রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বাবার বন্ধুটি আর ফিরে আসেনি

গল্প

আ হ মে দ উ ল্লা হ্ | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

 

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
লাল মিয়া আমার নাম। বাড়ি নবীনগরের দৌলতপুর।
রঘুদার মনে কিছুটা সান্ত¦নার বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, জগতে আমার চেয়ে কম শিক্ষিত লোকও আছে।
অল্পক্ষণ পর ওই লাল মিয়া আবারও এসে দাঁড়াল রঘুদার সামনে, বলল, আপনের কপাল খুইল্যা গেছে মিয়া।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রঘনাথ, লাল মিয়া বলল, আইয়্যেন আমার লগে, বড় সাব আপনের লেখা দেইখ্যা যার পর নাই খুশি হইছেন। ওনি আশুগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের বড় ইঞ্জিনিয়ার। তাড়াতাড়ি উইঠ্যা আইয়্যেন..
রঘুদা তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নমস্কার বলার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক বললেন, নাম কী তোমার?
রঘু, মানে শ্রী রঘুনাথ!
হাতের লেখা দেখে তো দেখে মনে হলো মুক্তার দানা বসিয়ে দিয়েছো। লেখাপড়া কত দূর?
আজ্ঞে মেট্রিক পর্যন্ত, কিন্তু পাশ করতে পারি নি।
চশমার ফাঁকে বিস্মিত চাহনিতে তাকিয়ে ভদ্রলোক বলল, বলো কি তুমি! লেখা দেখে তো উচ্চ শিক্ষিত মনে হয়েছিল। এখন কী করছো?
কিছু করা ভাগ্যে এখনও জুটেনি। ভবঘুরে! ভাবছি আগরতলায় চলে যাব। কাজের খোঁজে?
চাকরি করবে?
আমার কি চাকরির যোগ্যতা আছে জনাব?
আমার কারখানায় একজন করনিক প্রয়োজন। মাসিক তিনশত টাকা মাইনে পাবে। থাকার জন্য রুমও আছে।
বিচলিত হয়ে রঘুদা গিয়ে ভদ্রলোকের পা চেপে ধরল।
চাকরির আশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোক চলে যাবার পর দিনটা স্টেশনের আশপাশে ঘুরেফিরে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে লাল মিয়ার সঙ্গে চলে গেল ওর পান্থশালায়। স্টেশন থেকে অল্প দূরে রেল লাইনের পাশে তার বারামখানা। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি মাচার মতো একটি কূড়েঘর। উপরে পলিথিনের ছাউনি, মাঝে মাঝে ছিদ্র। ছিদ্র দিয়ে আকাশ দেখা যায়। রঘুদাকে ভেতরে নিয়ে লাল মিয়া বলল-
ভাই, এইখ্যানেই সুখে রাত কাটাই, ঘরে খাওনের বন্দোবস্ত নাই।
মাটিতে ছেঁড়া কার্পেট বিছানো। একটা পুরোনো ছেঁড়াফারা কাঁথাও রয়েছে। বালিশটা দেখে মনে হয় শশ্মান থেকে কুড়িয়ে এনেছে। ঘর যেমনই হোক-না কেন বৃষ্টি না হলেই হয়। কিন্তু বিছানা ও বালিশ থেকে যে বিশ্রি দূগর্ন্ধ বেরুচ্ছে, রঘুনাথের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাবে মনে হচ্ছে!
দুজনে পাশাপাশি বসার পরই বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা পলিথিনের প্যকেট বের করলেন লাল মিয়া। প্যাকেটির ভেতরে অল্প পরিমাণ মিঠাইমাখা মুড়ি। প্যকেটের উপরে পিঁপিলীকা বাসা বেঁধেছে। অভাগার এ সামান্য খাবারেও পিঁপড়া এসে ভাগ বসিয়েছে! কালের চক্রে রঘুদাও এসে ওই খাবারে ভাগীদার।
মাথার নিচে বাম হাতটি রেখে শুয়ে পড়ল রঘুদা।
রাতের ট্রেন যখন মাটি কাঁপিয়ে ওদের পাশ দিয়ে চলছিল, তন্দ্রা ভেঙে গেল রঘুদার, মনে হচ্ছে- ট্রেনটি বুঝি তাদের মাথার উপর দিয়ে চলছে! ভয়ে শোয়া থেকে উঠে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরুল...
পরদিন ভোরে ওরা আশুগঞ্জে চলে গেল। বিনা দরখাস্তে দুজনের চাকরি হলো। লাল মিয়াকে লেবারের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। রঘুদাকে পাশের রুমে নিয়ে যাবতীয় কাজ বুঝিয়ে দিল।
অকূল সাগরের মাঝে যেন কূল খুঁজে পেল রঘুনাথ। চাকরিটা তার জীবন সাগরে ভেলার মতো এসে ধরা দিয়েছে।
অভাবের সংসার হলেও, সুখের পথ ধরেই তার জীবন অতিবাহিত হতে লাগল। বিয়ে করেছে, কয়েক বছরের মধ্যেই সন্তানের জন্ম হলো। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেশ করেই তার সংসার সাজিয়ে ফেলল। এই হচ্ছে আমাদের রঘুদা! এভাবেই তার জীবন এক অনিশ্চয়তার বন্দর থেকে ভেলায় ভেসে ছুটছে গন্তব্যের দিকে...
বাবা একেবারেই চুপ মেরে গেলেন। বাবাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে নেয়ামত বলল, আসলেই বাবা আপনি একজন অনন্য গল্পকার!
আঞ্জুমান বলল- আরেকটা গল্প শুনব নানা ভাইয়ের মুখ থেকে।
আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, দেখ, তোমার মা কেমন ঝিমাতে ঝিমাতে ঢলে পড়ছে! আজ আর নয়। আবার অন্যদিন অন্যরকম গল্প শোনাব। কয়টা বাজে এখন?
তাহমিনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল- প্রায় পৌনে দুটা।
যাও তোমরা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। অনির্দ্রা অসুখ ডেকে আনে।
বাবার গল্পের ঝুলির কতটুকুই-বা শেষ হয়েছিল, জানি না। বাবার গল্প না ফুরালেও কদিন আগে বাবার জীবনের গল্প শেষ হয়ে গেলো অশ্বথতলের মাটির বিছানায় শায়িত হবার মধ্য দিয়ে...। (সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন