বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ইসলাম

মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৭ এএম | আপডেট : ৯:১৬ পিএম, ১২ জুলাই, ২০১৮

এক
সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিটি প্রাণিকুলেরই ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে যেমন গাছপালা, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন, বাড়ি-ঘর ও কল-কারখানা ইত্যাদি নিয়েই পরিবেশ। কোন পরিবেশে বাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে, ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। তাই ইসলাম প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে এবং যা প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে খ্যাত, এগুলো মহান স্রষ্টার অপার নেয়ামত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই, বস্তুত এর ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ (১৫ : ১৯-২২)
বিশ্বব্যাপী চলছে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় ও পন্থা উদ্ভাবনের নিরলস প্রচেষ্টা। কানাডার মন্ট্রিল চুক্তি, ব্রাজিলের রিওডি জেনিরো আর্থ সামিট ১৯৯২, মেক্সিকোর কানকুন ধরিত্রি সম্মেলন তারই অংশ বিশেষ। জনগণকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গবেষণা, বিজ্ঞাপন প্রভৃতিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এমনকি প্রত্যেক বছরের ৬ জুন পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করছে বিশ্ববাসী। এর ফলে বন ও পরিবেশ বিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে এবং এটি একটি স্বতন্ত্র সাবজেক্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটির পাঠ্য করা হয়েছে। অথচ ভাবতেই অবাক লাগে যে আজকের যুগে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণের মত একটা বিরাট সমস্যাকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলাম অনুভব করেছে এবং এর সংরক্ষণ তথা সমাধানের উপায়ও বলে দিয়েছে।
পরিবেশ সম্পর্কে আজকের মানুষ যতটুকু জ্ঞান রাখে তার ছিটে ফোটাও যখন ছিল না সেই পূঁতিগন্ধময় পরিবেশের আবরণ ভেদ করে যিনি ঊষার আলো ছড়ালেন তিনিই আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। উম্মী নবী কুরআনুল কারীমের শিক্ষার আলোকে নিজের অনুপম চরিত্র ও আদর্শের মাধ্যমে বিশ্ববিবেককে জানালেন পরিবেশ সংরক্ষণের কৌশল, দীক্ষা দিলেন সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গঠনের। বৃক্ষ রোপনকে সদকায়ে জারিয়া ঘোষণা দিলেন, মক্কা ও মদীনার বিশেষ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে উদ্ভিদ গাছপালা কর্তন এবং জীব জন্তু হত্যা নিষেধ করে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় তার দূর দৃষ্টিরই পরিচয় দিয়েছিলেন । যখন মানুষের কল্পনায় ঝড়পরবঃু ভড়ৎ ঢ়ৎবাবহঃরড়হ ড়ভ পৎঁবষঃু ঃড় ধহরসধষং বা পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির কথা উদ্ভব হয়নি তখন মহানবী (সা.) জীব জন্তুকে কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দিতে মানব জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন “সওয়ারীর পশু ক্লান্ত হয়ে গেলে তার উপর থেকে নেমে পড়”। রাসূলের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আজকের আধুনিক বিশ্বেও বিস্ময়কর! আল্লাহ প্রদত্ত গাইড বুক আল-কুরআনের মাধ্যমে তিনি যে নৈতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন যা পরিবেশ সংরক্ষণের নিয়ামক শক্তি, তা আজকাল শুধু নয়, কিয়ামত পর্যন্ত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পথ নির্দেশ দানে সক্ষম।
পরিবেশের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ: পরিবেশের আরবী আভিধানিক প্রতিশব্দ বায়্যিয়াতুন, আর ইংরেজিতে ঊহারৎড়হসবহঃ, পরিবেশ সম্পর্কিত বিদ্যাকে বলা হয় ঊপড়ষড়মু বা বস্তু বিজ্ঞান । পরিভাষায় ড. মাহমুদ সালেহ আদেলী তার “আল ইসলামুল বায়্যিয়াহ” নামক গ্রন্থে বলেন- মানব মন্ডলীকে বেষ্টন করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে সৃষ্টি জগৎ তাকেই পরিবেশ বলা হয়। সুতরাং পরিবেশ বলতে পৃথিবীর সব কিছু যা ভূ পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত আলো- বাতাস, মাটি -পানি, মেঘ – কুয়াশা, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, মানব নির্মিত সকল প্রকার অবকাঠামো এবং গোটা উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ সমন্বয়ে যা সৃষ্ট তাই পরিবেশ । পরিবেশ প্রথমত দুই প্রকার : ১. ঘধঃঁৎধষ ঊহারৎড়হসবহঃ ২. ঐঁসধহ ঊহারৎড়হসবহঃ . ড. মাহমুদ সালেহ আদেলী বলেন তিন প্রকার, উপরোক্ত দুইটিসহ তৃতীয়টি হলো -ইরড়ষড়মরপধষ ঊহারৎড়হসবহঃ
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে আল্লাহর বানী: পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাকিদ। পরিবেশ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বাণী- “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে আদ জাতির পরে প্রতিনিধি করেছেন; তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ কর এবং পর্বত গাত্র খনন করে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ কর। অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না ’’। (সূরা আরাফ-৭৪) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সূরা আর রুম : ৪১) পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। কোরআনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও।’ (সূরা বাকারা: ২২২)
কুরআন মাজিদের অনেক সূরার নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও খনিজসম্পদের নামে। যেমন- গরু, হাতি, মাকড়সা, মৌমাছি, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি। পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য আসমান থেকে আল্লাহ বর্ষণ করেন স্বচ্ছ পবিত্র পানি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর সজীব করেন। প্রত্যেক প্রকারের জীবজন্তুর বিস্তৃতি ঘটান। আসমান ও জমিনের মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত বায়ু ও মেঘ পানির পরিবর্তনে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন বিদ্যমান।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে মহানবী (স.)এর অবদান: প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দাবিতে দুনিয়া জুড়ে আজ সম্মিলিত আওয়াজ উঠেছে। মানুষের অদূরদর্শিতা এবং অমানবিক আচরণের কারণে প্রাকৃতিক যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে তা গোটা বিশ্বের মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে বায়ুতে বেড়েছে দূষণ, বেড়েছে তাপমাত্রা, বৃদ্ধি পেয়েছে রোগ-শোক এবং প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বন রক্ষা এবং বৃক্ষ রোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অথচ মহানবী (স.) বৃক্ষ বা বন রক্ষার তাগিদ দিয়ে গেছে সেই চৌদ্দশত বছর আগে। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করতে রাসূল (স.) মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিড়লে রাসূল (স.) বললেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’ বৃক্ষ রোপণকে উৎসাহিত করেছেন মহানবী (স.)। গাছ-পালা, লতা-পাতা মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। সব নবী-রাসূল প্রকৃতি ও পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি সংরক্ষণ করেছেন এবং তার অনুসারীদের উৎসাহিত করেছেন।
ইসলামে বৃক্ষরোপণ: পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষায় ও দূষণমুক্ত সবুজাভ পরিবেশ তৈরিতে বৃক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়; বরং ধর্মীয় কারণেও মানুষকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। মানবদরদি রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও তা পরিচর্যার কথা উল্লেখ করে গেছেন।
পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্যশস্য ও মৌসুমি ফলমূল উৎপাদনের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে, বৃক্ষরোপণ তন্মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন। গাছপালা দ্বারা ভূমÐল ও পরিবেশ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন