইহি-সসালাওয়াতু ওয়াসসাল্লাম কে স্বপ্নে দেখার মধ্যে হজ্জের সু-সংবাদ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন