বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে দুর্নীতির রাজত্ব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন চলছে এখন? সরকারী দল নিশ্চয়ই বলবেন, ভাল চলছে। কিন্তু বাস্তবতা কী প্রমাণ করে? গত মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল : “বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি: লুটপাটের রাজত্ব”। উপ-শিরোনামে বলা হয়েছে : কয়লার পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার মালামাল লোপাট : দুদকের প্রাথমিক তদন্তে ২৩০ কোটি টাকার কয়লা চুরির সত্যতা। প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট চিত্রের নীচে বলা হয়েছে : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ইয়ার্ড। এখানে কয়লার স্তুূপ লেগে থাকার কথা। কিন্তু কয়লা চোরেরা মাটি চেছে কয়লা নিয়ে গেছে।
দৈনিক ইনকিলাব গত মঙ্গলবারে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে লুটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। গত এক দশকে লুটপাট হয়েছে শত শত কোটি টাকা। সর্বশেষ ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুতের সংকটে পড়ে উত্তরের ৮ জেলা। চাঞ্চল্যকর কয়লা চুরির ঘটনায় পেট্রোবাংলা তাৎক্ষণিকভাবে খনির ব্যবস্থাপকসহ ৪ জনকে প্রত্যাহার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। গতকাল সোমবার দুদকের একটি টিম প্রাথমিক তদন্তে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খোয়া যাওয়ার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোন ডিও ছাড়া খনি থেকে বের হয়ে যায় ৩শ’ মেট্রিক টন কয়লা। আশ্চর্যজনক হলেও যে বা যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের খুঁজে বের না করে বা কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই খোয়া যাওয়া কয়লার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়া হয়। কে বা কারা এই কয়লা চুরি করেছিল বা গেট থেকে ট্রাকভর্তি কয়লা কিভাবে বের হলো তার কোন হদিস আজো পাওয়া যায়নি। এর আগেও ২০০৮ সালে ২ কোটি ৯ লাখ টাকার তামা চুরি হয়। মামলা করা হয় এক সাধারণ শ্রমিকের বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে সে বেকসুর খালাস পেলেও উদ্ধার হয়নি চুরি হওয়া তামা। এভাবে আরো কত কোটি টাকার মালামাল চুরি হয়েছে তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।
বড় পুকুরিয়া এলাকায় গেলে এসব পুকুর চুরির ঘটনা অকপটে স্বীকার করে খনির কর্মকর্তা, শ্রমিক ও এলাকাবাসী। তাদের মতে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সদস্য দলীয় বিবেচনায় মন্ত্রী, এমপি, জ্বালানী বা খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পেট্রোবাংলার পদস্থ কর্মকর্তা বরং খনির কতিপয় কর্মকর্তা। সিন্ডিকেট কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ডিও ও বিশেষ ডিওর মাধ্যমে ফরিয়াদের নিকট কয়লা বিক্রি করে। বিনিময়ে আয় করে লাখো লাখো টাকা কমিশন।
সূত্র জানায়, নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাপ বিদ্যুৎ চালু রাখার জন্য দুই লাখ মেট্রিকটন কয়লা মওজুদ রেখে ফড়িয়া ও ব্যবহারকারীদের কাছে কয়লা বিক্রি করতে পারে খনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাজারে কয়লার ব্যাপক চাহিদার কারণে অতিরিক্ত মূল্যে ডিও বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়েছে। অপর একটি সূত্র মতে, গত মার্চ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের ধারাবাহিকতা এবং মজুদ পরিমাণকে বিবেচনায় না রেখে কয়লা বিক্রি করা হয়।
এদিকে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় না থাকায় বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে বড় পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ গত জুন মাসেই চাহিদা মত কয়লা সরবরাহ সম্ভব নয় বলে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে জানিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট। খুঁড়িয়ে খুঁুঁড়িয়ে চলতে থাকে ২৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিটটি। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো: হাকীম সরকার জানান, শেষের দিকে বড়পুকুরিয়া থেকে যে কয়লা সরবরাহ করা হয়, তার মধ্যে কয়লার চেয়ে পাথর ও আবর্জনাই বেশী ছিল। এসব কয়লা বাছাই করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সচল রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত ২২ জুলাই রাত ১০টা ২০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন। লক্ষণীয় বিষয় যে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা কয়লা চুরি করতে করতে ময়লা স্তূপের মাটিকেও ছাড়েনি। ফলে নিজেদের বাঁচাতে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ময়লা আবর্জনাসহ কয়লা সরবরাহ করতে থাকে।
অপরদিকে কয়লা উৎপাদনকারী চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি এবং কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ বেশী দেখিয়ে কমিশন বাণিজ্য করারও অভিযোগ উঠেছে খনি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন খনি শ্রমিক ইনকিলাব এর প্রতিবেদককে জানান, প্রতিটন কয়লা উত্তোলন করার বিনিময়ে সিএমসি কোম্পানী ১৭ ডলার পেয়ে থাকে, এ কারণে সিএমসি কোম্পানী প্রতিদিন ৪ হাজার টন কয়লা উত্তোলন করলেও এর পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার টন দেখিয়ে ৫শ টন কয়লা উত্তোলনের ৫শ টন কয়লা উত্তোলনের টাকা পকেটস্থ করে খনি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, কোল্ড মাইনিং কোম্পানীটি ১৯৭৮ সালে বড়পুকুরিয়া বাজারে একটি গভীর সেচ পাম্প বসাতে গিয়ে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯২ সালে চীন কোম্পানী সিএমসির সাথে চুক্তি, ১৯৯৪ সালে বাস্তবায়নের কাজ শুরু এবং ২০০৬ সালে খনিটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। ২০০৮ সালের শেষে এসে খনিটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার হস্তক্ষেপে দলীয় বিবেচনায় খনি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদবঞ্চিত এবং দলীয় বিবেচনায় কয়লার ডিও ফড়িয়াদের হাতে দেয়া শুরু হয়। এতে করে ধীরে ধীরে খনিটি একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। আমদানিকৃত নি¤œমানের কয়লার সাথে বড়পুকুরিয়া কয়লা মিশ্রিত করে বিক্রি শুরু করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকার ডিও জমা দিয়ে হাজার হাজার টন কয়লা কিনে নিতে থাকে একটি চক্র। এদের সাথেই যোগসাজসে বের হয়ে যায় হাজার হাজার টন কয়লা।
বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির পরম সম্ভাবনায় ভবিষ্যৎ কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল, তার পেছনে যে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলই ছিল প্রধান কারণ, তা বুঝতে পাঠক মহলের আর বাকী নেই। কোন দেশে যখন এমন কোন দল ক্ষমতায় আসীন হয় যাদের কাছে দেশের চাইতেও দলীয় বিবেচনাই অধিক গুরুত্ব লাভ করে তখন এমনটা হওয়াই অবশ্যম্ভাবী। দু:খের বিষয়, আমরা বর্তমানে এমন এক দলীয় সরকারের শাসনাধীন আছি, যাদের কাছে দেশের চাইতে দলীয় স্বার্থ অনেক বেশী গুরুত্ব পায়। তবে হ্যাঁ, এ সরকারের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থের চাইতেও আরেকটি দেশের স্বার্থও যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে থাকে, যে দেশটি বাংলাদেশের বর্তমান শাসক দলের ন্যায় অন্যায় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে তাদের প্রতি সমর্থন দানে সদা প্রস্তুত থাকে। এর প্রধান কারণ সে দেশটির নেতৃত্ব তার মাধ্যমে তাদের দেশের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার কথা কখনও কল্পনা করে না, যা আমাদের বর্তমান শাসক দল ইচ্ছায় না অনিচ্ছায় সে দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে সদা প্রস্তুত থাকে।
আজকের আলোচনায় ইতি টানার আগে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের প্রতি একটা আহŸান জানাতে চাই। তা হচ্ছে দেশের স্বার্থ বা সার্বভৌমত্বকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের বর্তমান শাসকদলের বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী সম্বন্ধে সদা সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশের অনেকেই মনে করেন, প্রতিবেশী দেশের নেতৃত্ব বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপূর্ণ কারণ তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। এ ধারণা অবাস্তব। কারণ তারা কখনও উপমহাদেশের মুসলিমঅধূষিত পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ নামের একটি প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে উঠুক তা চান না। ইতোমধ্যেই তাদের কোন কোন নেতা এ অভিমত প্রকাশ করে ফেলেছেন যে একাত্তরে ভারতের উচিৎ ছিল বাংলাদেশকে দখল করে নেয়া। এটা আর যাই হোক, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের আস্থার প্রমাণ বহন করে না।
প্রতিবেশী দেশ ভারত কখনও উপমহাদেশে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ওঠা পছন্দ করতো না। ১৯৪৭ সালে তারা যে দেশ বিভাগে রাজী হয় তা ছিল তদানীন্তন পরিস্থিতির চাপে। তবে সব সময় তাদের স্বপ্ন ছিল উপমহাদেশ পুনরায় তাদের নেতৃত্বে এক রাষ্ট্র পরিণত হবে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে আমাদের সদা-সচেতন থাকার কোন বিকল্প নেই, থাকতে পারে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন