বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কিডনি উধাও হওয়ার ভয়ঙ্কর ঘটনা

| প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

রওশন আরা নামের এক মহিলার প্রায় অকার্যকর একটি কিডনি অপারেশন করে ফেলে দেওয়ায় পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, তার অপর সুস্থ কিডনিটিও নেই। কিডনি উধাও হয়ে যাওয়ার এ ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছে। যিনি অপারেশন করেছিলেন, ইউরোলজি বিভাগের সেই চিকিৎসক অধ্যাপক হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, তিনি একটি কিডনিই অপারেশন করেছেন, দুটি নয়। অবশ্যই কিডনি আছে। কিন্তু সিটি স্ক্যানে মহিলার পেটে কোনো কিডনির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, কিডনি থাকলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দৃশ্যযোগ্য হবেই। মহিলার ছেলে রফিক শিকদার অভিযোগ করেছেন, তার মায়ের একটি কিডনি ফেলতে গিয়ে দুটি কিডনিই ফেলে দিয়েছেন চিকিৎসক। রওশন আরার অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। তার গা-হাত-পা ফুলে গেছে। পেশাব বন্ধ হয়ে গেছে। পেশাব তৈরিই হচ্ছে না। ডায়ালসিসের মাধ্যমে কোনো রকমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। রফিক শিকদার তার মায়ের সুচিকিৎসা এবং কথিত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে কিডনি ফাউন্ডশেনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হারুন অর রশিদকে।
অসুস্থ মানুষ সুচিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চিকিৎসকের অসর্তকতা, অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর দৈহিক বিপর্যয় ঘটে, এমন কি তার মৃত্যুও হয়। কিডনির জটিলতা বা রোগ এরূপ যে, একটু এদিক-সেদিক হলেই রোগীর জীবন-সংশয় হতে পারে। কিডনি দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এজন্যে একটির বদলে দুটি কিডনি থাকে। চিকিৎসদের মতে, একটি কিডনি দিয়েই কাজ চলতে পারে। তবে কোনো কারণে সেটি অকার্যকর বা নষ্ট হয়ে গেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সেকারণে দুটি কিডনি দিয়েছেন আল্লাহপাক, যাতে একটি নষ্ট হয়ে গেলেও অন্যটি দিয়ে কাজ চলে। রওশন আরা ও তার পরিবারকে বুঝানো হয়েছিল, একটি কিডনি ফেলে দিলে কিছু হবে না। চিকিৎসকের কথায় আস্থা রেখে এখন রওশন আরার জীবন বিপন্ন। চিকিৎসদের মতে, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অসর্তকতার কারণেই এই দুর্ঘট ঘটেছে। আগে থেকে সতর্ক হলে এরূপ ঘটনা হয়তো ঘটতো না। জানা যায়, রওশন আরা ঘোড়ার খুরাকৃতির জোড়া কিডনি নিয়ে জন্মান। সাধারণত এ ধরনের কিডনির ক্ষেত্রে কোনো একটি কেটে ফেলতে হলে দুটিই কেটে ফেলতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরই এটি সবচেয়ে ভালো জানার কথা। তার উচিৎ ছিল, এটা রোগিনীর স্বজনদের জানানো এবং তারা রাজি হলে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি রাখা বা প্রতিস্থাপন করা। এটা তিনি করেননি এবং একটি কিডনি কেটে ফেলতে গিয়ে দুটিই কেটে ফেলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি এখন স্বীকার করতে না চাইলেও তদন্ত কমিটির তদন্তে অবশ্যই সেটা বেরিয়ে আসবে।
চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু আমাদের দেশে অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জুন পর্যন্ত দু’বছরে ভুল চিকিৎসায় ও ভুয়া ডাক্তারের শিকার হয়ে সারাদেশে চার শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই মারা গেছে ৬৭ জন। এক কিডনি ফেলতে গিয়ে দুই কিডনি ফেলে দেয়ার ঘটনা বিরল নয়। কিডনি চুরির ঘটনাও ঘটেছে। দেহের অভ্যন্তরে এক অঙ্গ ফেলতে অন্য অঙ্গ ফেলে দেয়া, অপারেশনে যমজ সন্তানের একজনকে ভূমিষ্ট করিয়ে অপরজনকে পেটেই রেখে দেয়া, অপারেশনের পর রোগীর পেটে গজ-ব্যান্ডেজ রেখেই পেট সেলাই করে দেয়া ইত্যাদি অসম্ভব-অস্বাভাবিক অনেক ঘটনাই আমাদের দেশে ঘটতে দেখা গেছে। এ জাতীয় কোনো ঘটনা জানাজানি হলে কিংবা এ নিয়ে প্রতিবাদ বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে চিকিৎসকদের একজোট হয়ে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে অথবা ধর্মঘট করতে দেখা গেছে। চিকিৎসা একটি মানবিক ও সেবামূলক পেশা, এটা যেন আমাদের দেশের এক শ্রেণীর চিকিৎসক ভুলেই গেছেন। তারা সুচিকিৎসা বা সেবার বদলে বাণিজ্যেই অধিকতর মনোযোগী। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনেকেই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। প্রাইভেট চিকিৎসাতেই তারা বেশির ভাগ সময় দিয়ে থাকেন। ওষুধ কোম্পানীর এবং বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে অনেকের কমিশন বাণিজ্যও রমরমা। সাধারণ চিকিৎসক, এমন কি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের বিরুদ্ধেই এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। প্রায়ই ভুয়া চিকিৎসকের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাদের অনেকের নেমকার্ডে বড় বড় ডিগ্রির উল্লেখ থাকলেও দেখা গেছে, তাদের কোনো ডিগ্রিই নেই। বেসরকারী মেডিকেল কলেজের লেখাপড়া নিয়েও প্রশ্ন কম নেই। স্রেফ সাটিফিকেট বিক্রয়কারী মেডিকেল কলেজেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। আসলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা অরাজকতা বিরাজ করছে। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা, ভুল চিকিৎসা, নৈতিকতাহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদির কোনো প্রতিকার ও বিচার হয়না। চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার এটা একটা বড় কারণ। সেবামূলক মনোবৃত্তি, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত না হলে এ আস্থা পুরুদ্ধারের কোনো পথ নেই। এই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতিরও বিদায় জানাতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় শৃংখলা, সুশাসন ও সেবামূলক মনোবৃত্তির জাগরণ জরুরী ও অত্যাবশ্যক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন