দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদ। রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোতে মানুষ আর মানুষ। রাস্তায় অসহনীয় যানজট। কেনাকাটা চলছে পুরোদমে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে নগরবাসী হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিপণিবিতানগুলোতে। যানজট কিংবা গরম বাধা হতে পারেনি কেনাকাটায়। রাজধানীর নিউ মার্কেট, চাঁদনি চক, গাউছিয়া, এলিফেন্ট রোড, হকার্স মার্কেটের সামনে ফুটপাত থেকে শুরু করে মূল দোকানের ভেতরে কোথাও যেন পা ফেলার জায়গা নেই। সব স্থানেই মানুষ আর মানুষ। যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে ঈদ বাজার। ঈদের কেনাকাটায় সকাল থেকে মানুষের ভিড় ছিলই কিন্তু দুপুরের পর থেকে ক্রেতা উপস্থিতি আরও বাড়তে থাকে। ফলে মার্কেটসহ আশেপাশের স্থানগুলো রূপ নেয় জনসমুদ্রে। দৃশ্যটা এমন যেন সাবাই এসেছে ঈদ বাজারে। ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। আর তাই সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় ক্রেতাদের চাপে বিক্রেতাদেরও দম ফেলার সময় ছিল না এদিন। রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, ধানমন্ডি হকার্স, রাপা প্লাজা, বসুন্ধরা সিটি, মেট্রো শপিংমল, এলিফেন্ট রোডসহ আশেপাশের মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনের তুলনায় ক্রেতাদের ভিড় সর্বোচ্চ। গাউছিয়া, চাঁদনি চক, নিউমার্কেটে ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। এ ছাড়া চাঁদনি চক মার্কেটে তো পা রাখার জায়গায় নেই। ক্রেতা আসছেন, থরে থরে সাজানো বাহারি সব ড্রেস দেখছেন, কিনছেন। এদিকে মার্কেটের পাশ দিয়ে যাওয়া কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতে ভেসে আসছে বিক্রয় কর্মীদের হাঁকডাক। বাহারি নিত্য নতুন ডিজাইনের পাশাপাশি দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় চাঁদনি চকে ক্রেতাদের উপস্থিতি বছরজুড়েই থাকে। আর ঈদে তো কথায় নেই।
জানা গেছে, চাঁদনি চকে জর্জেটের ওপর কাজ করা থ্রি পিস, বুটিকস আইটেমের থ্রি পিস, লন, ভয়েল ও শার্টিনের থ্রি-পিসের চাহিদা বেশি। চাঁদনি চকে রফিক টেক্সটাইলের হায়দার হোসেন ব্যস্ত ক্রেতাদের চাহিদার পোশাক দেখাতে। দামে মিলে গেলেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন কাউন্টারে। সকাল থেকে সমান্য অবসরও পাননি তিনি।
কাজের ফাঁকে তিনি বলেন, রমজান শুরুর পর ঈদ বাজারে আজ সর্বোচ্চ ভিড়। একদিকে ঈদ প্রায় আসন্ন তার উপর শুক্রবার হওয়ায় ক্রেতাদের সর্বোচ্চ উপস্থিতি। যে কারণে বিক্রিও ভালো। সকালের তুলনায় দুপুরের পর থেকে কাস্টমার বেড়েছে। সন্ধ্যার পর আরও বাড়বে। আশা করা যায় ঈদের আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই কাস্টমারদের এ ভিড় থাকবে। চাঁদনি চকে ড্রেস কেনা শেষে গাউছিয়া, নিউমার্কেট থেকে অর্নামেন্টস আর ব্যাগ কিনেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরা খাতুন।
তিনি বলেন, শুধু নিজের কেনাকাটাই নয় ঈদের সময় আত্মীয় স্বজন সবার জন্যই কেনাকাটা থাকে। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ার সবাই মার্কেটে আসায় অতিরিক্ত ভিড় হয়েছে। ফলে কোনো কিছুই ভালো করে দেখে কেনার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া এসব মার্কেটে তুলনামূলক দাম কম পাওয়া যায়। ঢাকা কলেজের বিপরীতে ধানমন্ডি হকার্স শাড়ির মার্কেটেও ছিল ক্রেতা সাধারণের উপচে পড়া ভিড়। প্রতিটি দোকানের বিক্রেতারা ব্যস্ত।
এ মার্কেটের শাড়ি ঘরের ম্যানেজার সোবহান তালুকদার বলেন, মানসম্মত, বাহারি ডিজাইনের সব শাড়ি সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। তাই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারা এখানে আসেন।
চাঁদনি চক, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, এলিফেন্ট রোড, হকার্স মার্কেটে ক্রেতাদের উপচে ভিড় দেখা গেলেও সে তুলনায় নিউমার্কেটে ছেলেদের পোশাকের দোকানে তেমন ভিড় ছিল না। একই চিত্র পাশের চন্দ্রিমা মার্কেটেও। এ বিষয়ে নিউমার্কেটের ওয়ান ক্লাবের দোকানি ফয়েজ উদ্দিন বলেন, ছেলেদের পাঞ্জাবি, শার্ট প্যান্ট কেনার অসংখ্য মার্কেট রয়েছে। যে কারণে এক জায়গায় সব সময় ক্রেতাদের ভিড় হয় না। ছেলেরা যে কোনো মার্কেটে যায় আর কিনে ফেলে।
চাঁদপুরে সরগরম
চাঁদপুর থেকে বি এম হান্নান:
রমজান মাস বিদায় নিচ্ছে, আর এগিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠছে চাঁদপুর শহর ও উপজেলা সদরের মার্কেট, বিপণী বিতানগুলো। গ্রামের হাট-বাজারও সরগরম হয়ে উঠছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অভিভাবকরা ছুটছেন শাড়ি-থান কাপড়, থ্রি-পিচ, টেইলার্স, কসমেটিকস ও জুতার দোকানে। তাদের অধিকাংশই নারী। বাড়ছে পোশাক তৈরির মাস্টার ও কারিগরদের ঈদ কেন্দ্রিক ব্যস্ততা। দিনের বেলা শহরে ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেখা যায়, সকাল দশটার পর থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়ক, শপথ চত্বর, মিজান চৌধুরী সড়ক, জেএম সেনগুপ্ত রোড, টাউন হল, কুমিল্লা রোড, পালবাজার ব্রীজ চত্বর, নতুনবাজার, বিপণীবাগ, বাসস্ট্যান্ড সড়ক, পুরাণবাজারের যোগীপট্টি, খলিফা পট্টি, মসজিদপট্টি ও ট্রাঙ্কপট্টিতে মানুষের ভিড় বাড়ছে। অনেকেই সেরে নিচ্ছেন আগেভাগে নিজেদের পছন্দসই কেনাকাটা।
রেলওয়ে হকার্স মার্কেট, হাকিম প্লাজা, মীর শপিং কমপ্লেক্স এবং কুমিল্লা রোডের জুতার দোকানগুলোতে ঈদের আগাম কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। বাটা, এ্যাপেক্স ও লোটোর জুতার শো-রুমসহ অন্যান্য সকল জুতার দোকানে ক্রেতার উপস্থিতিতে সরগরম।
কুমিল্লা রোডের নূর ম্যানশনের নিচতলায় শাড়ি ও রকমারি বাহারি থানকাপড়ের কয়েকটি দোকান রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দোকানগুলো হচ্ছে, বিজয়িনী ফ্যাশন, অনি বস্ত্রালয়, আল-ইসলাম বস্ত্রালয়, মা বস্ত্রবিতান ও বৃষ্টি ম্যাচিং সেন্টার। বিজয়িনী ফ্যাশনের পরিচালক সমীর পোদ্দার জানান, এবার ঈদের জন্যে নারীদের গুজরাটি, পিউর, অর্গেন্ডি, নেইট, সুতি কাজ করা অল ওভার, পিউর প্রিন্ট, কামিজ ও লাসার কাপড় বেশি পছন্দ। ক্রেতারা ম্যাচিং করে থান কাপড় কিনে টেইলার্সে যাচ্ছেন। এ মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একাধিক দর্জি ও লেইস ফিতার দোকান।
রাজনন্দিনী টেইলার্সের মাস্টার হাশেম ও আকাশ জানান, ক্রেতারা তাদের পছন্দের কাপড় নিয়ে আসলে আমরা তৈরীর অর্ডার নেই। বিশ রমজানের পর অর্ডার নেয়া সম্ভব হয় না। জর্জেট, সুতি, এক কালার ও প্রিন্টের কাপড়ের কামিজ, ফ্লোর টাচ ও থ্রি-পিচের অর্ডারই বেশি। এখানে আছে প্রিয়জন, সূর্যকন্যা, চাঁদনি, আঁখি মনি, আপনজন, আঁচল, সাগরিকা টেইলার্স, রাজধানী, জননী লেডিস টেইলার্স, স্মরণ লেইস কর্নার ও ভাই ভাই সুতা ঘর। তাদের কাজের অর্ডার ও লেইস ফিতার বিক্রি ভালো যাচ্ছে বলে দোকানীরা জানিয়েছেন। অপ‚র্ব এমব্রয়ডারি হাউজের হস্তশিল্পী মিঠুন জানান, রোজা যত শেষের দিকে যাবে, কাজের পরিমাণ তত বাড়বে। স্মরণ লেইস কর্নারের পরিচালক বাদল দে জানান, শাড়ি, কামিজ ও পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচিং করে ক্রেতারা পুতি, বোতাম ও বিভিন্ন ডিজাইনের লেইস এবং বোরকার সামগ্রী সংগ্রহ করে নিচ্ছে।
পৌর নিউ মার্কেটের বিসমিল্লাহ পাঞ্জাবি টেইলার্সের মাস্টার হোসেন জানান, চাকরিজীবীরা বেতন পাওয়ার পর ভিড় আরো বাড়বে। এখনো কাজের চাপ শুরু হয়নি। কিংস টেইলার্স এন্ড ফেব্রিক্স-এর মাস্টার কাইয়‚ম জানান, শার্ট, প্যান্ট ও পাঞ্জাবির অর্ডার মোটামুটি পাচ্ছেন। শহরের জোড় পুকুর পাড়স্থ ড্রেসকো টেইলার্সে রোজা শুরুর আগ থেকেই পোশাক সচেতন নারী ও পুরুষ তাদের রুচিসম্মত পোশাক বানাতে ভিড় করছেন। এবারও পোশাক তৈরির অর্ডার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ড্রেসকো এগিয়ে থাকবে বলে আশা করছেন তারা।
কদর কমেনি খাদি পাঞ্জাবির
সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে
বর্ণময় রঙ, কারুকাজ ও অসাধারণ ফ্যাশনে পাঞ্জাবি এখন সব বয়সীদের পছন্দের সেরা তালিকায় রয়েছে। ঈদের কেনাকাটায় শার্ট প্যান্ট, টি-শার্ট যা-ই থাকুক না কেনো চাই পাঞ্জাবি। বর্তমানে দেশিয় ফ্যাশন হাউজের প্রায় ১৫টি শো-রুম কুমিল্লা নগরীতে স্থান করে নিয়েছে। এবারের ঈদে এসব ফ্যাশন হাউজের নিজস্ব ডিজাইনের পাঞ্জাবির ভিড়েও কুমিল্লার ঐতিহ্যের খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবির কদর একদম কমেনি। দামের দিক থেকে খাদির পাঞ্জাবি সবশ্রেণির ক্রেতার নাগালের মধ্যেই রয়েছে। কুমিল্লার খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবিতে আনা হয়েছে শৈল্পিকতা।
শতবর্ষের পথ পরিক্রমায় রঙ ও নকশায় কুমিল্লার খাদির পাঞ্জাবি হাল ফ্যাশনে যোগ করেছে নতুন ডাইমেনশন। কুমিল্লার খাদি কেবল কাপড়ই নয়, এশিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই উপমহাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহবানে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কুমিল্লায় খদ্দরশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামে ১৫-২০টি তাঁত মেশিনে বোনা হচ্ছে কুমিল্লার ঐতিহ্যের কাপড় খাদি। সময়ের পরিক্রমায় ফ্যাশন ডিজাইনারদের ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাটিকের সেলোয়ার কামিজ, ওড়না, স্কার্ট, বিছানার চাদর, গায়ের চাদর এবং ব্যাগ, টুপি, গলাবন্ধনীসহ ব্যবহার্য অন্যান্য পোশাক। খাদি কাপড়ের রং, নকশা ও বুনন বৈচিত্র্য এপণ্যের চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে কুমিল্লার লোকজন ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালি, ফেনি অঞ্চলের লোকজন খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বিছানার চাদর ও বাটিকের থ্রিপিস কিনে নিচ্ছেন।
নগরীর মনোহরপুরের খাদি বিতান, খাদি আড়ং, খাদি ভবন, খদ্দর ভান্ডার, প্রসিদ্ধ খাদি ভান্ডার, বিশুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার, খাদি অঙ্গন, লাকসাম সড়কে খাদি আড়ং, খাদি কটেজ, খাদিশিল্প, পুর্বাশা গিফট এন্ড খাদি, জোসনাসহ শতাধিক দোকানসহ ফ্যাশন হাউজগুলোতে বিভিন্ন ডিজাইনের কারুকাজ মিশ্রিত পাঞ্জাবি যেমন বিক্রি হচ্ছে তেমনি খাদির পাঞ্জাবিও সমানতালে ক্রেতা চাহিদা পূরণ করছে। দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এবারের ঈদে দেশিয় ও ভারতীয় হালফ্যাশনের পাঞ্জাবির জমজমাট বিক্রির পাশাপাশি কুমিল্লার খাদির পাঞ্জাবিও বিক্রি হচ্ছে। ঢাকাই বা ভারতীয় পাঞ্জাবি ক্রেতারা নিলেও অনেকেই ঐতিহ্যের কুমিল্লার খাদির একটি পাঞ্জাবি বা ফতুয়া কিনে নিচ্ছেন। মাত্র ৫শ’ থেকে একহাজার টাকার মধ্যেই মিলছে কুমিল্লার খাদির পাঞ্জাবি। নগরীর মনোহরপুরের খাদি বিতানের পরিচালক হুমায়ুন কবীর হিমু জানান, কুমিল্লার ঐতিহ্য খাদির পাঞ্জাবিতে রয়েছে ব্যতিক্রমী বৈচিত্র্যতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন