আমাদের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে। সে জন্য একটি শুভসূচনা প্রয়োজন। সেই সূচনা করার একটি উপযুক্ত সুযোগ ছিল ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখের নির্বাচন; কিন্তু সুযোগটির সদ্ব্যবহার হয়নি। আরেকটি সুযোগ ছিল জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচন; এটিও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। আরেকটি সুযোগ হচ্ছে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন, যেটি এ বছরের ডিসেম্বরের শেষে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে হওয়ার কথা। সুযোগটির সদ্বব্যবহার হবে কি হবে না, জানি না।
আগামী নির্বাচন যদি এমন সুন্দরভাবে করা যায় যে, সেটি পৃথিবীর সামনে একটি নজির হয়ে থাকে তাহলে আমরা মনে করব, আমাদের পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এখনো নিশ্চিত নই যে, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন আমাদের কামনা মোতাবেক সুন্দর হবে কি না; কিন্তু সুন্দর হোক এটা কামনা করতে দোষ নেই। গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে পার্লামেন্টে যাওয়া প্রয়োজন। কারণ, পার্লামেন্ট সদস্যদের কণ্ঠ অত্যন্ত জোরালো ও তাৎপর্যবাহী। পার্লামেন্টের বাইরের শক্তি এখনো এত শক্তিশালী হয়নি যে, পার্লামেন্টের শক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই গুণগত পরিবর্তন তথা সংস্কার ঘরের ভেতরে ঢুকেই করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন, উপযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে যাওয়া। আমাদের দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্বাচনমুখী দল হলেও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমরা জোটের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এবং গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। ২০১৪ সালের জানুয়ারির পরিস্থিতি এবং ২০১৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের পরিস্থিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য তফাত আছে। যা হোক, যে উপলক্ষগুলোর মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলছি, সেই পরিবর্তনে অনেক ছোট ছোট উপাত্ত থাকবে। এর কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি।
এক: রাজনীতিবিদদের ভাষায় শালীনতা ও শোভনতা থাকতে হবে। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মুখের কথা, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ইত্যাদি হওয়া উচিত তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয়। মিডিয়াতে যেহেতু বিবিধ পেশাজীবীর বা বিভিন্ন বয়সের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির কথাবার্তা দর্শনীয় হয় বা শোনা যায়, সেহেতু যেসব মানুষই মিডিয়াসম্পৃক্ত এবং তাদের প্রত্যেকের ভাষায় শালীনতা ও শোভনীয়তা প্রয়োজন।
দুই: জিদ ও গোঁয়ার্তুমি পরিহার করা উচিত। এ মুহূর্তে সরকারি বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবির বলছে, বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক, বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেহেতু সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, সেহেতু ক্ষমতাসীন দলের মতে, নির্বাচনের জন্য তত্তাবধায়ক সরকার গঠন করার আর কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবির (যেখানে আমাদের দলও একটি শরিক) বলছে, একাধিক কারণেই ক্ষমতাসীন দলের এবং ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সরকার ও দেশ পরিচালনা অব্যাহত রেখে ওই পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নিরপেক্ষ ফলাফল আশা করা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, কী নিয়মে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবিরকে আশ্বস্ত করা যায়, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। অপর ভাষায় বলা যায়, আমি এবং আমরা যারা বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরে আছি, আমরা কী নিয়মে আশ্বস্ত হবো, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ হবে?
অন্য কথায় বলতে গেলে এই দাঁড়ায়, যেহেতু নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি এখন বাতিল, তাহলে সরকারি নিরপেক্ষতার পদ্ধতি কী হতে পারে; অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি আছে কি না, যার মাধ্যমে বর্তমান সরকারি দল এবং বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবির উভয়ে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে মানসিক স্বস্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরূপ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে গেলে অবশ্যই গবেষণা ও আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি চিন্তা করা প্রয়োজন এই মর্মে যে, মানসিক স্বস্তি নিয়ে যদি রাজনৈতিক অঙ্গনের কোনো একটি অংশ, নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে পরিণতিতে কী হতে পারে?
তিন: আমাদের রাজনীতিকে বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করতে হবে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এ তিন কালের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। উন্নত বিশ্বের প্রবণতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে নজর বেশি দেয়া। আমাদের মধ্যে যারা প্রবীণ, তাদের অনেকেরই মনে একটি ধারণা হলো, তারা (প্রবীণেরা) যা মনে করেন, দেশের সব মানুষই যেন তাই মনে করেন। আসলে দেশের তরুণ সম্প্রদায় বহুলাংশেই প্রবীণ সম্প্রদায় সম্পর্কে আস্থাহীনতায় ভুগছে। ইতিহাস সম্বন্ধে যতটাই আমরা তরুণদের ‘খাওয়াতে’ চাই, তারা ততটুকু খেতে প্রস্তুত নয়। তরুণেরা ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশিদের সাথে দেশে থাকা বাংলাদেশিদের ইন্টার-অ্যাকশন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড বা তরঙ্গ জগতে কোনো সীমারেখা নেই; যার কারণে বাংলাদেশি তরুণ সম্প্রদায় বিশ্বের অন্য দেশের ও সমাজের তরুণ সম্প্রদায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হতে চায় এবং এ জন্য সুযোগ চায়। অতএব, আমাদের রাজনীতি আগামী দিনের বাংলাদেশের মালিক তথা বর্তমানের তরুণ সম্প্রদায়ের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষা একোমোডেইট করতে হবে বা এটাকে আশ্রয় দিতে হবে।
চার: ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বলতে বোঝাতে চাই যে, বিভিন্ন পেশার মেধাবী, সাহসী কর্মঠ, দক্ষ ও আগ্রহী ব্যক্তিরা যেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ভূগোল থেকে একটি উদাহরণ দিই। ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এত দূষিত যে, শুষ্ক মওসুমে (অক্টোবর থেকে মে) এই নদীর পানিকে ‘পানি’ বলা মুশকিল হয়ে যায়। এটাকে শুধু তরল পদার্থ বললেই চলে। অপর দিকে, বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি হয়, এটাকে বুড়িগঙ্গার তরল পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দূষিত তরল পদার্থের তুলনায় যখন স্বাভাবিক বৃষ্টির পানি নদীতে বৃদ্ধি পায়, তখন বুড়িগঙ্গার ‘পানি’কে আবার পানির মতো মনে হয়। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার দূষিত তরল পদার্থকে হালকা করতে হলে বাইরের পানি দরকার। তদ্উপ, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রবাহে, যদি উন্নত জীবন দান করতে হয়, তাহলে নতুন মানুষ, নতুন চিন্তা, নতুন মেধার প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতি নামক কর্মকাÐকে সম্মানজনক করতে হবে। তাহলেই মানুষ রাজনীতি করতে আগ্রহী। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার পর বড় হলে রাজনীতি করবে- এ কথা যেমন সত্য ও ভালো, তেমনই সত্য ও ভালো যারা ছাত্রজীবনে যারা রাজনীতি করেনি, তবে পরবর্তী জীবনে জড়িত হতে চায়; তাদের জন্য দুয়ার উন্মুক্ত রাখতে হবে।
কিছু ধারণা স্থিতি লাভ করেছে আমার মনে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য যে চেষ্টা সবাই করছেন বা আমরাও করছি এবং ভবিষ্যতেও করব, সেগুলো অবশ্যই আমার মনের ভেতরে থাকা, স্থিতিশীল ধারণাগুলোর সাথে সম্পূরক ভূমিকা রাখবে। একটি একটি করে সেই স্থিতিশীল ধারণাগুলো উল্লেখ করছি।
এক: বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতভাবে সেই রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা। অতএব, আমৃত্যু আমার প্রত্যয় থাকবে, এ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা এবং দেশকে নিরাপদ রাখা।
দুই: এক নম্বর ধারণার ধারাবাহিকতায় বলেছি, অবদান রাখার জন্য এবং নিরাপদ রাখার জন্য, সুযোগ পেতে হবে বা সুযোগ করে নিতে হবে এবং এ কাজগুলো করতে হলে যে বৈরিতা সামনে আসে, সেটিকে মোকাবেলা করতে হবে।
তিন: বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। ১৯৭২ সালে যেমন ছিল, কিংবা ১৯৮২ সালে যেমন ছিল, ১৯৯২ সালে যেমন ছিল ও ২০০২ সালে যেমন ছিল, এখনো তেমনই সম্ভাবনাময় দেশ। ধাপে ধাপে সময় সময় ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বে সম্ভাবনা পূরণের একেকটা ধাপ বাংলাদেশ পার হয়ে এসেছে। আবার সম্ভাবনার নতুন ধাপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। বিভিন্ন কালে ঐতিহাসিক যেসব নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সম্ভাবনার ধাপগুলো অতিক্রম করেছে, আমরা তাদের সব সময় স্মরণ করব, স্যালুট দেবো।
চার: বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও প্রতিশোধস্পৃহা পরিহার করা অপরিহার্য। কিন্তু এ কথা বলা সহজ- এই মর্মে কোটি কোটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা কঠিন বৈকি!
পাঁচ: ধাপে ধাপে সময় সময় উন্নয়নের সাথে সাথে আমরা অনেক বড় ভুলও করেছি। তার মধ্যে অন্যতম বড় ভুল হলো, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলা। তাই বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ছয়: গ্লোবালাইজেশন বলি বা বিশ্বায়ন বলি, যে নামেই ডাকি না কেন- যোগাযোগের যুগে (ইংরেজিতে: ‘ইন দ্য এইজ অব ইনস্ট্যান্ট কমিউনিকেশন’), প্রতিবেশিত্ব বা সহাবস্থান- এরূপ শব্দগুলোর তাৎপর্য ভিন্নমাত্রা অর্জন করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশই তাদের প্রতিবেশীর বৈরিতার মুখে স্বস্তিতে থাকতে পারে না। তাই স্বকীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি প্রতিবেশীর স্বকীয়তা ও নিরাপত্তার দিকে নিজেরা যেমন মনোযোগী থাকব, তেমনি প্রতিবেশীও যেন আমাদের স্বকীয়তা ও নিরাপত্তাকে সম্মান করে, এ জন্য ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে।
সাত: ধর্মীয় বা কৃষ্টিগত বা ভাষাগত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয় ধরনের মানুষ দিয়ে একটি দেশ ও জাতি- বাংলাদেশ এই গঠনের বাইরে নয়। আমার ধারণা, সংখ্যাগুরুদের ওপর অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব হয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান এবং জাতীয় অগ্রগতিতে সহযাত্রী করা।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন