ব্যবসায়ীদের মুখের কথায় বিশ্বাস এবং মামুলি একটি চিরকুট বা স্লিপের ওপর ভরসা রাখাই ছিল যথেষ্ট। আর এতে পুরোপুরি আস্থা রেখে যুগ যুগ ধরে দৈনিক শত কোটি টাকার নিত্য ও ভোগ্যপণ্য হাতবদল হতো অনায়াসেই। এখন এতে কাজ হয় না। ব্যাংকের চেকেও ভরসা নড়বড়ে। দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসাকেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিশ্বাস অচল। কেননা প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে গা-ঢাকা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। দীর্ঘকাল চলে আসা মুখের জবান আর টিকছে না। সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাঝে আজকাল প্রচলিত খেদ-আক্ষেপের কথাটা হলো, চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিশ্বাস বাবু মরে গেছেন!
ব্যবসায়ী মহল ও পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জের এই বিশাল সওদাগরী পাড়ায় কমপক্ষে ৫৬টি আর্থিক প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ১শ’ ৮৫কোটি টাকা আত্মসাৎ কিংবা প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলতি বছরের গত জুন মাস পর্যন্ত ৬টি প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এবং এতে ১৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ অথবা আটকে যাবার ঘটনা ঘটেছে। অনেক অভিযোগের বিষয়ে সালিশী মিমাংসার জন্য সিএমপির কোতোয়ালী থানা পুলিশ দফায় দফায় বৈঠক এবং কোন কোনটিতে আপোসরফা করেছে।
তবে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোশিয়েশন সূত্র এ ব্যাপারে জানায়, চাক্তাই খাতুনগঞ্জে আর্থিক প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা মাঝেমধ্যে হয়ে থাকলেও আগের তুলনায় তা কমে এসেছে। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এদিকে নব্বইয়ের দশকে সেই রাজগড়িয়া মাড়োয়ারিরা খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন সওদাগরের টাকা তছরুপ করে রাতের আঁধারে স্বপরিবারে ভারতে পাড়ি জমানোর চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর থেকেই মূলত এখানকার বণিক-শিল্পপতিদের মাঝে বিশ্বাসে ফাঁটল ধরতে শুরু করে। এরপর একে একে অনেকেই আর্থিক প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ করে ব্যবসায়ীদের টাকা মেরে দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পালায় অথবা গা-ঢাকা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও পুলিশি মধ্যস্থতায় আত্মসাতকৃত বা আটকে যাওয়া টাকা উদ্ধার হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের ফতুর হয়ে পথে বসতে হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে খাতুনগঞ্জে অবিশ্বাসের ছায়া যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বেড়ে গেছে সন্দেহ প্রবণতা। সবচেয়ে বড় অবিশ্বাসের কারণ হলো, গুটিকয়েক ব্রিফকেস সর্বস্ব ব্যবসায়ীর আনাগোনায় প্রকৃত ও বনেদী ব্যবসায়ীরা লেনদেন ও পণ্যের হাতবদলে সন্দেহ-সংশয়মুক্ত ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। তাছাড়া ব্যাংকে চেক প্রতারণার ঘটনাও বেড়ে গেছে। বিস্তীর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যপাড়া চাক্তাই খাতুনগঞ্জে রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অর্ধশত শাখা। ব্যাংক পাড়ায়ও বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপ তাদের প্রধান অফিস আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় গুটিয়ে নিয়ে গেছে। আবার অনেকে মূল নিত্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং ইন্ডেন্টিং ব্যবসায় থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভিন্ন ব্যবসায় কিংবা শিল্পখাতে। এরফলে খাতুনগঞ্জে এখন ‘জাত’ ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে মন্দাদশা।
হরেক ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি, ইন্ডেন্টিং বাজার শতবর্ষের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ-আছদগঞ্জ। এটি সুপ্রাচীনকাল হতেই দেশের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল সওদাগরী পাড়া। যেখানে দৈনিক ১২শ’ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন ও পণ্যসামগ্রী হাতবদল ছাড়াও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। খাতুনগঞ্জের নিছক মুখের কথায় ভরসা রেখে প্রথাগত পুঁজিকেই টাকার পুঁজির চেয়ে বড় করে দেখা হয়। যার ভিত্তি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাসেই এখন আস্থা কম। প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিশাল এলাকা নিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে। এখান থেকেই ব্যবসা শুরু করে আজ জাতীয় পর্যায়ে রয়েছে অনেকগুলো আমদানি-রফতানিকারক, বণিক ও শিল্পগ্রুপ।
তবে পুরনো সওদাগরী পাড়া চাক্তাই গড়ে ওঠে আরও পূর্বে। সম্রাট বাবরের শাসনামলে পালতোলা জাহাজ নিয়ে আরব, পারস্য ও মধ্য-এশিয়ার সওদাগররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপদ পোতাশ্রয় দিয়ে আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। তখন তুর্কী বণিকগণ চট্টগ্রামের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাদের অন্যতম তুরস্কের প্রাচীন, চৌকস, বনেদী ব্যবসায়ী ‘চুগতাই’ বণিকশ্রেণি। তাদের নাম ও খ্যাতি বহন করছে আজকের চাক্তাই বা চাক্তাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন