বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজনীতি যখন গরিবের বউ

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের রসবোধ সর্বজনবিদিত। হাস্যরসের মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে থাকেন তিনি। তার পরিচিতজনদের কাছে শুনেছি, আগাগোড়াই তিনি একজন রসিক মানুষ। প্রাণ খুলে যেমন নিজে হাসেন, তেমনি অপরকেও হাসান। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তার সে স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার একটি হাস্যরসাত্মক বক্তৃতার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে। তিনি বিরোধী দলের উপনেতা। সংসদে একদিন বক্তৃতা করতে গিয়ে বললেন, মাননীয় স্পীকার, পরিবহন পুল থেকে আমাকে যে গাড়িটি দেয়া হয়েছে, তার চেহারা-সুরত যেমনই হোক, ইঞ্জিনের অবস্থা খুবই কাহিল। রাস্তায় মাঝে মধ্যেই বিগড়ে যায়। বড় বিপদে পড়ে যাই। ঠেলা না দিলে স্টার্ট নেয় না। ইচ্ছা করলে ঠেলতে পারি। কিন্তু জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা যদি রাস্তায় গাড়ি ঠেলে সেটা কি খুব ভালো দেখাবে? হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল অধিবেশন কক্ষে।
এখনও তিনি তার বক্তৃতায় এমন সব মজার কথা বলে সবাইকে হাসান। তেমনি একটি বক্তৃতা তিনি করেছেন গত ৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। তার ওই বক্তৃতা উপস্থিত থেকে যারা শুনেছেন তারা বেশ উপভোগ করেছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-ইউটিউবে ভাইরাল হওয়ার সুবাদে তা অতি অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। কেউ কেউ আবার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। বলেছেন, একজন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এমন হালকা কথাবার্তা আমরা আশা করি না। কেউ কেউ কটাক্ষ করেছেন তার স্থান-কাল-পাত্র সম্বন্ধে সচেতনতা নিয়ে। কিন্তু ওই বক্তৃতায় তিনি যে আমাদের দেশের রাজনীতির একটি চরম সত্য রসিকতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন তা অস্বীকার করবে কে? বলা যায়, সত্যটি তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে- গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। মানে ভাবি। পাড়া বা গ্রামের সবাই আইস্যা ভাবি ডাকে। এহন রাজনীতি হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। এখানে যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। কোনো বাধাবিঘ্ন নাই।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি যদি বলি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের লেকচারার হইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব ঢুকাইবেন না। বা আমি কোনো হাসপাতালে গিয়ে যদি বলি, এতদিন রাজনীতি করছি, হাসপাতালে ডাক্তারি করবার লাইগা দেও। বোঝেন, অবস্থাটা কী হবে? কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ। সবাই ইঞ্জিনিয়ার কইন, আর ডাক্তার কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর বয়স হইলে কইবো আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে, রিটায়ার্ড কইরা কইবো আমিও রাজনীতি করিব। আর্মির জেনারেল অয়, সেনা প্রধান অয়, অনেকে রিটায়রমেন্টে গিয়াই কয় আমি রাজনীতি করিব। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে আমি রাজনীতি করুম। এটার কোনো রাখঢাক নাই। যে ইচ্ছা যখন ইচ্ছা রাজনীতিতে ঢুকছে। ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে। এটা যেন কেমন কেমন লাগে। যার জন্যই আমার মনে হয় আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১৮)।
প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের বক্তব্য দেশের সচেতন মানুষদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকেই তার বক্তব্যকে সময়োচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। কেউ কেউ তার এ কথাকে রাজনৈতিক কর্মীদের অন্তরের কথা বলেও অভিমত প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন যে, প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে আমাদের দেশের রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন, এখন এ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিকদেরকেই।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য পেশার লোকেরা রাজনীতি করতে পারবে না, তা কিন্তু নয়। তবে, এ ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-নীতি থাকা দরকার। দেখা যায়, একজন সারাজীবন সরকারি উচ্চ পদে চাকরি করে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, অবসরে গিয়ে আর বিশ্রাম নেন না। ঝট করে ঢুকে পড়েন একটি রাজনৈতিক দলে। জানা অজানা কৌশলে বাগিয়ে নেন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে নির্বাচিতও হন। তারপর হয়ে যান মন্ত্রী। অন্যদিকে যে ছেলেটি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সাগরে সাঁতার কেটে চলেছে, সে আর তীর খুঁেজ পেল না। তার আশা হতাশার সাগরেই ডুবে গেল। কেন এমন হবে? কেন কতিপয় আমলা- পেশাজীবীর শেষ বয়সে এসে রাজনীতির ‘কোহিনূর পাথর’কে কবজা করে ক্ষমতার অনুশীলনের এমন মোহ থাকবে? তিনি যদি রাজনীতিই করবেন, তাহলে তো ছাত্রজীবন শেষে রাষ্ট্রের কর্মচারি হিসেবে নাম না লেখালেও পারতেন। এ তো ‘গাছেরটাও খাব, তলারটাও খাবো’ প্রবাদের উদাহরণ।
এ ক্ষেত্রে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন একটি নিয়ম অবশ্য চালু করেছিল। সে সময় ঘোষিত আরপিওতে বলা হয়েছিল, প্রজাতন্ত্রে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তা জাতীয় সংসদ বা অন্য কোনো নির্বাচনে কোনো দলের মনোনয়ন পেতে চাইলে তাকে কমপক্ষে তিন বছর সেই দলের সদস্য হিসেবে কাজ করতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে ধারাটি তুলে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন একজন আমলার অবসরে গিয়ে একদিনও বসে থাকতে হবে না। ইচ্ছে করলে পরদিনই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচন করতে পারবেন।
মানুষ স্বভাবগত কারণেই ক্ষমতার অনুশীলনে আগ্রহী। যে যেখানে যেটুকু পারে ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করে। যে ব্যক্তিটি সারা জীবন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুশীলন করেছেন, অবসরে গিয়ে তার বসে থাকা পোষায় না। ক্ষমতাকে কীভাবে অবারো হস্তগত করা যায় সে প্রস্তুতি নিতে থাকেন অবসরে যাবার আগে থেকেই। আর যে দলে সুযোগ পাওয়া যায়, সে দলের চৌকাঠে পা ফেলে তারা ক্ষমতার অন্দরমহলে ঢোকার স্বপ্নে বিভোর হন। তবে, এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার বিষয়টি এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বরং বলা যায়, রিটায়ার আমলাদের রাজনীতিবিদের জার্সি গায়ে চড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বই বেশি দায়ী। জাতীয় নির্বাচন এলে দলগুলো বিজয়ী হতে পারবে, এমন প্রার্থীর খোঁজে এক রকম হন্যে হয়ে উঠে। তখন তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে যায় প্রার্থীর জিতে আসা। দেখা যায়, এমন প্রার্থী মনোয়নয়ন দিতে গিয়ে দলগুলো তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করে। যে লোকটি রাজনীতি, দল আর আদর্শের জন্য সারাটি জীবন সব লোভ-লালসাকে উপেক্ষা করে, প্রতিপক্ষের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছেন, মনোনয়নের সময় তিনি বঞ্চিত হলেন। আর মনোনয়ন পেলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি কখনোই দলটির নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, জনগণের সাথেও যার কোনো ধরণের সম্পর্ক ছিল না।
আমাদের রাজনীতিতে পচন ধরেছে-এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন। কথাটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। যেখানে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা তাদের দলের কাছ থেকে সঠিক মূল্যায়ন পান না, সেখানে রাজনীতি সুস্থ থাকবে এ আশা করা বাতুলতা মাত্র। অনেকেই বলে থাকেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। কিছু লোক হঠাৎ এসে এখানে বিনিয়োগ করেন এবং সময় সুযোগ মতো তারা সে বিনিয়োগ সুদে-আসলে তুলে নেন। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন নির্বাচনে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা, পেশাজীবী আর ব্যবসায়ীদের মনোনয়নপ্রপ্তির যে অধিক্য দেখা যায়, তাতে স্পষ্ট যে, রাজনীতি আর আগের জায়গায় নেই। রাজনীতি যে শুধু ইলেকশন করা আর এমপি-মন্ত্রী হওয়া নয়, এটা যেন আমরা ভুলতে বসেছি! রাজনীতি যে চর্চার বিষয়, স্যাক্রিফাইসের বিষয় তাও যেন আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আমরা এটাও ভুলে গেছি যে, রাজনীতি ভোগের নয়, ত্যাগের ব্রত।
প্রশ্নটি প্রায়ই শোনা যায়- রাজনীতিকে নষ্ট করছে কারা? সঙ্গতকারণেই এর দায় রাজনৈতিক দল ও এর নেতৃত্বের ওপর বর্তায়। কেননা, তাদের অপরিনামদর্শী ও অবিমৃশ্যকারী নানা সিদ্ধান্ত সময়ে সময়ে রাজনীতিতে নতুন নতুন জটিলতার সৃষ্টি করে থাকে। রাজনীতি যদি রাজনীতিকদের হাতে না থকে তাহলে এর গতিপথ সঠিক থাকতে পারে না এবং তা দিক হারিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে ধাবিত হবেই। যে লোকটি জীবনভর সরকারি দফতরে ফাইলের মধ্যে নিজের জ্ঞান-গরিমার স্বাক্ষর রেখেছেন, তার বাইরে কোনো ধারণাই যার নেই, তিনি রাজনীতির জনারণ্যে এসে পথ হারাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমলা বা পেশাজীবীদের রাজনীতি করার বিষয়ে কোনো বিধি-নিষেধ আছে না-কি? না, তা নেই। নাগরিক হিসেবে তাদের সে অধিকার আছে। তবে, এ ক্ষেত্রে অধিকারের চাইতে যোগ্যতাকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। প্রেসিডেন্ট তো চমৎকার উদাহরণই দিয়েছেন। চাইলেই তো কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে না। এ জন্য থাকতে হয় প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও যোগ্যতা। কিন্তু ওইসব পেশাজীবী সহজেই জায়গা পেয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিতে। কেউ তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না। দলগুলো যাকে যখন গছিয়ে দিচ্ছে, জনগণ তাকেই বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
আজ আমদের দেশের রাজনীতিতে যে দৈন্যদশা চলছে, তা হঠাৎ করে উদয় হয়নি। ক্রমাগত চলে আসা অনিয়ম-অবক্ষয় এখন একেবারে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী মানেই গুন্ডা-পান্ডা এমন একটি ধারণা জনসাধারণের একটি অংশের মধ্যে অত্যন্ত শক্তভাবে গেঁথে গেছে। ভালো মানুষেরা রাজনীতি করতে পারেন, এ ধারণা জনমন থেকে তিরোহিত হতে বসেছে। রাজনীতি জনগণের কল্যাণে নয়, বরং রাজনীতির কল্যাণে কারো কারো ভাগ্যে আলাদীনের চেরাগ জোটে- এমন ধারণা পোষণ করে বেশিরভাগ মানুষ। যারা এটা মনে করে তাদেরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ তারা তো সব দেখছে চোখের সামনে। আর চোখে যেটা দেখা যায়, তাকে তো তারা অবিশ্বাস করতে পারে না।
সমাজে সাধারণত দুই ধরণের মানুষ সব সময়ই দেখা যায়। একদলে আছেন, তারা যারা হতাশায় ভোগে এবং ভবিষ্যতে ভালো কিছু ঘটবে সে আশা ছেড়ে দেয়। আরেক দলে আছে, তারা যারা আশবাদী প্রকৃতির। তারা বিশ্বাস করে, অন্ধকার দূর হবে এবং আলো আসবেই। আমাদের বর্তমান রাজনীতি নিয়েও এ দু’ধরণের মানুষের দু’রকম অভিমত আছে। একদল মনে করে রাজনীতি পচে গেছে, এর আর ভালো হবার সম্ভাবনা নেই। আরেকদল আশবাদী বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন একদিন হবেই। দেশবাসীও চায় রাজনীতি তার সঠিক পথে ফিরে আসুক। তবে, সেজন্য নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে হবে রাজনীতিকদেরকেই।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন