মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষার মান নিয়ে কিছু কথা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

শিক্ষার মান পড়ছে, তা নিয়ে সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণির উপযোগী শব্দ বা বাক্য পাঠে থমকে যায়, সরল বিয়োগও করতে পারে না। এ কথা এখন সকলে জানেন ও মানেন যে, শিক্ষাবিস্তারে সাফল্য না এলে তা অনেক সমস্যার জন্ম দেয় এবং অবশ্যই দেশের উন্নয়ন শ্লথ হয়ে যায়। তাই, শিক্ষার মান পড়ায় সচেতন মানুষ তো উদ্বিগ্ন হবেই। তারা চাইবেই যে, শিক্ষার মান উন্নত হোক।
কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসে পড়েছে মেঘের মতো যা আকাশের নীল মুছে দিতে উদ্যত। শিক্ষা কাকে বলে? শিক্ষার মান বলতে কী বুঝি আমরা? যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি তো সে দায় কার? প্রশ্ন আরও আছে। আমরা আপাতত এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করি।
শিক্ষা কাকে বলে? আমাদের সংবিধানে বলা আছে, ১৪ বছর পর্যন্ত সব শিশুর জন্য প্রথাগত শিক্ষার আয়োজন করবে রাষ্ট্র। সময়সীমা ধার্য হয়েছিল দশ বছর। রাষ্ট্রের এমন প্রতিশ্রæতি স্বপ্নাদেশ নয়, দীর্ঘ চর্চার ফসল। এই দেশের চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক আলোচনা করেছেন শিক্ষার রূপ, প্রকৃতি নিয়ে। বিবেচনা করেছেন এই দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কেমন শিক্ষার প্রয়োজন, বিবেচনা করেছেন শিক্ষা কাকে বলে? এখানে বলে রাখা ভালো যে, কেবল এই প্রশ্নটি নয়, ওপরের কোনো প্রশ্নেরই সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। অনেক বিশেষজ্ঞ, অনেক কমিটি-কমিশন বলেছে, সবার আগে সকলকে সাক্ষর হতে হবে, লিখতে-পড়তে শিখতে পারলেই হবে, আর অল্পস্বল্প অঙ্ক।
ব্রিটিশরা এ দেশ ছাড়ল যখন তখন এ অঞ্চলে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। ন্যূনতম লক্ষ্য সাক্ষরতা মেনেও অনেকে বললেন, আরও কিছু চাই। চাই সুশিক্ষা, যা মানুষকে স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখাবে, সুনাগরিক হতে সাহায্য করবে। দশ কেন, সত্তর বছর পরে এমনকি বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪৭ বছর পরও এদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষ নিরক্ষর। প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু স্কুলেই যায় না। যারা যায় তাদের অনেকে স্কুলছুট হয়। শিক্ষা অনাকর্ষণীয়, ব্যয় সাপেক্ষ। গরিবের সংসারে বিলাসমাত্র। স্কুলছুটের কারণই শিক্ষার হালচাল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তবু তো দেশের তিন-চতুর্থাংশ সাক্ষর এবং তাতেও তুষ্ট হওয়া যেত যদি না প্রশ্ন উঠত শিক্ষার মান নিয়ে।
শিক্ষার মান বলতে কী বুঝি আমরা? এ নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। কালে কালে শিক্ষার মান সম্পর্কিত ধারণার বিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। অনেকেই চাইছেন, শিশুর সুনাগরিক হয়ে ওঠার পথে শিক্ষা যেন সহায় হয়। নিছক বিজ্ঞাপন-পাঠের যোগ্যতা অর্জন করলেই হয় না, আজকের শিক্ষার্থী আগামীকাল নাগরিক হয়ে যেন সমাজ বা রাষ্ট্রের গতিধারায় ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীর চাহিদা ও স্বপ্ন বিবর্তিত হচ্ছে। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্তে¡ও শিক্ষান্তে তাদের মাত্র ১ শতাংশ কৃষিকাজে যুক্ত হতে চায়; তাও চায় তাদের অভিভাবকরা চান সরকারি চাকরি।
কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রথাগত শিক্ষার মান নামছে। তারা তো গ্রাম বাংলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে- অথচ, সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালানো তাদের বিচারে শিক্ষার মান নির্ণায়ক নয়। ভালো মানের শিক্ষা সমাজ-সংসারে শান্তির সম্ভাবনা বাড়ায়, সম্প্রীতির আবহ স্থাপনে সাহায্য করে, পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে। কেবল এদেশ বলে নয়, বিশ্ব-পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে, খুব খারাপ সময় এসেছে, আরও খারাপ সময় আসছে, যা মোকাবিলায় শিক্ষা সাহায্য করছে না। শিক্ষার মান পড়ছে। সুশিক্ষার আয়োজনে আমরা বুঝি ব্যর্থ।
যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি তো সে দায় কার? প্রয়োজনের তুলনায় চিরকালই শিক্ষাখাতে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থও এই খাতে সবটা খরচ করা হয় না। তবু, স্বাধীনতার পর খরচ যা হয়েছে তা নিতান্ত কম নয়। তা সত্তে¡ও দেশটা পূর্ণ সাক্ষরও হয়ে উঠতে পারেনি। কেন? দুর্নীতি? অপচয়? দায়িত্বে থাকা মানুষদের অযোগ্যতা, অবহেলা? অদক্ষতা? অথচ, সরকার ও প্রশাসন নিয়মিত বলে যাচ্ছে, আমরা দ্রæত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি। বারবার প্রমাণ হয়েছে, এমন দাবি অসত্য। তবু তো শুনিনি দায়িত্বে থাকা মানুষদের কার কোনো শাস্তি হয়েছে। তাঁরা দায় এড়িয়েছেন বা দায় চাপিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবদের ওপর। সবটুকু না হলেও তাদের সকলেরই কিছু দায় নিশ্চয়ই থাকে। কেমন দায়? শিক্ষামন্ত্রী কি একাই সবকিছু করবেন, তাঁর তো ইচ্ছা বা আন্তরিকতার অভাব নেই। দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করেই যাচ্ছেন। দেখা যায়, আজ ঢাকা তো কাল সিলেট, পরদিন দিনাজপুর এভাবে তিনি সারা দেশে দৌড়াচ্ছেন। কীভাবে শিক্ষিতের হার বা শিক্ষার মান উন্নত করা যায় তা নিয়ে কাজ করেই যাচ্ছেন। তাঁকে কি সকল মহল থেকে সাহায্য করা উচিৎ না?
মানতেই হবে, পেটে খিদে নিয়ে বা জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে বিদ্যাচর্চা হয় না। শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ন্যূনতম মান নিশ্চিত না করা গেলে শিক্ষার আয়োজন ব্যর্থ হবেই। উপযুক্ত পরিবেশও চাই। নিয়মিত পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি থাকলেও শিক্ষার্থীর ওপর চাপ পড়ে। তবু যে শিশুরা স্কুলে আসে তাই তো চরম বিস্ময়ের। কিন্তু, আসাটা তাদের অনেকের অনিয়মিত! শিক্ষা বা শিক্ষার আয়োজন আকর্ষণীয় না হলে সে নিয়মিত আসবে কেন? যেমন পুষ্টির জন্য মিড ডে মিল, তেমনি শিক্ষার আয়োজন আকর্ষণীয় করতে আদর্শ স্কুলশিক্ষা কাঠামো গড়াতেও সরকার মন দিয়েছে। কিন্তু, মিড ডে মিল তো সকলে পায় না। মাথাপিছু বরাদ্দ এত কম যে, যাঁরা তা পায়, গুণে-পরিমাণে তা অতি সামান্য। অপুষ্ট হাঁস-মুরগির পুষ্টিসাধনে এর চেয়েও বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। আর স্কুল কাঠামো? সরকার বলছে, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানীয় জল আর শৌচাগারের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু সে পানি নিরাপদ কি না কেউ জানে না, যেমন কেউ জানে না শৌচাগারের চাবিটা কার কাছে, কেন? কেন শৌচাগারে নেই পানির সংযোগ? শিশু তো জানে না, সরকারি ব্যবস্থা এমন হয়। সে নিয়মিত স্কুলে আসার আগ্রহ হারায়।
ভালো মানের শিক্ষক পারে তার আগ্রহ বাড়াতে। এখন ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বেশ ভালো। তবুও রয়েছে প্রচুর ১/২ শিক্ষকের পাঠশালা, নিয়মিত শিক্ষক নেই একজনও- আছেন পার্শ্বশিক্ষক; এমন বিদ্যালয়ও দেশে কম নয়। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বেশ ভালো যেখানে সেখানেও সমস্যা বড়ো কম নয়। মনোবিদ নেই, আছে শিশু নির্যাতন, খেলা-আঁকা-গানের মতো বিষয়গুলি গুরুত্ব পায় না। তাদের আরও অনেক সমস্যা আছে।
সরকার কি পারে সব সমস্যার সমাধান করে দিতে? অভিভাবকরা এগিয়ে এলে অনেক কিছু হয়। অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষক তথা স্কুলের যোগাযোগ কমে গিয়েছে বা সৌহার্দ্য নেই এমনটাও আছে। স্কুল বা তার সংলগ্ন জনপদে শিক্ষকরা যেন বহিরাগত। পিঠ বাঁচাতে বা রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে কেউ কেউ দলীয় রাজনীতিতে মত্ত, কেউ বাড়তি অর্থের লোভে প্রাইভেট টিউশনে ব্যস্ত- অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রেই দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছেন বা দেখছেন না। দায় কেবল শিক্ষকের নয় কেবল অভিভাবকের নয়, দায় কেবল শিক্ষার্থী বা সরকার বা পরিচালকের নয়, দায় কেবল অশান্ত সময়ের নয়, এই সরল সত্য যদি না মানি তবে শিক্ষার মান নেমেই যাবে, কেউ সামাল দিতে পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
বিশ্বজিৎ চৌধুরী ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ২:১২ এএম says : 0
জনাব আফতাব চৌধুরী সাহেব, আপনার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আপনার নাতিদীর্ঘ লেখার জন্য ধন্যবাদ। যে তিনটি প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করছিলেন বার বার পড়েও উত্তর আবিষ্কার করতে পারলাম না। হয়তো তা আমারই ব্যর্থতা। তবে এটাঠিক শিক্ষার মান নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। তবে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার একটি লক্ষ্য নির্ধারিত আছে এবং এই লক্ষ্য বাস্তবয়নেরয়নের জন্য উদ্দেশ্য, প্রান্তিক যোগ্যতা, বিষয় ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা ও শ্রেণী উপযোগী প্রান্তিক যোগ্যতা এবং সে উপপযোগী বিষয়বস্তুও নির্ধারিত। আমার বিশ্বাস এগুলো যথাযথ ভাবে অর্জিত হলে শিক্ষার মান নিয়ে কোন কথা উঠবে না। এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কী অর্জিত হচ্ছ? আমার উত্তর খাংকিত পর্যায়ের নয়। কেন? আমার ব্যক্তিগত মতামত সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেব কোথা। ধন্যবাদ।
Total Reply(0)
বিশ্বজিৎ চৌধুরী ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ২:১২ এএম says : 0
জনাব আফতাব চৌধুরী সাহেব, আপনার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আপনার নাতিদীর্ঘ লেখার জন্য ধন্যবাদ। যে তিনটি প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করছিলেন বার বার পড়েও উত্তর আবিষ্কার করতে পারলাম না। হয়তো তা আমারই ব্যর্থতা। তবে এটাঠিক শিক্ষার মান নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। তবে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার একটি লক্ষ্য নির্ধারিত আছে এবং এই লক্ষ্য বাস্তবয়নেরয়নের জন্য উদ্দেশ্য, প্রান্তিক যোগ্যতা, বিষয় ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা ও শ্রেণী উপযোগী প্রান্তিক যোগ্যতা এবং সে উপপযোগী বিষয়বস্তুও নির্ধারিত। আমার বিশ্বাস এগুলো যথাযথ ভাবে অর্জিত হলে শিক্ষার মান নিয়ে কোন কথা উঠবে না। এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কী অর্জিত হচ্ছ? আমার উত্তর খাংকিত পর্যায়ের নয়। কেন? আমার ব্যক্তিগত মতামত সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেব কোথা। ধন্যবাদ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন