শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিক্ষা ও রাজনীতি

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

একজন মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা একটি প্রধান চাহিদা। শিক্ষা ছাড়া কোন মানুষ তার মেধা বিকশিত করতে পারে না। আর মেধা বিকশিত না হলে কোন মানুষই রাজনীতি কিংবা ব্যবসা কোন ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণভাবে সফলতা অর্জন করতে পারে না। তাই একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হতে হলে তার জীবনে শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষিত মানুষ দেশ ও জাতির সম্পদ। তার কাছ থেকে জাতি পেতে পারে দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার পরিকল্পনা। একজন শিক্ষিত মানুষ তার কর্মজীবন সঠিকভাবে গড়তে পারে। যে দেশের মানুষ যত শিক্ষিত সে দেশ তত উন্নত। একজন শিক্ষিত লোক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, রাজনীতি যেকোন কর্মে প্রবেশ করলেই তার জীবনে সফলতা আসতে পারে। কারণ সে তার মেধা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মপরিচালনা করে। তাই দেশের প্রতিটা নাগরিকের শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত কর্তব্য। দেশে যেকোন কর্ম করতে গেলে শিক্ষার প্রয়োজন লাগে। দেশের শিক্ষিত লোকেরাই দেশের ভবিষ্যত পরিকল্পনার জন্য কাজ করে থাকে। দেশ ও দেশের মানুষের সেবার মনমানসিকতা নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কারণ একজন শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তার কাছ থেকে দেশের মানুষ সঠিক দিকনির্দেশনা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। একজন সুশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা তিনি দেশের ও দেশের মানুষের কাছে অহংকার। তবে এটাও সত্য যে, দেশের সেরাজনীতিক হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন জনগণের মনের কথা বোঝা, তাদের সঙ্গে তাদের ভাষায় কথা বলা এবং তাদের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে দেয়া। ভালো রাজনীতিক হতে হলে প্রয়োজন দৃঢ়তা, মোটিভেশন, কমিটমেন্ট এবং কথা বলা ও কথা বোঝানোর দক্ষতা। পৃথিবীতে যে একশ’টি ভাষণ বিখ্যাত তার অনেকগুলোরই বক্তা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন কলেজের গÐি পেরোতে পারেননি। এমন একটি তথ্য দিয়ে লেখা শুরু করলে অনেকেই জানতে চাইবেন, হঠাৎ এ প্রসঙ্গের অবতারণা কেন? কারণ, সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, কে কী পাস করেছেন তা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। শুধু জর্জ ওয়াশিংটন নন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন আরও কিছু ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন, যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মান স্কুল পর্যায়েই সীমিত ছিল।
রাজনীতিকদের কি ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান থাকা উচিত এবং সেই সঙ্গে সৌজন্যবোধ? এ প্রশ্নের জবাবে হয়তো অনেকেই ‘হ্যাঁ’ বলবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একজন রাজনীতিকের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান করলে তা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। একজন নেতার যা থাকা প্রয়োজন তা হচ্ছে কমিটমেন্ট এবং জনগণের সমর্থন আদায়ে তার দক্ষতা। একজন নেতা জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে নির্বাচিত হন, ডিগ্রির বিনিময়ে নয়। সারা পৃথিবীতে এটি সর্বজনস্বীকৃত।
অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে নিরপেক্ষ শিক্ষা অর্জন করতে পারলে একজন রাজনীতিকের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, দলীয় রাজনীতি বুঝতে পারা সহজ হয়। আবার অনেকে মনে করেন, একজন রাজনীতিকের দেশপ্রেম না থাকলে তিনি ভালো রাজনৈতিক নেতা হতে পারবেন না। এ নিয়ে বিতর্ক সর্বত্র।
বাংলাদেশে নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে যে দুটি আবশ্যক পূর্বশর্ত রয়েছে তা হচ্ছে নাগরিকত্ব এবং পঁচিশ বছর বয়স। ফৌজদারি আদালতে দÐিত না হলে এসব যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন সংসদ সদস্যও হতে পারেন। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা তার নির্বাচনী লড়াইয়ে অলংকার হিসেবে কাজ করে, ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে নয়। তবে আর্থ-সামাজিক অবস্থা বোঝার জন্য ন্যূনতম জ্ঞান প্রয়োজন, যা একজন মানুষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে আয়ত্ত করতে পারে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আমাদের মতো দেশগুলোতে উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে সফল হতে পারেন না। রাজনৈতিক লেখাপড়া না থাকলে পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে ভালো রাজনীতিক হওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে নেই এমন নয়- কিন্তু নেতার সমর্থকরা নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার করেন না। যদি তাই হতো, তাহলে আমাদের দেশে যে দু’জন নেতা এদেশে জনচিত্তে স্থায়ী আসন গেড়েছিলেন, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব, তারা কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মানুষ ছিলেন না। এমনকি তাদের অনুসারীদের মধ্যে তাদের চেয়ে শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রিধারী অনেকেই ছিলেন। তারা কেউই এদের আসন গ্রহণ করতে পারেননি। তাজউদ্দীন আহমদ অথবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়তো পুঁথিগত বিদ্যায় বঙ্গবন্ধুর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন; কিন্তু কেউই মুজিব হতে পারেননি। এটা মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার দলের ব্যানারে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই নেতা লেনিন ও স্তালিনের চেয়ে শিক্ষায় যোগ্যতর অনেক নেতাই ছিলেন; কিন্তু তারা এ দু’জনের আসনে বসতে পারেননি। একই বিষয় প্রযোজ্য মাও সে তুংয়ের ক্ষেত্রেও। তিনি স্বশিক্ষিত মানুষ, চৌ এন লাইয়ের মতো বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। সারা পৃথিবীতে এমন অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের দুটি বড় দলেই শীর্ষ দুই নেতার চেয়ে অধিকতর আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া জানা অনেকেই আছেন, কিন্তু রাজনীতিতে তাদের সমকক্ষ দলে কেউ নেই।
আজকের প্রজন্ম যখন রাজনীতির কথা বলে, তখন তারা শিক্ষাকে ভালো নেতৃত্বের পূর্বশর্ত হিসেবে মনে করে। কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, বিলাতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। ব্রাজিলের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা নির্বাচিত হওয়ার আগে ছিলেন কারখানার শ্রমিক।
রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা পূর্বশর্ত হিসেবে আরোপ করলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিক্ষা ও প্রজ্ঞার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা উপলব্ধি না করলে এরকম পূর্বশর্তের প্রশ্ন আসতে পারে। প্রজ্ঞা না থাকলে রাজনীতিক হিসেবে সফল হওয়া যায় না। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই মানুষকে প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয় না। এটা বিধাতা প্রদত্ত এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ছিলেন স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। এটা হেনরি ফোর্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মাইক্রোসফটের বিল গেটসও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করতে পারেননি। বর্তমান পৃথিবীতে রাজনীতিকদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পূর্বশর্ত হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ আজকের রাষ্ট্রযন্ত্র অত্যন্ত জটিল। কিন্তু রাজনীতিকরা রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্তের জন্য টেকনোক্রেটের ওপর নির্ভর করেন। তারা সিদ্ধান্ত দেন বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে, যেখানে মানুষের চাহিদাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে রাজনীতিকরা টেকনোক্রেটদের সুপারিশ উপেক্ষা করে বড় ও সফল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। রাজনীতিকদের যে গুণাবলি প্রয়োজন তা হচ্ছে সততা, দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞা। এসব গুণ বই পড়ে সব সময় শেখানো যায় না। কয়েকটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বোঝার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে? উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও রাজনীতিকরা যেভাবে বেড়ে ওঠেন তাতে এসব বিষয় এমনিতেই তার আয়ত্ত হয়ে যায়।
উচ্চশিক্ষিত অথবা কম শিক্ষিত- এর সঙ্গে রাজনীতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। রাজনীতিকরা জানেন, ইংরেজি না জানলেও একজন ইংরেজিভাষীর সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা হয় না। আগে আমাদের দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে কেউ মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর সংবাদপত্রে তাদের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হতো। জাতীয় সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্তও বই আকারে প্রকাশিত হতো। এখন সেসব চোখে পড়ে না। কেন কে জানে। রাজনীতিকরা তাদের অনেক গুণের কারণেই সফল হতে পারেন। হতে পারে সেটা বাগ্মিতা, হতে পারে রাজনৈতিক কৌশলে দক্ষতা, হতে পারে জনগণকে বশীভূত করার মতো নেতৃত্ব। রাজনীতির মাঠে শিক্ষাগত যোগ্যতা বড় হয়ে দেখা দেয় না।
কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এসব বিষয় জেনেও না মেনে চলার ব্যাপারে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। রাজনীতিকরা এসব অভিযোগমুক্ত হলে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তর্ক করতে হবে না। এ দেশে রাজনীতিকরা প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার ব্যাপারে অনেক আগ্রহী, কিন্তু তারা আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন না।
নির্বাচনে একজন লোককে প্রার্থী হতে হলে তার একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা রাখার বিধান করা প্রয়োজন বলে দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। শিক্ষিত লোক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে পড়ে তার দেখানো সঠিক দিকনির্দেশনা দেশের ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল হবে। তবে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত সকল রাজনৈতিক নেতাদের দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের ও দেশের মানুষের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজ করতে হবে। একই সাথে পরবর্তী প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
নিমাই চন্দ্র দেবনাথ ১৮ জুলাই, ২০১৮, ৩:২৭ এএম says : 0
একজন রাজনীতিবিদকে অবশ্যয় রাজনীতিক দূরদর্শিতার জ্ঞান অর্জন করতে হবে; তবেই তো তিনি সফল রাজনীতিবিদ। সুশাসন ও জনকল্যাণ হবে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন