আরবী চান্দ্র সনের নবম মাস রমজান। আরবী রমাদান শব্দের ফারসী উচ্চারণ রমজান। আমাদের দেশে ফারসীর প্রভাব বেশী থাকায় রমাদানের স্থলে রমজান শব্দের ব্যবহার অত্যাধিক রয়েছে। রমাদান শব্দের শব্দমূল হচ্ছেÑ র-ম-দ বা রমদ এর অর্থ গ্রীষ্মের প্রচÐ উত্তাপ। জানা যায়, প্রাচীনকালে আরব দেশে সৌর হিসাবে বছর গণনা করা হতো। তখন গ্রীষ্মকাল বলতে শাহারু রমাদান ব্যবহৃত হতো।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য ফেব্রæয়ারি মোতাবেক দ্বিতীয় হিজরীর মধ্য শাবানে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু রমজান মাসকে সিয়াম পালনের জন্য ধার্য করে দিয়ে সিয়াম বিধান নাযিল করেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : রমজান মাস, এতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য সৎপথের দিশা এবং সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্যকারী আল কুরআন। সুতরাং তোমরা যারা এই মাসকে প্রত্যক্ষ করবে তারা এতে সিয়াম পালন করবে। (সুরা বাকারা আয়াত- ১৮৪)। এরই ১৪ দিন পর সাবান মাসের শেষ দিন মসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল বেলা একত্রিত হলেন। হয়রত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহ তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, সাবান মাসের শেষ দিনে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশে প্রদত্ত খুতবায় বল্লেন : হে মানুষ! তোমাদের ছায়া দিতে আবিভর্‚ত হচ্ছে মহান মোবারক মাস। এই মাসে রয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী। এ মাসের সিয়ামকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন। এর রাতে দন্ডায়মান হওয়াতে (তারাবির সালাত আদায়ে) রয়েছে সওয়াব। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে, সে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করার সমান সওয়াব পাবে, আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করবে। এটা ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। এটা সহমর্মিতার মাস। আর এটা হচ্ছে সেই মাস যাতে বৃদ্ধি করা হয় মুমিনের রিযিক। যে ব্যক্তি কোনো সায়িমকে (রোযাদার) ইফতার করাবে সে ব্যক্তির জন্য তা গোনাহ মাফ পাবার এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাবার হেতু হয়ে যাবে। এছাড়া তার সওয়াব হচ্ছে সেই সায়িমের সমান কিন্তু সায়িমের সওয়াব একটুও কমে যাবে না। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞাসা করলাম : হে আল্লাহর রাসূল আমাদের মধ্যে অনেকেরই সায়িমকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য নেই। তখন হযরত রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: পেট ভর্তি করে খাওয়াতে হবে এমনটা নয়। আল্লাহ তায়ালা তাকেই সওয়াব দান করবেন যে সায়িমকে এক চুমুক দুধ অথবা এক টুকরো খেজুর কিংবা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো সায়িমকে তৃপ্তির সাথে খাওয়াবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউদ (হাউযে কাওসার) থেকে পানি পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে দাখিল হওয়ার আগ পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। এ এমন এক মাস যার প্রথামাংশ রহমতের, মধ্যাংশ মাগফিরাতের আর শেষাংশ দোযখের আগুন থেকে মুক্তির। আর যে ব্যক্তি এ মাসে চাকর-বাকরদের (অধীনস্থ) কাজের ভার (বোঝা) লাঘব করে দেবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দোযখ থেকে তাকে নাযাত দান করবেন। (বায়হাকী, মিশকাত শরীফ) রমযান মাসের প্রাক্কালে প্রিয় নবী রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ খুতবায় রমাদান মাসের মহাত্ম্য যেমন তুলে ধরেন তেমনি এই মাসে যেসব বরকত ও প্রাচুর্য রয়েছে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন। সেই রমজানের ১৭ তারিখের মদীনা শরীফ থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ।
ইসলামে যে পঞ্চ বুনিয়াদ বা স্তম্ভ হচ্ছে রমাদান মাসের সিয়াম। ইসলাম সেখানেই গিয়েছে সেখানেই রমজানের সিয়াম পালনে মুসলিমগণ যতœবান হয়েছেন এবং রামজান মাস পবিত্র মাস হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশে যতদূর জানা যায় ইসলামের আবির্ভাব ঘটে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হোদাইবিয়া সন্দির পর পরই। বাংলাদেশের মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ফারুকে আযম হয়রত ওমর ইবনে খাত্তাব রাজি আল্লাহু তায়ালা আন্হুর খিলাফতের মধ্য ভাগ থেকে। রমজান বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আত্মসংযম সহিঞ্চুতা, তাকওয়া এবং মানবতাবোধের উপাদান হিসেবে স্থান করে নেয়। রমজান মাস আসার পূর্বেই এখানে একটা পূতপবিত্র আবহ সৃষ্টি করে। ঘরে ঘরে মুসলিম পরিবারে রমজানের সিয়াম পালনের তোড়জোর ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। সিয়াম পালনের জন্য অনেকেই উদগ্রিব হয়ে ওঠে। এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত সিয়াম রাখার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামে। সেহরী, ইফতার, তারাবির নামাজ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মসজিদগুলোতে কিংবা কারো কারো কাচারি ঘরে তারাবির নামাজে খতমে কোরআন হয়ে থাকে। রাতের শেষ প্রহরে মানুষকে সেহরী খাওয়ার জন্য উৎসাহী যুবকরা সুললিত কণ্ঠে আহŸান জানায়, ওঠো ওঠো সেহরীর সময় হয়ে গেছে বলে রাস্তায় রাস্তায় দল বেঁধে আহŸান জানাতে থাকে। ইফতারের সময় নির্ধারণের জন্য অনেকেই হাতের লোম দেখে। ইফতার করানোর জন্য শহরে শহরে ইফতার পার্টি অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামে-গঞ্জে ইফতার করানোর জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়। গ্রামে ইফতার করানোর আয়োজনে মাগরিবের নামাযের পর রোযাদারদের পেট পুরে খাওয়ানো হয়। যাকে যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলে রোযাদার খাওয়ানো বলা হয়। ইফতার সামগ্রিতে ছোলা ভিজানো, ভুনা ছোলা, আদা কুচি, চিড়ে ভিজানো, কলা, আখের গুড়, শশা, শরবত, খির, মুড়িসহ নানা পদের খাবার বিতরণ করা হয়। (মুড়ি যাকে যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলে উড়–ম বলা হয়।) শহর অঞ্চলে ইফতার সেহরীর ওয়াক্ত জামান দেওয়ার জন্য সাইরেন বাজানো হয়। বাংলাদেশে রমজান মাস সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। দিনের বেলায় হোটেলগুলোর সামনে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন সংগঠন রমজানের ও সিয়ামের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন আলোচনা সভার আয়োজন করে। বাংলা সাহিত্যে রমজান ও সিয়াম বিষয়ক প্রস্তুক-প্রস্তিকা বের হয়েছে; এমন কোনো মুসলিম কবি নেই যিনি রমজান, সিয়াম, সেহরী ইফতার নিয়ে লেখেননি। কবি নজরুল ইসলাম মুসলিম জাগরণের কবি, ফররুখ আহমদ, কবি শাহদত হোসেন, কবি তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, কবি গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই কিছু না কিছু কবিতা লিখেছেন যেগুলো বাংলা কাব্যে অমূল্য সম্পদ।
রমজান মাসের শেষ দশকে মসজিদে নির্জন-নিরালায় আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য এবাদত বন্দেগীর নিয়তে অবস্থান নেয়াকে বলা হয় ইতেকাফ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন; এটা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। একটা মহল্লায় বা পাড়ায় মসজিদে ইতেকাফ করা অবশ্য কর্তব্য। যদি কোনো মসজিদে ইতেকাফ না করে সেজন্য মহল্লার সকলেই গোনাহগার হবে। যদি একজনও ইতেকাফ করে তাহলে সবাই এর সওয়াব লাভ করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রফিকুল আলা আল্লাজাল্লা শানুহুর দরবারে চলে যাওয়ার বছরে ২০ (বিশ) দিন ইতেকাফ করেছিলেন। ইতেকাফের সময় হযরত জিব্রাইল আলাইহি সালাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে সে পর্যন্ত নাযিলকৃত কুরআন মজিদ শুনতেন এবং শোনাতেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র বিবিগণও ইতেকাফে মসজিদে নববীতে পর্দা করে ইতেকাফ করতেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতে তওবার খুঁটির পাশে তাঁবু খাটিয়ে ইতেকাফ করতেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ইতেকাফের আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। ইতেকাফ হালতে কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ইতেকাফস্থল ত্যাগ করা যায় না। বর্তমান লেখকের আব্বা হুজুর কেবলা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর কুতুবুল আলম হযরত মাওলানা শাহ সুফি আলহাজ তোয়াজ উদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহ আলাইহিÑ ইতেকাফ করতেন এবং তার সঙ্গে অনেকেই এর ইতেকাফ শরীক হইতেন। ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি ও কুরবত দ্রæত হাসিল হয়। এতে লায়লাতুল কদর অতি সহজেই অতি নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করার নসিব লাভ হয়।
মুত্তাকী হবার প্রশিক্ষণের জন্যই রমাদানের এক মাস সিয়াম পালন করাকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ফরজ করে দিয়েছেন। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য, তাই আমিই এর প্রতিদান দেবো। (বুখারী শরীফ)।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিক মানে রমজান মাস তথা সিয়ামের মাসই মুত্তাকী হবার প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করে দেয়।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ।
মুফাসেরে কোরআন,
সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন