দুই
তন্মধ্যে একটি হলো চাকরি করা এবং নিজের পরিশ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা। চাকুরীর ক্ষেত্র হালাল হতে হবে। হারাম কোনো কাজে চাকরি নিয়ে তার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করলে তা কখনই হালাল হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন: ‘‘আর মানুষ প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারে না।’’ আর এই যে মানুষ যারা চেষ্টা করে, তাই সে পায়। আর এই যে, তার প্রচেষ্টার ফল শীঘ্রই তাকে দেখানো হবে। তারপর তাকে পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করা হবে।’’ “আল-কুরআন, ৫৩ : ৩৯-৪১” এ আয়াতের প্রেক্ষিতে রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: ‘‘নিজ হাতের উপার্জন মানুষের উত্তম খাদ্য। আর সন্তান মানুষের নিজ হাতের উপার্জনের অন্তর্ভূক্ত।’’ “আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত: -মুসনাদে আহমাদ, তা.বি., খ.৬, পৃ. ৩১, হাদীস নং-২৪০৭৮; আত-তাবারানী, প্রাগুক্ত, খ.৪, পৃ. ৩৮০, হাদীস নং-৪৪৮৬”
কৃষি কাজ : সাওয়াব লাভের জন্য যেমন সৎ কাজ ও সাধনা জরুরী, তেমনি সম্পদ লাভের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ জরুরী। এ জন্য নিজের ভাগ্যকে নিজে গড়ার লক্ষে মানুষকে কষ্ট করে রিযিকের ব্যবস্থা করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’’ “আল-কুরআন, ১৩ : ১১
উপার্জনের অন্য আরেকটি মাধ্যম হলো কৃষি কাজ। আদম আ. এ কৃষি কাজ করেছেন। এটি একটি উন্নত পেশা। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: ‘‘হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমি আমার কিছু বংশধরদেরকে নিয়ে ফসলহীন উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি স্থাপন করলাম, হে আমাদের রব, যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের হৃদয় আপনি তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন এবং তাদেরকে রিযিক প্রদান করুন ফল-ফরাদি থেকে, আশা করা যায় তারা শুকরিয়া আদায় করবে।’’ “আল-কুরআন, ১৪ : ৩৭”
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেন: ‘‘তিনি সেই সত্তা, যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যাতে রয়েছে তোমাদের জন্য পানীয় এবং তা থেকে হয় উদ্ভিদ, যাতে তোমরা জন্তু চরাও। তার মাধ্যমে তিনি তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন ফসল, যায়তুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সকল ফল-ফলাদি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে’’। “আল-কুরআন, ১৬:১০-১৪”
এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, রসূল স. বলেছেন: ‘‘কোন মুসলমান যখন কোন কিছু রোপণ করে অতঃপর তা থেকে কোন মানুষ অথবা কোন চতুস্পদ জন্তু কোন কিছু ভক্ষণ করে তা রোপনকারীর জন্য সদকার সমতুল্য সাওয়াব হয়।’’ “ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, বৈরূত: দারু ইব্ন কাছীর, ১৯৮৭, খ. ৫, পৃ. ২২৩৯, হাদীস নং- ৫৬৬৬; তাবারানী, আল্-মুজামুল আওসাত, আল-কাহেরা: দারুল হারামাইন, ১৪১৫, খ. ৯, পৃ. ১৪, হাদীস নং-৮৯৮৭”
আবূ আইউব আল-আনসারী রা. বলেন, রসূল স. বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কোন বৃক্ষ রোপণ করলো আল্লাহ্ তার জন্য একটি প্রতিদান নির্ধারণ করে রেখেছেন সে গাছ থেকে ফল বের হোক বা না হোক।’’ “তাবারানী, আল্-মুজামুল কাবীর, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ১৪৮, হাদীস নং-৩৯৬৯”
হাদীসের অপর এক বর্ণনায় কৃষি কাজকে সদকায়ে জারিয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আনাস রা. বলেন; রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: সাতটি বিষয়ে আমলের প্রতিদান মৃত ব্যক্তির কবরেও প্রদান করা হবে। তা হল, জ্ঞান শিক্ষা দেয়া, নদী ও কূপ খনন করা, খেজুর গাছ গালানো, মসজিদ নির্মাণ করা, বই-পুস্তক রেখে যাওয়া এবং এমন সন্তান দুনিয়ায় রেখে যাওয়া যে সন্তান ঐ ব্যক্তির ইন্তিকালের পর তার জন্য দুআ করবে।’’ “ইমাম বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১০, খ. ৩, পৃ. ২৪৮, হাদীস নং- ৩৪৪৯” এভাবে কুরআন ও হাদীসে কৃষিকাজকে একটি উন্নত পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
শ্রম ঃ সম্পদ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে শ্রম। কুরআন মাজীদেও এ মাধ্যমটির উল্লেখ করা হয়েছে। এটাকে অবলম্বন করে মানুষ কোন রকম পুঁজি ছাড়াই নিজের জীবিকা অর্জন করতে পারে। কুরআনে দু’জন নবীকে শ্রমিক-মালিক হিসেবে পেশ করা হয়েছে। মূসা আ. মহরের বিনিময়ে তাঁর স্ত্রীর বকরী চরিয়েছিলেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা শুআইব আ.-এর বক্তব্যের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন: ‘‘আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার এই কন্যা দু’টির একটিকে বিবাহ দেব তোমার সাথে এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পুরো করে দাও, তবে সেটা হবে তোমার অনুগ্রহ।’’-আল-কুরআন, ২৮ : ২৭
এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইব্নে কাছীর র. বলেন, মূসা বললেন: আমার ও আপনার মাঝে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, আট বছর ও দশ বছর এ দু’টির যে কোন একটি সময় আমি পূরণ করব। আর এটা আমার ইচ্ছাধীন। আট বছর পূরণ করার পর আমার উপর আপনি অতিরিক্ত পরিশ্রম চাপিয়ে দিতে পারবেন না।’’ আর আমাদের এ পারস্পরিক আলোচনায় আল্লাহকে আমরা সাক্ষী হিসেবে স্বীকার করছি। তিনিই আমাদের কার্যনির্বাহী। আমার পক্ষে আট বছরের স্থানে দশ বছর মজুরী করা যদিও মুবাহ, তা পূর্ণ করা জরুরী নয়। “ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম, তা.বি. খ. ৬, পৃ. ২৩৩, আলূসী, রূহুল মাআনী ফী তাফসীরিল কুরআনিল আজীম ওয়াস সাব’য়িল মাছানী, তা.বি. খ. ১৫, পৃ. ১১৪।”
বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম ঃ বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম বলতে ঐ সমস্ত পুঁজিহীন পেশাকে বোঝায়, যেগুলোর মধ্যে দেহের চেয়ে মস্তিষ্ক বেশি খাটানো হয়। পবিত্র কুরআনেও সেগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। ইউসুফ আ/-এর জীবনীতে বলা হয়েছে যে, মিসরের বাদশাহ তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর তাঁকে চাকরিতে ইচ্ছা প্রকাশ কর যা বলল তা আল্লাহ্ তাআলা আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন এভাবে আজ তুমি আমাদের দৃষ্টিতে বিশেষ মর্যাদাশীল ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে।’’ “আল-কুরআন, ১২:৫৪”
তখন ইউসুফ আ. তাঁর প্রস্তাবিত চাকরিকে গ্রহণ করে নিজের সম্পর্কে যে কথা উপস্থাপন করেছিলেন তাহলো: ‘‘আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের কর্তা পদে নিযুক্ত করুন। আমি ঐগুলোর রক্ষণাবেক্ষন করব এবং সে সম্বন্ধে আমার জ্ঞানও আছে।’’ “আল-কুরআন, ১২: ৫৫
এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোন চাকরির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে। আর সে আবেদনের মধ্যে নিজের যোগ্যতার উল্লেখ করা বৈধ। কেননা ইউসুফ আ. এ সুযোগে নিজেকে রক্ষণাবেক্ষনকারী ও জ্ঞানী বলে দাবি করেছিলেন। শ্রম, চাকরি ও অন্যান্য পেশার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে নবী স. বলেন: ‘‘আল্লাহর প্রত্যেক নবীই বকরী চরিয়েছিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: আপনিও? রসূলুল্লাহ স. বললেন: আমিও কয়েক কীরাত মজুরিতে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম।’’ “রসূল স. বলেছেন : -ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, প্রাগুক্ত, খ.২, পৃ. ৭৮৯, হাদীস নং- ২১৪৩।”
ব্যবসায় ঃ উপার্জনের জন্য ব্যবসায় একটি উত্তম পন্থা। আল-কুরআনেও ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা বলেন: ‘‘... এবং আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সুদকে হারাম করেছেন আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল।...’’ “আল-কুরআন, ২ : ২৭৫:” উল্লেখ্য যে, ব্যবসাকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। (এক) হালাল জিনিসের ব্যবসা (দুই) হারাম জিনিসের ব্যবসা।
হালাল বস্তুর ব্যবসা: এ সম্পর্কে উপরে উল্লিখিত আয়াতই যথেষ্ট। এছাড়া হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আবূ সাঈদ আল-খুদুরী রা. বলেন, রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: ‘‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীকীন ও শহীদদের সাথে থাকবে।’’ “রসূল স. বলেছেন: ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ৫১৫, হাদীস নং- ১২০৯।”
হারাম বস্তুর ব্যবসা: হারাম বস্তুর ব্যবসা করা হারাম। যেমন: মদ ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবসা।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন: ‘‘তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে আর অপবিত্র বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’’ “আল-কুরআন, ৭ : ১৫৭”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন