বিদায় হিজরি ১৪৩৯, শুভাগমন ১৪৪০ হিজরির। মুসলমানদের বড় বড় ইবাদত যেমন- আশুরা, শবে বরাত, শবে কদর, রোযা, ফিৎরা, ঈদ, হজ, যাকাত ইত্যাদি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই প্রকৃত ইবাদতকারীদের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন বছরের শুরুর সময়টার গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। অনেকে আমরা জানিও না যে, হিজরি নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়ত বা হিজরিবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাসও জানেন না। হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না।
হিজরি সন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা মোহাম্মদ (সা.)কে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রাসূল (সা.)-এর ত্যাগের ঐতিহাসিক স্মারক হিজরি সন। বছর ঘুরে এই দিনটি এসে আমাদেরকে মোহাম্মদ (সা) ও তাঁর সহচরবৃন্দের হৃদয়বিদারক কষ্ট বেদনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বাড়ি, পরিবেশ, পরিবার, সম্পদ, স্বজনসহ নিজ শহর ছেড়ে সুদূর মদিনার পথে রওয়ানা হয়ে সে সময় কী অসাধারণ ত্যাগেরই না পরিচয় দিয়েছিলেন তারা।
হিজরি সনের ইতিকথা : দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন ওমর (রা.)’র খিলাফতকালে আবু মুছা আশয়ারি (রা) ছিলেন ইরাক ও কুফার গভর্নর। তিনি খলিফার কাছে আবেদন পাঠালেন, রাষ্ট্রীয় ফরমান এবং দিকনির্দেশনায় কোনো সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় এটা কোন দিনের আদেশনামা অবগত হওয়া যায় না। ফলে তা কার্যকর করতে জটিলতায় পড়তে হয়। খলিফার দরবারে পত্র পৌঁছলে তিনি তা পড়ে অনুধাবন করলেন, আবু মুছা আশয়ারি আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ওমর (রা) বিলম্ব না করে সাহাবিদের নিয়ে মজলিসে শূরা গঠন করে মুসলিম জাতির সুবিধার্থে একটি ইসলামি সন-তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজনের বিষয়টি উত্থাপন করলেন। সবাই এতে সম্মতি দিলেন, কেউ বললেন, প্রিয় নবী (সা) আবির্ভাবের মাস থেকে, কেউ ইন্তেকালের মাস থেকে, কারো কারো মত ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির মাস থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হোক। ওসমান ও আলি (রা.), ওমর (রা) এর কথার প্রতি সমর্থন করে বললেন, আমাদের হিজরি সন স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া জরুরি। তাই ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত ও ঐতিহাসিক ঘটনা হিজরতের সময় থেকে এর গণনা শুরু হোক। ওমর (রা.)সহ সবার কাছে প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় এবং ব্যাপক সাড়া পায়।
হিজরত ছিল মুসলমানদের গৌরবময় অভিযাত্রার এক বিপ্লবী অধ্যায়। এই হিজরতের মধ্য দিয়েই নিগৃহীত, নির্যাতিত উম্মতে মুহাম্মদি (সা) একটি আত্মপ্রতিষ্ঠিত জাতিতে পরিণত হতে পেরেছিল। নবীজী (সা) নবুওত পরবর্তী ১৩ বৎসর মক্কায় ইসলামের প্রতি মানুষকে ডেকে যান। প্রাথমিকভাবে নিজ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে ইসলামের পথে আহবান করার জন্য নির্দেশিত হন। সে মতে প্রথমদিকে স্ত্রী খাদিজা, ভাতিজা আলি, বন্ধু আবু বকর (রা) এবং পরে আরো অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তাদের প্রতি মক্কার কাফির-মুশরিকদের নির্যাতনও বেড়ে যেতে থাকে। নবীজী (সা) নিজেও অনেকবার নির্যাতিত হন, কিন্তু উম্মতের প্রতি তাঁর প্রবল মমতার কারণে তিনি সবকিছু সয়ে গিয়েছিলেন। তায়েফে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হওয়ার পর জিব্রাইল (আ) যখন তায়েফকে উল্টিয়ে ধংস করে ফেলার অনুমতি চেয়েছিলেন, তখন নবীজী (সা) তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা তো অবুঝ। বুঝলে নিশ্চয় তারা এমনটি করত না আল্লাহ আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন।’ কিন্তু তাঁর সহচরবৃন্দের প্রতি অমানবিক নির্যাতন তার জন্য মহাকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আল্লাহর অনুমতিতে প্রথমে হাবশায় এবং পরে মদিনায় সাহাবিদের হিজরত করার নির্দেশ দেন।
সাহাবায়ে কিরাম একজন-দু’জন করে মদিনায় চলে যেতে থাকেন। এরই ভেতর আরো অনেক নির্যাতনের খবর আসতে থাকে। কাফিররা দাওয়াতকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। তাদেরকে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার, এমনকি হত্যা করার চক্রান্ত করা হয়েছে। কাফিররা অনেককে সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে মক্কা ত্যাগ করার অনুমতি দেয়। এভাবে বহু সাহাবি নিজ ঘর, এলাকা, সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে সবকিছু ছেড়ে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন।
রাসূল (সা) ও আবু বকর (রা) একসাথে রওয়ানা হন। রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজী বললেন, ‘হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার আল্লাহর কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিতো, আমি কখনো বের হতাম না (তিরমিযী)।
এদিকে রাসূলকে (সা) জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য ১০০ উট পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। মক্কার দুর্দান্ত কাফের ঘোড়সওয়াররা বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায়। রাসূল (সা) ও আবু বকর (রা) কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য করে সাওর গুহার আশ্রয় নেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় গুহার কাছে গিয়েও না পেয়ে ফিরে আসে কাফেররা। গুহা থেকে মদিনার পথে রওয়ানা হওয়ার সময় সুরাকা বিন মালেক অনেক কাছে চলে আসে। আবু বকর (রা) ভয় পেয়ে যান। কিন্তু নবীজী (সা) নির্ভয়ে বলেন, ‘ভয় পেও না, আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন’। সুরাকা কয়েকবার ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। কাছে এসে সে নবীজীকে (সা) ধরার পরিবর্তে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যায়। পরবর্তীকালে হুনায়ন যুদ্ধের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
এভাবে শত প্রতিকুলতা কাটিয়ে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার, মদিনার কুবা নামক গ্রামে পৌঁছান। মদিনার শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বছর ঘুরে হিজরি সন এসে আমাদেরকে সাহাবাদের সেই ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। রাসূল (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের সময় ছিল রবিউল আউয়াল মাস। কিন্তু তা সত্তে¡ও মাসের ধারাবাহিকতা ও সার্বিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মহররমকেই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়।
রাসূল (সা.)-এর মদিনায় আগমনের সাথে সাথেই মদিনার মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের অপরিমেয় মান, খ্যাতি, ধারাবাহিক সাফল্য ও বিজয় বয়ে আনায় প্রিয়নবী (সা.)-এর সাহাবিরা বুঝেছিলেন এই হিজরতের মর্ম ও গুরুত্ব। সুতরাং তাঁর এই ঐতিহাসিক হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা) হিজরি সালের প্রবর্তন করে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন