বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজধানীতে যানজটে বিশাল ক্ষতি

| প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

শুধুমাত্র রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি হয় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে নষ্ট হয় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, যার আর্থিক মূল্য ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে বুয়েটে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড: মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে আসে, যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গতিও ৫ কিলোমিটার। তার মতে, যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনা যেতো তাহলে অন্তত ২২ হাজার কোটি বেঁচে যেতো। উল্লেখ করা যেতে পারে, যানজট কেবলমাত্র রাজধানীরই সমস্যা নয়, গোটা দেশেরই এটা সাধারণ সমস্যা। গত সপ্তাহখানেক ধরে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন বলে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট ভয়ংকর রূপে নিয়েছে। অতীতের রেকর্ড ভঙ্গকারী এই যানজট ১২০ থেকে ১৩৯ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি এক ইঞ্চি পরিমাণ এগুতে না পারার মত বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ করা গেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বড় জোর ৫/৬ ঘণ্টার রাস্তা। অথচ পৌঁছাতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত পার হয়ে গেছে। এই নজিরবিহীন যানজটে যাত্রীদের বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে গেছে, যার বর্ণনা দুষ্কর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এর ৬০ শতাংশ মালবাহী গাড়ি। সুতরাং এরকম যানজটের কারণে ব্যবসায়ীদের কতটা ক্ষতি হয়, পণ্যমূল্যে যানজটের ক্ষতি সংযুক্ত হয়ে কীভাবে ক্রেতা সাধারণের পকেট তসরূপের কারণে পরিণত হয়, সহজেই অনুমেয়। বিনিয়োগ বোর্ডের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, সারাদেশে যানজটের কারণে বছরে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হয় এক লাখ কোটি টাকা। উৎপাদন ক্ষতি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও দুর্ঘটনার ক্ষতি ধরলে এই পরিমাণ হবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ক্ষতির এই পরিমাণ জাতীয় বাজেটের প্রায় অধিক এবং এ অর্থে বছরে অন্তত পাঁচটি পদ্মাসেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
রাজধানীতে যানজট সারাবছরেরই নিত্য-নৈমিত্যিক বিড়ম্বনা। সড়ক থেকে গলি কোনোটাই যানজট থেকে মুক্ত নয়। কখনো কখনো, বিশেষ করে যখন কোনো ভিআইপি কোথাও যান বা আসেন তখন যানজট দুবিষহ রূপ ধারণ করে। যানজটের একটা বড় কারণ তো এই যে, দেড় কোটি মানুষের বসবাসস্থল এই শহরে যে পরিমাণ রাস্তা থাকার কথা, তা নেই। দ্বিতীয়ত, রাস্তার তুলনায় গাড়ীর সংখ্যা অনেক বেশী। এই সঙ্গে লাখ লাখ অযান্ত্রিক যানবাহনও চলাচল করে। এই বাস্তবতায় যানজট হতে বাধ্য। উল্লেখ্য, কোনো কিছুই ঠিকঠাক মত নেই। অপরিসর ট্রাফিক সংযোগস্থল, সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখল, গণপরিবহণ যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, বিভিন্ন সেবা সংস্থার নির্মাণ- মেরামতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে যানজট অপরিহার্য বান্ধবে পরিণত হয়েছে। ড. মোয়াজ্জম হোসেন যানজট ৬০-শতাংশ কমিয়ে আনার যে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, তা সম্ভব হতে পারে যদি গাড়ী চলাচলের ক্ষেত্রে শৃংখলা বিধান করা যায়, রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা যায়, সেবাসংস্থাগুলোর কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করা যায় এবং কাজের পর রাস্তা দ্রæত মেরামত করা যায়। দেখা যায়, রাস্তাগুলো বারো মাসই ভাঙ্গাচোরা ও খানাখন্দে ভরা থাকে। এ ধরনের রাস্তায় গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ফলে যানজট দেখা দেয়। রাস্তাগুলো যতটা সম্ভব সম্প্রসারণ ও মসৃণ করা হলে গাড়ির গতি বাড়বে, যানজট সৃষ্টি হবে না। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা হ্রাস এবং অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ অরোপ করাও অত্যাবশ্যক। রাজধানীর যানজটের এই কারণগুলো কারো অজানা নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোও জানে। কিন্তু রাস্তাঘাট, সুযোগ-সুবিধা ও সিস্টেম যেখানে যে অবস্থায় যতটুকু আছে তা কাজে লাগিয়ে অধিকতর সেবা ও সুফল নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। রাস্তা ও ফুটপাত দখল মুক্ত করা, গণপরিবহণগুলোকে একটা শৃংখলায় এনে ট্রাফিক নিয়ম-বিধি মোতাবেক পরিচালনা করা, কিংবা সেবাসংস্থাগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা কি অসম্ভবপর? মোটেই না। সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই এই কাজগুলো করা সম্ভব। মানুষের ক্ষেত্রে মুখমন্ডল যেমন, দেশের ক্ষেত্রে রাজধানীও তেমনি। আমাদের রাজধানী যানজট, দূষণ, জলবদ্ধতা অনিরাপত্তা ইত্যাদি কারণে বাস-অযোগ্য হয়ে আছে। কবে এঅবস্থার অবসান হবে কেউ বলতে পারে না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যানজট শুধু রাজধানীর নয়, গোটা দেশেরই সাধারণ সমস্যা। এর সমাধানও তাই জাতীয়ভাবেই করতে হবে। সরকার একের পর এক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। সরকারের ভাষায়, দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার বইছে। অথচ যানজট নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, প্রকল্প নেই। পদ্মাসেতু নির্মিত হচ্ছে। সরকারের একটা গর্বের প্রকল্প। সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ, যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। কথাটা সত্য। কিন্তু পদ্মাসেতুমুখী দুদিকের সড়ক-মহাসড়ক যদি যানজটে অচল হয়ে পড়ে তাহলে কি ওই সেতুর প্রত্যাশানুগ সুবিধা পাওয়া যাবে ?’ যমুনাসেতু থেকে কি পাওয়া যাচ্ছে? ঢাকা থেকে যমুনাসেতু পর্যন্ত যেতে কিংবা যমুনাসেতু থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতে অনেক সময় দিন পার হয়ে যায়। বলা যায়, এমন কোনো সড়ক-মহাসড়ক নেই যেখানে কম বা বেশি যানজট নেই। যানজট জনদুর্ভোগের পাশাপাশি অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিচ্ছে। এ অবস্থা আরো অধিক দিন চলতে পারে না। দেশের কাঙ্খিত উন্নয়নের জন্য ছোট্ট, বড়, মেগা-সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পই গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার। তাহলেই আমাদের উন্নয়ন-আকাঙ্খা পূরণ হবে। সড়ক উন্নয়ন বা সড়ক যোগাযোগের মসৃনতা যে কোনো উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। কাজেই আমাদের যতটা সড়ক আছে, তা রক্ষা করতে হবে এবং যে সিস্টেম আছে তার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) আওতাধীন সড়ক-মহাসড়ক আছে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। ওই অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এই সড়ক-মহাসড়কের ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশের অবস্থা অত্যন্ত বহাল। দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশী রাস্তা খুবই খারাপ, চলাচলের অযোগ্য। আর এক হাজার ৭৩ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ। খুব খারাপ ও খারাপ রাস্তায় যানবাহনের ধীরগতি ও যানজট অবশ্যম্ভাবী। এও দেখা গেছে, কোনো সড়ক বা মহাসড়কে যানজট লেগেছে; এরপর অন্যান্য সড়ক-মহাসড়কেও তার প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টি-বন্যায় রাস্তাঘাটের ক্ষতি হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের দেশের রাস্তার বেহাল দশার জন্য বৃষ্টি-বন্যা বিশেষভাবে দায়ী। প্রশ্ন হলো, বৃষ্টি-বন্যা আরো অনেকে দেশেই হয়। কিন্তু ওই সব দেশে রাস্তাঘাটের এমন নাজুক অবস্থায় পড়তে দেখা যায় না। বলা বাহুল্য, এখানে নির্মাণে ত্রুটি, সংস্কারে ত্রুটি এবং লুটপাটের কারণে রাস্তাঘাটের এই ভগ্নদশা। সরকারের এদিকে নজর দেয়া জরুরি। সরকারকে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন, মেরামতে দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাট বন্ধ করতে হবে। যথাসময়ে কাজ শেষ করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গতিশীল ও মসৃণ মহাসড়ক, উন্নয়নের মহাসড়ক ওঠার অন্যতম মাধ্যম ও অবলম্বন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন