চাচি, ও চাচি, এমন সন্ধ্যে বেলায় তুমি একলা কই যাইত্যেছো?
ডাক শুনে মুসাফিরের সামনে এসে বানেছা বলে, ‘মুসাফির, এদিকে কি আঞ্জু ও ত্বোহাকে দেখেছো?’
নাহ্, আমি এখানে আসার পর এদিকে কোনো লোকই দেখি নাই। কেন, কী হইছে চাচি?
আর কইয়্যো না বাজান, কোন দুপুরে ত্বোহারে লইয়্যা আঞ্জু মাছ মাছ ধরা কথা নাম কইরা বাইর হইছে, সন্ধ্যা হইয়্যা গেল অথচ এহনো বাড়িতে ফিরে নাই! কও তো- এহন কোত্থেইকা তাগোরে খুঁইজ্যা বাইর করি।
চিন্তা কইরেন না চাচি, বিলেই হয়তোবা আছে; খোঁজ করলে পাইয়্যা যাবেন।
এমন সন্ধ্যায় কেউ কি এইখ্যানে থাকে বাবা! যদি শয়তানে পানিতে ডুবাইয়্যা মারে, কেমন হইব কও তো দ্যহি!
দুশ্চিন্তা কইরেন না, আশপাশেই কোথাও আছে হয়তো!
হাভাতিয়ার বিলকে সকলেই ভয় পায়। বিকেলের আগেই কৃষক জেলেরা কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে, ভুল করেও সন্ধ্যার পর কেউ থাকে না কিংবা এদিকে আসতেও চায় না।
মাঝেমধ্যে এখানে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে থাকে, ভয়ঙ্কর ও গা-শিহোরিত বিচিত্র শব্দ ভেসে আসে ওই বিল থেকে। লোকে বলে- ওই আওয়াজ প্রেতাত্মা কিংবা বিদ্রোহী আত্মার আত্মচিৎকার! এলাকার কোনো মানুষ নিঁখোজ হলে, খুঁজে পাওয়া যেতো হাভাতিয়ার বিলে, জীবন্ত নয়; মৃত!
শেষবার গত দুবছর আগে দড়িকান্দির তাজুল বেপারির সাত বছরের ছেলে সেকান্দর বাবার জন্য খাবার নিয়ে বিলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
জমিতে ধানের বীজ ফেলতে বিলে গিয়েছিল তাজুল বেপারি। দুপুরে সেকান্দর বাবার জন্য খাবার নিয়ে যায় বিলে।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এলেও কেউ খাবার নিয়ে না-আসায় তাজুল বেপারি ক্ষেপে ওঠে। খিদে সহ্য করতে না পেরে বিকেল হওয়ার আগেই জমি ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে যায়।
খিদের জ্বালায় বাড়িতে এসেই উচ্চবাক্যে স্ত্রীকে গালমন্দ করতে থাকে তাজুল বেপারি...
স্বামীর হল্লাচিল্লায় রান্নাঘর থেকে বেরোয় ওর স্ত্রী মরিয়ম, বলল, এমন কইর্যা চিগলাইত্যাছো ক্যান? সেকান্দর তো কোন দুপুরেরই তোমার লাইগ্যা খাওন লইয়্যা গেছে।
চমকে ওঠে তাজুল বেপারি, বলল, কও কী তুমি! সেহান্দর তো জমিতে যায় নাই!
কী আজেবাজে কতা কইত্যাছো, পোলাডা গেল কই?
আমি কমু ক্যামনে! পোলা তো জমিতে যায় নাই।
মাথাটা গরম হয়ে গেল তাজুল বেপারির, দ্রুত বিলের দিকে ছুট লাগায়...
তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে...! প্রকৃতিজুড়ে নেমে আসছে রাতের আঁধার! শীতের কুয়াশা আর রাতের আঁধার এক হয়ে প্রকৃতির ওপর ঘনকালো আঁধার ফেলতে শুরু করছে...
শুন্য ফসলের ময়দান। কৃষকগণ কত আগেই কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেছে। যেদিকে চোখ যায় কেবল আঁধার ও কুয়াশায় ঢাকা শুন্য ময়দান। তাজুল বেপারি ব্যাকুলচিত্তে ছুটোছুটি করছে আর জোর গলায় পুত্রকে ডাকছে-সেহান্দর.. ও সেহান্দর...
ওর ডাকের করুণ ধ্বনি প্রতিধ্বনীত হয়ে ফিরে আসছে নিজের কানে; কোনো প্রতিত্তুর নেই কোনোদিক থেকে। বিলের মাঝামাঝি যেতে যেতেই চারদিকে এমন করে আঁধার নেমেছ, একসময় পথই দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় যাচ্ছে নিজেই ঠাহর করতে পারছে না! তবু অলক্ষ্যে ছুটছে আর পুত্রের নাম ধরে ডাকছে, সেহান্দর... ও সেহান্দর, কই গেলি রে বাজান...
এদিকে রাত হয়ে গেছে, অথচ স্বামীকে এখনো বাড়ি ফিরতে না দেখে, আরেক শঙ্কা ঘিরে ধরে মরিয়মকে!। লণ্ঠন হাতে জমির দিকে বেরোয় মরিয়ম, স্বামী ও সন্তানের খোঁজে...
দুদিন পর্যন্ত সেকান্দরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরের দিন হঠাৎ খবর এলো- হাভাতিয়ার শেষপ্রান্তে, নদীর ধারে একটি জমির হাটুজলে পড়ে ছিল সেকান্দরের লাশ। এই ঘটনা এলাকার কারোই অজানা নয়।
এমন দূর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে হাভাতিয়ার বুকে। গেলবার কাশীপুরের মোক্তার মিয়া চাঁই(মাছ শিকারের ফাঁদ) পাততে গিয়ে পানি থেকে আর জীবিত ওঠতে পারেনি। তিনদিন পর ওর মৃতদেহ ভেসে ওঠেছিল ফোলে-ফেঁপে! পানিতে ভাসমান স্বামীর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তিন তিনটে কন্যা সন্তান নিয়ে কতই-না কেঁদেছিল মোক্তার মিয়ার স্ত্রীর! পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী লোকটিকেও কেড়ে নিল হাভাতিয়ার নিষ্ঠুর প্রেতাত্মা! এর পর বহুদিন ভয়ে মানুষ মাছ ধরতে যায়নি হাভাতিয়ায়। ওখানকার প্রেত্মাদের আছরে এমন ঘটনা ঘটে থাকে বলে এলাকার লোকজন ধারণা।
এমন বিবিধ কারণে সন্ধ্যার পর হাভাতিয়া থেকে কেউ ফিরে না এলে, পরিবারের লোকজন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, হন্যে হয়ে ছুটে যায় বিলে।
কোথাও জন-মানুষের চিহ্নও চোখে পড়ছে না। খালের ধার দিয়ে হেঁটে সন্তানদের ডাকছে বানেছা। অথচ কোথাও থেকে কোনো প্রতিত্তুর নেই। অজানা আশঙ্কায় তার মন ছটফট করছে! না জানি কোনো বিপদ হয়ে গেল কিনা সন্তানদের! না জানি ভূত-প্রেতের আছরে পড়েছে কি না, কে জানে!
বিলজুড়ে এক অশান্ত শূন্যতা! কোনো একটি বক কিংবা পানকৌড়িও চোখে পড়ছে না বানেছার! লোকালয় ছেড়ে এতটা দূরে চলে এসেছে যে, পেছন ফিরে তাকিয়ে গ্রামটিকেও আর দেখা যাচ্ছে না; আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে! বাড়ি ফিরবে কী করে? এদিকে ওর দুই সন্তান বিলে রেখে কী করে বাড়ি ফিরবে!
অস্থিরমনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকার মাঝে একসময় বিলের মাঝখানে এসে বানেছা দেখতে পেল- অদূরে একটি জমির হাঁটুজলে চারদিকে বাঁধ দিয়ে জলকেলিতে মেতে রয়েছে আঞ্জু ও ত্বোহা।
আঞ্জু বাঁধের একপাশে জাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ওদিকে মাছদের খেদিয়ে জালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ত্বোহা। কিন্তু বেলা যে ভাটি পড়ে আসছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। মাছ শিকারের নেশায় পড়ে সব ভোলে আছে।
দুর থেকে ওদের এমন কাণ্ড দেখে লাঠিহাতে ওদের দিকে তেড়ে যায় বানেছা। ভয়ে ঝড়সড় হয়ে দুজনে দাঁড়িয়ে আছে জালের পাশে, অসহায় চাহনিতে। নিকটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হেসে ত্বোহা বলে, দেখছো মা, তোমার জন্য কত মাছ ধরেছি!
কাছে গিয়ে ত্বোহার কান ধরে বানেছা বলে, তোদের মাছ ধরতে কেডায় কইছে? জলদি বাড়ি চল...
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন