শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইমামুল হাদিস আবু ঈসা মুহাম্মদ তিরমিজি রহ.

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

যুগে যুগে যারা প্রিয়নবী (সা.)- এর হাদিসের আঞ্জাম দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হচ্ছেন ইমাম তিরমিজি (রহ.)। কর্মজীবনে মুসলিম উম্মাহর জন্যে যে খেদমত তিনি করেছেন, তাতে মুসলিম জাতি তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে অনন্তকাল। এই মহান ব্যক্তির আসল নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু ঈসা। পূর্ণনাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে সারওয়াহ ইবনে মুসা ইবনে দাহহাক ইবনে তিরমিজি। ইমাম তিরমিজি নামেই তিনি পরিচিত, নন্দিত।
খলিফা আবদুল্লাহ আল মামুনের যুগে হাদিসবিদ ইমাম তিরমিজি (রহ.) মধ্য এশিয়া ট্রান্স অক্সিয়ানার পাশে জীহুন নদীর বেলাভূমে অবস্থিত ‘তিরমিজ’ নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরি সনে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকাল নিজ জন্মস্থানেই অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই কুরআন, তাজবিদ, ফিকহ, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বাল্যকালেই হাদিস শ্রবণ এবং হাদিস সংগ্রহ করার প্রতি তার ছিলো প্রবল আগ্রহ। তাই তিনি হাদিস শিক্ষার জন্যে খুরাসানের নিশাপুরে এরপর সমরকন্দ, কুফা, বাসরা, হিজাজ ও বাগদাদে খ্যাতনামা মুহাদ্দিসদের কাছে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) যে সকল মুহাদ্দিস-এর কাছে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন, ইমাম বোখারি (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.), ইমাম আবু দাউদ (রহ.), হজরত কুতাইবা ইবনে সাইদ (রহ.), ইসহাক ইবনে মুসা (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে গাইলান (রহ.), সাইদ ইবনে আবদুর রহমান (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে বাশশার (রহ.), আলী ইবনে হাজার (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না (রহ.), সুফিয়ান ইবনে ওয়াকী (রহ.), আহমদ ইবনে মানী (রহ.) প্রমুখ। (আল হাদিস ওয়াল মুহাদ্দিসুন: ৩৬০)।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) তীক্ষè মেধা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি হাদিস একবার শুনেই তা পুনরায় হুবহু শোনাতে পারতেন। তার উস্তাদগণ পাঠদানের সময় তার কাছ থেকেও উপকৃত হতেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম বোখারি (রহ.) বলেন, ‘ইসতাফাদতু মিনকা মা লাম তাসতাফিদু মিন্নি’ অর্থাৎ আমি তোমার কাছ থেকে যতোটা উপকৃত হয়েছি, তুমি আমার থেকে ততটা উপকৃত হতে পারনি।
ইমাম তিরমিজি (রহ.)-এর মুখস্থ শক্তির একটি চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে। একবার জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েকটি হাদিসাংশ তিনি শ্রবণ করেছিলেন। কিন্তু সে মুহাদ্দিসের সঙ্গে আর কোনোদিন সাক্ষাত হয়নি। ফলে তিনি মনে মনে সে মুহাদ্দিসের সন্ধানে উদগ্রীব ছিলেন। একদিন পথিমধ্যে তার সাক্ষাত পেয়ে তার কাছ থেকে পুরো হাদিস শোনার বাসনা প্রকাশ করলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি পুরো হাদিস পথিমধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় শুনিয়ে দিলেন। ইমাম তিরমিজি তা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই মুখস্থ করে ফেললেন। তা দেখে সেই মুহাদ্দিস বড়ই বিস্মিত হন। ইমাম তিরমিজি (রহ.)-এর স্মরণশক্তি পরীক্ষা করার জন্য তিনি আরও চল্লিশটি বিশেষ হাদিস পাঠ করেন। ইমাম তিরমিজি (রহ.) ইতিপূর্বে এই হাদিসগুলো কোনোদিন শুনেননি, তা সত্ত্বে ও মাত্র একবার শুনে সম্পূর্ণ মুখস্থ হাদিসগুলো তাকে শুনিয়ে দিলেন, এতে একটি শব্দও ভুল হয়নি। (মুকদ্দমায়ে তরজুমানুস সুন্নাহ: ১/২৬১)।
ইমাম তিরমিজি পুরো কর্মজীবন হাদিস শিক্ষাদানে কাটান। ইমাম বোখারি (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর খুরাসানে তার সমকক্ষ আর কোনো হাদিসবিদ ছিলেন না। হাদিস অধ্যয়নের জন্য খুরাসান ও তুর্কিস্তান ও অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ তার কাছে হাদিস শিক্ষার জন্য আসতেন। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, আবু আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.), হাইসাব ইবনে কুলাইব (রহ.), আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে আহমদ (রহ.), আহমদ ইবনে ইউসুফ নসফি (রহ.), আবদ ইবনে মুহাম্মদ (রহ.) এবং আবু দাউদ ইবনে নসর (রহ.) প্রমুখ।
ইমাম তিরমিজি (রহ.)-এর মাজহাব সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। আল্লামা কাশ্মিরী (রহ.) তার ফয়জুল বারী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইমাম তিরমিজি (রহ.) শাফিই মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।’ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) বলেন, ‘তিনি একজন মুজতাহিদ; যদিও তাকে ইমাম আহমদ ইবিনে হাম্বল ও ইসহাক ইবনে রাহওয়াই-এর মাজহাবের অনুসারী বলা হয়।’ আল্লামা জাহবী বলেছেন, ‘ইমাম তিরমিজি মুজতাহিদ ছিলেন’ (তাজকিরাতুল মুহাদ্দিসিন: ১/৩২২)।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও পরহেজগার ব্যক্তি এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ইবাদতে কাটাতেন এবং আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কাঁদতেন। এমনকি আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে শেষ বয়সে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। (বুসতানুল মুহাদ্দিসিন: ১৮৫)। ইমাম বোখারি (রহ.) তার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তাকে ইমাম বোখারির খলিফা বলেও উল্লেখ করেছেন। ইমাম বোখারি (রহ.) নিজেও ইমাম তিরমিজি (রহ.) থেকে হাদিস গ্রহণ করেছেন এবং বর্ণনাও করেছেন। (মুকদ্দমায়ে তরজুমানুস সুন্নাহ: ১/২৬১)।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) ছাত্রদের পাঠদানের পাশাপাশি অনেক গ্রন্থও রচনা করেছেন। তার গ্রন্থগুলো মধ্যে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে, জামে তিরমিজি, শামায়েলে তিরমিজি, কিতাবুল ইলাল, কিতাবুত তারিখ, কিতাবুল আসমা ওয়াল কুনা, আল ইলালুল কুবরা, আল ইলালুস সুগরা, কিতাবুল মুফরাদ, কিতাবুল জুহদ ইত্যাদি। তার গ্রন্তগুলোর মধ্যে সহিহ তিরমিজি অন্যতম গ্রন্থ। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ দুটি জামে হাদিস গ্রন্থের মধ্যে একটি। কতিপয় মুহাদ্দিস গ্রন্থটিকে ‘সুনান’ বললেও বেশিরভাগ মুহাদ্দিস ‘জামে’ নামে গ্রহণ করেছেন। গ্রন্থটিতে ৩৮১২টি হাদিস সংকলিত হয়েছে। হাদিসগুলো ৪৬টি অধ্যায় এবং ২৪১৪ টি পরিচ্ছদে সাজানো হয়েছে।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) প্রণীত ‘জামে তিরমিজি’ গ্রন্থটি অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন: ১. প্রতিটি হাদিসের বর্ণনা শেষে বিভিন্ন মাজহাবের ইখতিলাফ (মতভেদ) এবং এর সমর্থনে প্রমাণ উল্লেখ হয়েছে। ২. এ গ্রন্থটি সুসজ্জিত এবং হাদিসগুলো সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত। ৩. পুনরুল্লিখ হাদিসের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ৪. হাদিসের প্রকারভেদ সহিহ, হাসান, জইফ, গরিব ও মুআল্লাল প্রভৃতির স্তর নির্দেশিত হয়েছে। ৫. রাবী বা হাদিস বর্ণনাকারীদের নাম, উপনাম, উপাধি এবং চরিত্র সম্পর্কে বহু তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। ৬. কোনো জটিল শব্দ প্রয়োগ হলে তার ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। ৭. কোনো হাদিসের সনদ বা মতনের মধ্যে সন্দেহ হলে তা পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ৮. ‘সুনান’ শাস্ত্রের মতো ফিকহ শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী তাহারাত, সালাত, জাকাত, সাওম প্রভৃতি বিষয় ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ৯. প্রতিটি হাদিসের মূল বর্ণনাকারী হতে শেষ বর্ণনাকারী পর্যন্ত বর্ণনা-শৃঙ্খলে প্রত্যেকের নাম সনদে উল্লেখ করা হয়েছে। ১০. প্রতিটি হাদিস বর্ণনাকারীর পর এর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য দেয়া হয়েছে। জামে তিরমিজির বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) বলেছেন, ‘হাদিসের জ্ঞান-সাধকদের জন্যে ইমাম তিরমিজি (রহ.) তার হাদিস গ্রন্থে প্রয়োজনীয় কিছুই বাদ রাখেননি। এই জন্যই বলা হয়, জামে তিরমিজি মুজতাহিদ ও মুকাল্লিদ উভয়ের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট।
ইমাম তিরমিজি (রহ.)-এর গ্রন্থগুলো মধ্যে আরেকটি অন্যতম গ্রন্থ হচ্ছে, ‘শামায়েলে তিরমিজি’। এ গ্রন্থে রাসুল (সা.)-এর ব্যক্তিজীবন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আচার-আচারণ এবং পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কিত চারশ’ হাদিস সন্নিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থটি মোট ৫৬টি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রিয়নবী (সা.)-এর সার্বিক জীবনের পুরো চিত্রটি ফুটে ওঠেছে। ইমাম তিরমিজির অন্য একটি গ্রন্থ হচ্ছে, ‘কিতাবুল ইলাল’। এ গ্রন্থে হাদিসের অন্তর্নিহিত সূ²তা দোষ-ত্রুটিগুলো নিরূপণ করা হয়েছে। এতে ইমাম তিরমিজি (রহ.)-এর গভীর জ্ঞান ও তীক্ষ বিচার-বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) দীর্ঘকাল হাদিস চর্চা করে ৭০ বছর বয়সে ২৭৯ হিজরিতে ১৩ রজব সোমবার তিরমিজ নামক শহরে ইন্তেকাল করেন। ইমাম তিরমিজি (রহ.) তার নিরলস প্রচেষ্টায় হাদিস শাস্ত্রে যে অবদান রেখেছেন, তাতে তিনি সারা মুসলিম বিশ্বজুড়ে খ্যাতির অধিকারী হয়ে আছেন আজও অবধি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন