শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কোন ফড়িঙ আমাকে চিনতে পারছে না

গল্প

সা ল মা ন সা দ | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৮ এএম

কী ব্যাপার!
গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফড়িঙের মত উড়ে উড়ে আসছে ষোড়শী অতনু। হাসতে হাসতে, ভিন্ন একটি ছেলের সঙ্গ নিয়ে আসছে অতনু।
আমার বুকের বাঁপাশটা আঁকড়ে ধরে যে একদিন হাঁটতো।
আমার সামনে এভাবে সে কখনো পড়েনি ধরা। আমি ওকে দেখলাম, একবার দেখে কী অনায়াসে চোখ ফেরালাম, ওই তাকানোটার মুহ‚র্তে চোখাচোখি হ›লো।
কোন জড়তা লক্ষ্য করলাম না,
সে একইরকম হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে চলে গেলো স্বাচ্ছন্দ্যে। বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত ভাব, হোক না চকিতে আড়াল করে ফেলার চেষ্টা , দেখলাম না ওর ভঙ্গিতে।
আমাকে চিনতে কি পারলো না অতনু
ওরা বইজাহাজে যাচ্ছিলো।
বইজাহাজ। একটা বইয়ের ঘর। অভিজাত। রুচিশীলতার নজির। অবকাঠামোর আদল, সাজ পারিপাট্য, কারুকাজ একেবারে গতের বাইরে - অন্যরকম। মনে হবে যেন বিস্তৃত অগাধ সমুদ্র, তার তীরে একটা প্রাচীন জাহাজ দাঁড়িয়ে প্রস্তুত পাল তুলে, যেনবা অনন্ত অতীতের দিকে রওনা দিতে।
সেই জাহাজের ডেকে বা কেবিনে কি মাস্তুলে বসে বই পড়ছেন আপনি - যুগের নাবিক।
আমার মাথার ভেতরদালানটা কাঁপছিল প্রবল ভ‚মিকম্পে।
হঠাত জমাট ঝিমঝিম শুরু হলো, বুঝতে পারলাম না বুকে না মাথায়, কারণ মনের অবস্থান এদুটির কোথায় তা নিয়ে ধন্ধ, টলতে টলতে হাঁটতে লাগলাম, দেহের ভারটিকে খুব বেশি লাগছিলো, নিজেকে সামলে সামলে।
পরপর দুজন লোকের সাথে ধাক্কা লাগলো।
পাঞ্জাবীটার একপাশ পটপট করে ছিঁড়ে গেলো পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া রিকশার চোখা স্টিলে বেঁধে।
আমার এই নীল পাঞ্জাবীটা, আহা, সেই পাঞ্জাবীটা, অতনুর নীল রঙ পছন্দ বলে কিনেছিলাম, বেশি দাম দিয়ে।
একদিন আমার এক বন্ধুকে নীল পাঞ্জাবীতে খুব সুন্দর লাগছে বলেছিল ও।
এই পাঞ্জাবীটাও যেন আজকে উপহাস করছে আমাকে।
এক মানসবেশ্যার প্রেমপ্রলুব্ধ হয়ে আমাকে কিনেছিলে বোকা!
বইজাহাজে ঢুকলাম। এখানে ওখানে ছিটিয়ে ছড়িয়ে অনেক পাঠক। এদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক আমার চেনা, নিয়মিত আসাযাওয়া বলে।
ফটকের পাশে সে যে বসে আছে একা একা - সুতা আপা। কী অপ‚র্ব লাগছে তাকে। অবশ্য সুন্দর যে, তাকে সবসময় ওরকমই লাগবে। অন্যসময়ে দেখেছি ওকে লাল শাড়িতে ডালিম ফুলের মতো রাঙা, বা নীল শাড়িতে প্রস্ফুটিত অপরাজিতা।
আজ পরেছে বোরকা, নীল ওড়নার আঁচল তুলেছে মাথায়। কী মার্জিত সুন্দর, রহস্যে ঢাকা। উচ্ছাসে ছুটলাম, কতদিন বাদে দেখা। ছোট ভাইটির মতো, কত খুনসুটি-ঝগড়ার স্বৃতি, কত মৃদু থাপ্পড় চিমটি মিষ্টি ঝাড়ি। সুতা আপার সার্টিফিকেট নাম অন্য। সুতা হওয়ার নৈপথ্যে মজার একটা গল্প ছিলো। প্রিয় পরিচিত ছাড়া এই নাম অন্যকারো জানার কথা না।
-আরে সুতা আপা!
আপা যেন একটু চমকে গেলেন, বই থেকে মুখ না তুলে ভারি চশমার ফাঁক দিয়ে একবার আমাকে দেখে নিলেন।
ঝর্ণার জল ভেঙে পড়ার মতো দাপুটে বিরক্তি যেন নেমে আসলো তার ভ্রুজোড়ায়। কিন্তু কিছু বললেন না, পাত্তা না ফেলে আবার বইতে চোখ ডোবালেন, আমি পাথুরে ভাস্কর্যের থ বনে রইলাম।
আজ এমন কেন করলো আমার সাথে প্রাণোচ্ছল সুতা আপা?!
আমি চাপা ক্ষোভের ধোঁয়া নিভিয়ে এগিয়ে বললাম,
যথাসম্ভব নীচু কণ্ঠে, কানের দিকে মুখ নিয়ে, প্রায় ফিসফিস, আপা, এক্সকিউজ মি? কোন সমস্যা?
ফস করে সাপের ফণা যেন দাঁড়াতে দেখলাম চেয়ার থেকে।
ওই আপনার সমস্যা কী? আপনি কে হ্যা?
আমার গালের কাছে জিহ্বা দিতে মন চায়?
আর এইরকম সুতা সুতা করছেন কেন? আমার নাম না জানলে ভদ্রভাবে সম্বোধন করুন।
মাথার ভেতর যেন বিস্ময়ের দরোজাটাও দড়াম করে বন্ধ হবার শব্দ শুনলাম। এই সাক্ষাৎ চমকের পর আর কোন অনুভ‚তি থাকবার কথা না।
আমাকে আজ কেউ চিনতে পারছেনা
কী ব্যাপার?!
পরশু ভোরে আমার বাবা মারা গেলো। আটচলি­শ মাত্র বয়স হয়েছিল তার।
মন আমার মনে হচ্ছে বড়ো দরিদ্র, জড়োসড়ো, দুর্বল, জীর্ণ কাপড়ের মতো। আবার এখানে এসব। আর বিব্রতকর পরিস্থিতি হওয়ার আগে বাসায় ফিরলাম।
কোন কাজ তো নেই। বাসার ফার্নিচারগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য পড়লো হঠাত। স্টিলের আলমিরাটায় ধুলো জমেছে। বাঁ পাশের পাল্লাার আয়নাতেও দাগ আর ঘোলাটে ময়লার স্তর জমেছে। বহুদিন আয়না দেখা হয়না।
আমার ঘরে আয়না দেখার মতো কেউ বাস করে না।
আয়নায় কোন ছবি ভাসেনা। সব ঝাপসা। যেন আয়নার ওপাশের জগতে প্রগাঢ় কুয়াশা। জমেছে জমেছে গভীর শীত।
নীল পানি দিয়ে আয়না ওয়াশিং শুরু করতেই ধীরেধীরে আমার অবয়ব স্পষ্ট হতে শুরু করলো।
আয়না মোছা শেষ প্রায়।
আর এক মিনিটেরও কম সময় পর আমি জানতে পারবো, আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে আমার আটচলি­শ বছর বয়সী চেহারার বাবা।
অথবা কী জানি, আমার পুরনো মস্তিষ্ক হয়ত চেতনায় পাঠাবে ভুল আলো,
দেখবো একটা ঘাসফড়িঙ উড়ছে তিড়িংতিড়িং।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন