সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজনীতিতে ছোট দল

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০ বা তার একটা-দুইটা কম। কেন নিবন্ধন নিতে হবে (বা নিতে হবে না) এর বর্ণনা এখন দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। আজ থেকে গত চার-পাঁচ মাস আগে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনরায় আহŸান জানিয়েছে, যে সকল রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হতে চায়, তারা যেন আবেদন করে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক, বহু দল আবেদন করেছে এবং প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেকই, শর্ত পূরণের অভাবে বহু দলই আপাতদৃষ্টিতে নিবন্ধন পাওয়ার অযোগ্য বলে স্থির হচ্ছে। যাহোক, চূড়ান্ত ফলাফল এখনও জানা যায়নি। মাস চারেক আগে, পরিচিত পরিমÐলের একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের একজন শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আবেদন করিনি এবং করবোও না। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন করবেন না ভাই? তিনি বললেন, এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে, এত পরিশ্রম করে নিবন্ধন গ্রহণ করে আমি এমন কোনো এক্সট্রা বেনিফিট বা সম্মান বা সুবিধা পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না; আপনি বা আপনাদের কল্যাণ পার্টির মতো নিবন্ধিত দলগুলো তো পাচ্ছে না। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ততই সম্ভাবনা আছে যে, সব দলই ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ দর্শন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, নিশ্চিতভাবে না; আমরা জোটবদ্ধই ইনশাআল্লাহ থাকবো এবং জোট আমাদেরকে সম্মান করবেই। যাহোক, সেই অনিবন্ধিত সুপরিচিত রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে আলাপের কথা আবার বলি। ওই নেতা আরও বললেন, বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দল দুইটি ও মাঝারি রাজনৈতিক দল আরও চারটি হলেও বাংলাদেশে সুপরিচিত গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক জোট কিন্তু মাত্র দুইটা; সুপরিচিত মার্কা মাত্র দুইটা, বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত নেত্রী মাত্র দুইজন এবং মানুষ চেনেও তাদেরই। ওই নেতা বললেন, সুতরাং নিবন্ধনের ঝক্কি-ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। তিনি বললেন, পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময়, যদি আমার ভাগ্য খোলে, তাহলে আমি বড় শরীকের মার্কাতেই নির্বাচন করবো অথবা আমি স্বতন্ত্র দাঁড়াবো এবং বড় শরীককে বলবো দুর্বল বা ডামি প্রার্থী দিতে।
কয়েকমাস আগে যখন সতীর্থ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে গল্প করছিলাম, তখন কবি রজনীকান্ত সেন-এর লেখা ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামক কবিতাটির চরণগুলো মনে এসে গিয়েছিল। তখন তাঁকে এর সারমর্ম শুনিয়েছিলামও। আজকাল ডিজিটাল সিলেবাসে এনালগ যুগের বহু কবিতা পাঠ্যসূচি থেকে বহিষ্কৃত; অতএব আজকালকার শিশুরা এ ধরনের কবিতা খুব কমই পড়ে। আমি সেই বিখ্যাত ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামক কবিতার চরণগুলো উদ্বৃত করছি। বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই// কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;// আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে; তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।// বাবুই হাসিয়া কহে// সন্দেহ কি তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়; পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা; নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।
এই কলামের সম্মানিত পাঠকগণের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যকই আসলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং তার ঝক্কি-ঝামেলা সম্বন্ধে সচেতন। সেজন্যই কয়েকটা লাইনে এই প্রেক্ষাপটটা বর্ণনা করছি। ছোট দল হিসেবে প্রতীকী অর্থেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছি। কল্যাণ পার্টি একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল; নিবন্ধন নম্বর ০৩১ এবং নিবন্ধন পাওয়ার তারিখ ১৮ নভেম্বর ২০০৮, নিবন্ধিত নির্বাচনী মার্কা হাত ঘড়ি। নিবন্ধন পাওয়ার জন্য যে সকল শর্ত আমাদেরকে কষ্ট করে পূরণ করতে হয়েছিল সেই ২০০৮ সালে, তার মোটামুটি বর্ণনা এইরূপ। বাংলাদেশের যতগুলো জেলা আছে তার মধ্য থেকে যে কোনো ১০টি জেলায় এবং যতগুলো উপজেলা আছে তার মধ্য থেকে যে কোনো ৫০টি উপজেলায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির শাখা থাকতে হবে, কল্যাণ পার্টির অফিস থাকতে হবে এবং সেখানে রাজনীতিতে কল্যাণ পার্টি সক্রিয় থাকতে হবে। এখন থেকে কয়েক বছর আগে এই শর্ত রিভাইস করা হয়েছে তথা ১০টি জেলার জায়গায় ২১টি করা হয়েছে এবং ৫০টি উপজেলার জায়গায় ১০১টি করা হয়েছে। অতিরিক্ত শর্ত হলো, জাতীয় কার্যালয় থাকতে হবে। ২০০৮ সালে, নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিকে সংগঠিত করার নিমিত্তে, আমি সহকর্মীদেরকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং উপজেলায়, আট মাস ধরে প্রায় ৩১ হাজার কিলোমিটার সফর করেছিলাম। একান্তভাবেই হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা দলটি সংগঠিত করেছিলাম অন্য কারো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া। দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলাম ৯ মাস পরে, নিবন্ধন পেয়েছিলাম নভেম্বরের ১৮ তারিখ ২০০৮ সাল। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি সকল শর্ত কম-বেশি মান্য করেই, অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে নিবন্ধনকে টিকিয়ে রেখেছে গত দশ বছর। আমাদের চেয়ারম্যান কার্যালয় আলাদা, আমাদের আলাদা জাতীয় কার্যালয় আছে, এবং নিয়মিত কাউন্সিল মিটিং ইত্যাদি করেই যাচ্ছি। তবে আমি বা আমার মতো নবাগত রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য, যেই সকল শর্ত প্রযোজ্য ছিল ও আছে বা যেই সকল শর্তের কথা আমি এখনই বর্ণনা করলাম, সেগুলো সব নিবন্ধিত দলের জন্য প্রযোজ্য নয়; কিন্তু ওইগুলোর ব্যাখ্যা এখন আর দিলাম না। এরকম প্রেক্ষাপটেই, এই মুহূর্তে ২০১৮ সালের মে মাসে কম-বেশি ৪০টি নিবন্ধিত দল আছে। আমাদের ২০ দলীয় জোটে ৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। যেহেতু আমরা নেতা-কর্মী সকলেই মিলে নিবন্ধনটা টিকিয়ে রেখেছি, অতএব মনের মধ্যে একটা আগ্রহ থেকেই যায় যে, নিবন্ধনটা যেন সম্মানের সঙ্গেই টিকে থাকে এবং সেটা যেন মূল্যায়িত হয়। কল্যাণ পার্টির প্রচার ও প্রসার নিবন্ধনের শর্তের অতিরিক্ত এখনও অব্যাহত আছে। একটি অতি সা¤প্রতিক উদাহরণ দেই। ৩০ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি মঞ্জুর আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক হাফিজ শিবলু এবং প্রচার সম্পাদক ইমরান ইসলাম যৌথভাবে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহে লন্ডনে তাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়ার জন্য; তাদের আড়াইশ’র অধিক সদস্য উপস্থিত থাকবেন এবং আমি উপস্থিত থাকলে ভালো হয় এটা বললেন। উত্তরে আমি হ্যাঁ বা না কোনোটাই বলিনি, উৎসাহিত করেছি। কারণ রোজার মাসের মাঝামাঝি সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি কী থাকে সেটা এখনও বলতে পারছি না। এই অনুচ্ছেদ শেষ করতে চাই এই বলে যে, সারা বাংলাদেশে আমাদের দলের বা যে কোনো একটি ছোট দলের সক্রিয় উপস্থিতি থাকবে এটার আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, এটার কোনো বাস্তবসঙ্গত যুক্তিও নেই এবং এইরূপ সক্রিয় উপস্থিতি কার্যকর করাও একটি অসম্ভব ব্যাপার। অপ্রিয় অনুভূতি হলো, অনেকেই এ কথাটি বুঝতে চায় না।
উপরের অনুচ্ছেদে, নিবন্ধন পাওয়ার প্রেক্ষাপট বা শর্তাবলী বর্ণনা করলাম। এটা তো হলো আইন মোতাবেক নিবন্ধন। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের মানসপটে ও হৃদয়ে, ভালোবাসার নিবন্ধন পাওয়ার শর্ত অন্যরকম। জনগণ ওই রাজনৈতিক নেতাকে বা ওই রাজনৈতিক দলকে তাদের দিলের মধ্যে নিবন্ধিত করে রাখে, দিলের মধ্যে গেঁথে রাখে, যেই নেতা বা যেই দল, তাদের দুঃখের কথা বলে, তাদের মনের কথা বলে, তাদের অনুভূতির কথা বলে, তাদের জন্য আন্দোলন করে এবং যারা দেশকে ভালোবাসে। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে, মূল চাহিদার অতিরিক্ত, আরেকটু কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে; জোটের নেতা বা নেত্রীর এবং জোটের দলগুলোর এবং জোটের রাজনৈতিক সমর্থকগুলোর কথা বলতে হয়; এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং স্বাগতম। যেহেতু আমাদের মতো ছোট কিন্তু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সারা বাংলাদেশে উপস্থিতি নেই, তাহলে আমরা সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হবে কীভাবে? ব্যক্তিগতভাবে আমি বা আমার একটি সুবিধা আছে। পত্রিকায় কলাম লিখি ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে এবং টেলিভিশনের পর্দায় যাই ২০০২ সাল থেকে। ফলে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে যখন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থিত হলাম, ততদিনে আমার নাম এবং চেহারা জনগণের একটা অংশের কাছে সুপরিচিত ছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে, মিডিয়ার মাধ্যমে জনমানসে এখনও উপস্থিত আছি আমি এবং আমার দল। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখের জোটে যোগদানের দিন থেকে জোটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা প্রধান শরীকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি এবং প্রধান শরীকের সৌজন্যেই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি; তাঁদের প্রতি অবশ্যই ধন্যবাদ। আমাদের দল ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচী পালন করেছে; অন্যান্য শরীকের অনুষ্ঠানেও আমরা উপস্থিত থেকেছি এবং অংশগ্রহণ করেছি; মিডিয়া সবগুলোকে কাভারেজ দিয়েছে; অতএব মিডিয়াকেও ধন্যবাদ। এই নিয়মেই জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা রয়েই গিয়েছে। কিন্তু কোনোমতেই মিডিয়া-নির্ভর নই। কেন বললাম, আমাদের পরিচয় ও আমাদের সম্মান মিডিয়ানির্ভর নয়? তার উত্তর পরের অনুচ্ছেদে। যা বলছি সেটা শুধু বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্য প্রযোজ্য নয়, অন্যান্য নিবন্ধিত দলের জন্যও প্রযোজ্য।
শনিবার ২৮ এপ্রিল দুপুরবেলা ফোন আসলো নাগরিক টিভি নামক একটি নতুন টেলিভিশনের পক্ষ থেকে। সন্ধ্যা সাতটায় টকশো। গেলাম। ওই ফোনের আগে বা ওই টকশোতে উপস্থিত হওয়ার আগে, আমি এই টিভির নামও শুনিনি, অনুষ্ঠানও দেখিনি; এটা ওই টিভির ব্যর্থতা না হলেও আমার ব্যর্থতা তো অবশ্যই। আসলে একটু ব্যতিক্রর্মী আয়োজন ছিল; লিংকটা দিয়ে দিলাম: যঃঃঢ়ং://ুড়ঁঃঁ.নব/৯ুুধুখ৬৬৩াট টকশোতে দুইজন অংশগ্রহণকারী উভয়েই ২০ দলীয় জোটভুক্ত, আমি এবং বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মনি। আলোচনার বিষয় ছিল ২০ দলীয় জোটের রাজনীতি। টেলিভিশনের মতে, ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিতে নাকি ভজঘট লেগেছে; ছোট দলগুলো নাকি কোনো কর্মসূচীতে থাকে না, কিন্তু নির্বাচনে সংসদীয় আসন চায়। আমি দারুন প্রতিবাদ করলাম; মনিও প্রতিবাদ করলেন। শুরুতেই সম্মানিতা চৌকশ উপস্থাপিকা মন্তব্যমূলক প্রশ্ন করলেন আমাকে: ‘আপনারা তো সব নামসর্বস্ব দল; আপনাদেরকে জোটের কোনো কর্মকাÐে দেখা যায় না।’ আমি ভদ্রভাবে কঠোর প্রতিবাদ করলাম। তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনি কি দেশনেত্রী বেগম জিয়ার কারাগারে যাওয়ার পরেরদিন থেকে পরবর্তী দিন ও সপ্তাহগুলোতে বিএনপি কর্তৃক আয়োজিত কর্মসূচীতে আমাকে দেখেছেন? তিনি উত্তর দিলেন, না। আমি প্রশ্ন করলাম, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি কর্তৃক আয়োজিত, বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের অনুষ্ঠান বা চট্টগ্রামে প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান কি আপনি টিভিতে দেখেছেন? তিনি বললেন, না। তখন আমি মন্তব্যমূলক উত্তর দিলাম: আপনি দেখতে পারেননি কারণ আপনার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে; সব প্রোগ্রামই একজনের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় কিন্তু, আপনি না দেখলেও এটাই সত্য যে, আমরা অংশগ্রহণ করেছি। যেহেতু মিডিয়া তার ফোকাসটা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর উপরেই রাখে, তাই ছোট দলগুলোর মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া কষ্টকর। এবং মিডিয়া কাভারেজ না পেলে, আপনি যত আন্তরিক কর্মসূচীই পালন করেন না কেন, এটা দেশবাসীর নিকট অজ্ঞাত থাকবে এমনকি জ্যেষ্ঠ বা অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিকটও অজ্ঞাত থাকবে; এটাই বাস্তবতা।
পরিচিতি পেতে পরিশ্রম, সময় ও ধৈর্য লাগে, পরিচিতি পেতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লাগে; পরিচিতি পেতে সুপরিচিত বা মানানসই ব্যক্তি লাগে। একটি উদাহরণ দেই। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমানকে, কে বা কারা অপহরণ করেছিলেন ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে এবং ১১৩ দিন পর সেই উৎকণ্ঠিত ঘটনার অবসান হয়। ১১৩দিনের মধ্যে প্রায় ২০বার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বা বিভিন্ন রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে ও টেলিভিশনে, আমিনুরের নাম এবং পার্টির নাম এসেছে; বহুবার আমি নিজে বিভিন্ন টকশোতে তার নাম নিয়েছি, ঘটনা বর্ণনা করেছি, মুক্তি দাবি করেছি। ফলে সচেতন মানুষের মনে কল্যাণ পার্টির নাম দাগ কেটেছে। দ্বিতীয় উদাহরণ দেই। বিএনপির চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম জিয়ার দ্বিতীয় পুত্র আরাফাত রহমান কোকো যেদিন মারা যান, সেদিন গুলশানের বিএনপি কার্যালয়ের উঠান থেকে, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। যেইদিন দাফন হবেন, সেদিনও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান, গুলশান অফিসের দেওয়ালের বাইরে প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে প্রেস ব্রিফিং করেছিলেন। উভয় দিনের বক্তব্য বা ব্রিফিং, অনেকগুলো চ্যানেল লাইভ দেখিয়েছে, অন্যরা রিপোর্ট করেছে। উভয়দিন ঘটনাক্রমে, কল্যাণ পার্টি বা তার চেয়ারম্যান প্রায়-এক্সক্লুসিভ কাভারেজ পেয়েছিল ওই ঘটনার কারণে। তৃতীয় উদাহরণ দেই। বিখ্যাত চিকিৎসক এবং টেলিভিশনে চিকিৎসা-বিষয়ক উপস্থাপক প্রফেসর ইকবাল হাসান মাহমুদকে, মানুষ চিকিৎসক হিসেবেই চেনে, কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির স্থায়ী কমিটিরও জ্যেষ্ঠ সদস্য, এটা মানুষ ব্যাপকভাবে জানে না, কারণ এটা প্রচারিত হয় না।
থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে একটি উদাহরণ দেই। একটি দলের নাম: ‘পালাং ধর্ম পার্টি’; প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮৫ সাল, আদি নেতা জেনারেল ছামলং শ্রী মুয়াং। প্রতিষ্ঠাকালে এই পার্টিটি নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিত, মেধাকে গুরুত্ব দিত এবং সাহসী জনপ্রিয় মানুষকে স্থান দিত। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে থাকসিন সিনাওয়াত্রা নামক একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী (কিন্তু নবীন রাজনৈতিক কর্মী) দলটির নেতৃত্ব অধিগ্রহণ করেন; জনগণের নিকট দলটির আবেদন কমে যায়; এবং এক পর্যায়ে দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিলুপ্ত দলের ভিটার উপরে, থাকসিন সিনাওয়াত্রা, একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ‘থাই রাক থাই পার্টি’। নতুন দলটি পুরানো দলের ঐতিহ্য টানেনি বা টানতে পারেনি। কিন্তু নতুন দল ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এবং জনপ্রিয় চটুল এজেন্ডা উপস্থাপন করে। থাকসিন সিনাওয়াত্রা-র স্ত্রী খুনইং পোটজামার্ন, তাদের পারিবারিক তহবিল থেকে, ২০০০ সালে, থাই রাক থাক পার্টির তহবিলে ২৪০ মিলিয়ন বাথ অনুদান দেন, নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েই। টাকা কথা বলে। অন্যান্য অনেকগুলো দল থেকে ৭০জন রাজনৈতিক নেতা বেশ কিছু কর্মীসহ থাই রাক থাক পার্টিতে যোগ দেন। পার্টিতে তখন টাকার জোয়ার ছিল। সাধারণ নির্বাচনের দুই বছর আগে থেকেই, থাকসিন সিনাওয়াত্রা সুপরিকল্পিতভাবে গরিব-বান্ধব বিভিন্ন এজেন্ডা জনগণের সামনে প্রচার করতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে থাই রাক থাই পার্টি পরবর্তী নির্বাচনে ২৪৮টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু একটি আশ্চর্যজনক কথা হলো এই যে, এই থাক রাক থাই নামক রাজনৈতিক দলই পরবর্তীতে প্রচার শুরু করে যে, টাকা থাইল্যান্ডের রাজনীতিকে নষ্ট করেছে। সিনাওয়াত্রা নিজে ক্ষমতাচ্যুত হন, দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। রাজনৈতিক নির্বাচনী কৌশলের মাধ্যমে থাকসিনের আপন ছোট বোন ইনলাক সিনাওয়াত্রা পরবর্তীতে পার্টি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হন; কিন্তু ইনলাকও ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। ভাইবোন উভয় সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
সাধারণভাবে ছোট দলগুলো টাকার উপর ভাসছে না, টাকার উপর ভাসার কোনোপ্রকার সুযোগও ছিল না এবং কোনো প্রকারের সুযোগ ভবিষ্যতেও নেই। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্মদিনেই গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল, এবং এই মুহূর্তেও পার্টির ওয়েব সাইটে গেলে পার্টি সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে। ফেসবুকের মাধ্যমেও জানা যাবে। আমাদের নীতিবাক্য বা মটো ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। অর্থাৎ আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। আমরা নির্বাচনমুখী দল, তবে অবশ্যই জোটের ছত্রছায়ায় এবং জোট কর্তৃক উপস্থাপিত অতি ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ সাপেক্ষে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি মেধাবী, সাহসী, স্পষ্টভাষী, দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিগণকে রাজনীতিতে আহবান জানায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দকে জাতীয় ঐক্যের সহায়ক উসিলা মনে করি, কোনোমতেই বিভক্তির অজুহাত মনে করি না। আমরা মনে করি ধর্ম মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু যে কোনো মূল্যেই ধর্মীয় স¤প্রীতি রক্ষা করতে হবে এবং সকল ধর্মের মূল্যবোধকে সম্মান করতে হবে। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধ-পক্ষ। আমরা তরুণ স¤প্রদায়ের অবদান নির্ভর দল এবং আমরা মনে করি তারুণ্যই বাংলাদেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই অনুচ্ছেদে যা বললাম এ কথাগুলো সুন্দর কথা। কিন্তু আমাদের সুন্দর কথা মানুষের নিকট কীভাবে পৌঁছাবো? মানুষের নিকট পৌঁছাতে না পারলে মানুষ দলটির উপর কীভাবে আস্থা আনবে? সেজন্য ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে অগ্রগতি করতে হবে। ওই অগ্রগতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে পার্লামেন্টে যাওয়া। ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক সৃষ্টি করা বিবিধ প্রকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার কারণে আমরা, আমাদের জোট বা আমাদের জোট-বহির্ভুত অনেকেই গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। আমরা খুশিমনে আমাদের প্রধান শরীকের সঙ্গে থেকেছি। আমাদের দাবি-বক্তব্য-আবেদন, সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে যেন, আগামী নির্বাচন ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক হয়। এটা বাংলাদেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। সরকারকেই ময়দান প্রস্তুত করতে হবে। ক্ষুদ্র দল হলেও, নির্বাচন কমিশনের আহবানে, কল্যাণ পার্টি এবং অন্যান্য দলগুলো নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে বসেছিল। আশা করি, কমিশন ছোট দলগুলোর বক্তব্যগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন