নড়াইল সদর ও লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ চুল্লিতে অবাধে কাঠ পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে কয়লা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বিভিন্ন বনজ ও ফলজ গাছ কেটে এখানে কাঠ সরবরাহ করা হয়। জেলার সদর উপজেলার আউড়িয়া ও বাঁশগ্রাম ইউনিয়ন এবং লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি স্থানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫টি কয়লা তৈরির বিশেষ ধরনের চুলা। এতে একদিকে, যেমন বনজ সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, পাশাপাশি সৃষ্ট ধোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে শ্বাসজনিত নানা ব্যাধি। অপরদিকে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সদর উপজেলার বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের শালিখা গ্রামের আ. ছালাম শেখের ছেলে লাবলু শেখ ও তার সহোদর যৌথভাবে চারটি কয়লা তৈরির চুলা নিয়ন্ত্রণ করেন। একই উপজেলার আউড়িয়া ইউনিয়নের দত্তপাড়া এলাকায় ৯টি কয়লা তৈরির চুলা নিয়ন্ত্রণ করেন মশিউর রহমান ও তার জামাই শিবু খন্দকার। এ ছাড়া লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের সারুলিয়া গ্রামে আরও ৫টি চুলাসহ জেলার প্রায় ২৫টি চুলায় কাঠ পোড়ানোর খবর পাওয়া গেছে।
আরো জানা গেছে, গোয়াল বাতান গ্রামের আবু তালেবের ছেলে শিবু খন্দকার ও তার শ্বশুর মশিউর রহমানসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ওই পাঁচটি চুলা নিয়ন্ত্রণ করেন।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব কয়লার কারখানায় দেদার পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এসব কয়লা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বিধিনিষেধ থাকার পরও জনবসতি এলাকায় ও ফসলি জমি নষ্ট করে এসব কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। শক্ত কাঁচা লাল মাটি, ইট ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা চুল্লিতে শতশত মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
কয়লা শ্রমিকরা জানান, চুল্লির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে কাঠ সাজিয়ে একটি মুখ খোলা রেখে অন্য মুখগুলো মাটি এবং ইট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। খোলা মুখ দিয়ে আগুন দেয়া হয় চুল্লিতে। আগুন দেয়া শেষ হলে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়েকদিন পোড়ানোর পর চুলা থেকে কয়লা বের করা হয়।
প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ২৫০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। কাঠ পুড়ে কয়লা হতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। পরে কয়লা ঠান্ডা করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চটের বস্তায় ভরে ট্রাক, পিকাপ, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান করা হয়।
শালিখা গ্রামের চুলার মালিক অবৈধ কয়লা ব্যবসায়ী লাবলু শেখ বলেন, ‘কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি অবৈধ হলেও কিছু করার নেই। এ ব্যবসায় অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ হয়। তাই এ ব্যবসা করে যাচ্ছি।’
দত্তপাড়া এলাকায় কয়লা তৈরির চুলার মালিক পাইকমারি গ্রামের মৃত আবুল হোসেন শেখের ছেলে মশিউর রহমান বলেন, ‘আগে কাঠের ব্যবসা করতাম। বর্তমানে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরিতে ব্যবসা ভালো হচ্ছে। তাই ৯টি চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করছি।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একটি চুল্লিতে এক সপ্তাহে কমপক্ষে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতি বস্তা কয়লা ৩৫০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে শত শত টন কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
ভূক্তভোগীরা জানান, কয়লা তৈরির চুল্লির কালো ধোঁয়ায় শিশুসহ এলাকার মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্রও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। বিভিন্ন গাছপালায় মড়ক দেখা দিয়েছে। নিয়মিত এই বিশাল পরিমাণের গাছ, গাছের গুড়ি পুড়িয়ে কয়লা বানানোর ফলে খুবই দ্রুতই ওই এলাকায় অক্সিজেন ঘাটতিসহ নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাই বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সচেতন এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে অবগত হয়েও কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না।
নড়াইল সিভিল সার্জন ডা. মো. আসাদ-উজ-জামান মুন্সী বলেন, ‘কয়লা তৈরিতে কাঁচা কাঠ পোড়ানোয় কার্বন ও সিসা নির্গত হয়। যে এলাকায় এসব চুলায় কাঠ পুড়িয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানে নিশ্চিতভাবে শিশু জন্মগতভাবেই ফুসফুসের সমস্যা নিয়েই জন্ম নেবে। এ ছাড়া এসব চুল্লির ধোঁয়ায় মানুষের অ্যাজমা সমস্যা, ফুসফুসের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ও এলার্জির সমস্যা এবং চোখের সমস্যাসহ নানাবিধ রোগ হতে পারে।’
দত্তপাড়া গ্রামের স্কুলছাত্র হাসান শেখ ও বিপ্লব জানান, ‘চুল্লির ধোঁয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করে, খুশখুশে কাশি হয়। সন্ধ্যায় প্রচন্ড গন্ধে পড়াশোনা করা যায় না।’
এ প্রসঙ্গে নড়াইল জেলা প্রশাসক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির বিষয়টির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমার কাছে ছিল না। তবে সরকারি অনুমোদন ছাড়া কয়লার কারখানা স্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্ত সাপেক্ষে অবৈধ কয়লার কারখানা বন্ধসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন