রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

এমনিতেই মানুষের মন-মেজাজ ভালো নেই। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বহু আগেই। এখন শুধু আশাটুকুই সম্বল। তবে চারপাশে এ মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে, তাতে আশার সেই প্রদীপটাও জ্বালিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের হর্তাকর্তারা সকাল-বিকাল আইনের শাসনের কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও বাস্তবে কোথাও নিয়ম-নীতির বালাই নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনের রক্ষকেরাই ভক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন আছে। আইনের প্রয়োগও আছে। তবে তা অন্যের জন্য। নিজের লোক হলে সাত খুন মাফ। এমনই চলছে দেশের বর্তমান হাল অবস্থা।
ক্ষমতার বাইরে থাকলে সবাই পরিবর্তন চায়, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাদের হাবভাব বদলে যায়। তারা নিজেদেরকে আইন-কানুন, রীতি-নীতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। নিকট অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া দূরে থাক, বরং তারা বুক ফুলিয়ে বলতে শুরু করে আগের সরকার যা করেছে আমরাও তাই করব। ক্ষেত্র বিশেষে মন্দ কাজের প্রতিযোগিতায় আগের সরকারকেও ছাড়িয়ে যায় পরের সরকার। আর নানাভাবে তার বিষময় ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের জনসাধারণকে। নিত্যনৈমিত্তিক হাজারো দুর্ভোগের পাশাপাশি ছিনতাই হয়ে গেছে মানুষের মৌলিক অধিকারও। উদাহরণ অনেক। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের চাপে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর ওপর এসে লেগেছে মূল্যবৃদ্ধির প্রবল ধাক্কা। সেই ধাক্কায় বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির ভাড়া শুধু নয়, আরেক দাফ বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দামও। যানবাহনের ভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অনেকগুণ। দীর্ঘদিন থেকে এ অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে, গত ক’বছর যাবত জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ফলে বাড়তি উপার্জনের আশায় তারা এখন উ™£ান্তের মতোই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। এদিকে ঝুঁকিমুক্তভাবে বাড়তি অর্থ উপার্জনের সেই সুয়োগও সীমিত হয়ে আসছে ক্রমে।
আগে অনেকে নানা ধরনের সরকারি সঞ্চয়পত্রের উপর ভরসা করতেন। কিন্তু লাভের হার কমে যাওয়া এবং যৎসামান্য মুনাফার উপর নানাবিধ করারোপের কারণে হিতাহিত না ভেবেই তারা তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শেয়ারবাজারে। টাকার মালিকদের নানাভাবে শেয়ারবাজারে ঢুকতে বাধ্য কিংবা প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। অনেকটা খেদায় আটকে বুনো হাতি শিকারের মতো। তাদেরকেও সুকৌশলে আটকে ফেলা হয়েছিল গভীর খাদের মধ্যে। ফলে জ্বলন্ত চুল্লি থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে লাফিয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয় তাদের। নিজেদের আম-ছালা সবই তো গেছেই, সেইসঙ্গে নানা উৎস থেকে ধার-কর্জ করে আনা বিপুল পরিমাণ অর্থও উধাও হয়ে গেছে অনেকেরই। তারপরও পরিত্রাণ কী মিলেছে তাদের? অন্তর্নিহিত কারণ যা-ই হোক, নীতিনির্ধারকদের রহস্যময় নির্লিপ্ততাই এখন স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতা হল, দীর্ঘদিন থেকে ধনী-গরিব, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও পেশাজীবী থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত কেউ ভালো নেই। ভালো থাকার জন্য সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে স্থিতিশীলতা এবং ইতিবাচক অগ্রগতি দরকার তার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং রাজনীতির আকাশ আবারও মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। বছরের পর বছর ধরে কয়েক কোটি কর্মক্ষম মানুষ বেকার। তাদের কর্মসংস্থানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে প্রায় স্থবির হয়ে আছে শিল্পক্ষেত্র। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু সরকারি দফতরে ছুটোছুটি করে আর নীতি-নির্ধারকদের নানা প্রতিশ্রæতি শুনে শুনে স্থানীয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাও হয়রান হয়ে গেছেন। জ্বালানির অভাবে তাদের কারখানার চাকা ঘুরছে না ঠিকমতো। দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না তাদের জন্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নতুন নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে যারা সচল রাখবেন, সৃষ্টি করবেন ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ, তাদের অভাব-অভিযোগ শোনার মতো কেউ নেই। যাদের শোনার কথা তারা ব্যস্ত অন্য কিছু নিয়ে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন যে এটা মোটেও বেশি সময় নয়। তবে ভিন্নমতও আছে। তারা মনে করেন, সময়টা নেহাত কমও নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এখানে সময়ের হিসাব ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবকিছু সঠিকভাবে চলছে কি না সেটাই হল আসল বিষয়। চলার গতি যদি শ্লথও হয়, তবু দেশ ঠিক পথে চললে সাধারণ মানুষ স্বস্তি বোধ করে আর না চললে তারা উদ্বিগ্ন হয়, আতঙ্কিতও বোধ করে অনেক সময়। কারণ দেশের ভালোমন্দের সঙ্গে তাদের নিজেদের ভালোমন্দের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অবশ্য দেশে ‘অসাধারণ’ কিছু মানুষ আছেন, দেশ রসাতলে গেলেও যাদের কিছু যায় আসে না। তারা অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক তাদের অফুরন্ত ধন-সম্পদের আসল উৎসটি কোথায় তাও কারো অজানা নয়।
সকালে আকাশের অবস্থা দেখে যেমন বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে, দেশ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। মানুষ আশাবাদী। কিন্তু দেশ যেভাবে চলছে বা চলে আসছে গত ক’বছর ধরে তাতে সেই আশা বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি-সর্বক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। চুন খেয়ে বার বার মুখ পুড়লেও কারো মধ্যে ন্যূনতম বোধোদয়ের লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, আমাদের কপালটাই হয়তো খারাপ! কপালের দোষ দেওয়াতেই সবদিকে যেমন নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়ানো যায়, অন্যদিকে তেমনি অপ্রিয় ভাষণের জন্য কারো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসারও ভয় থাকে না।
আমাদের মত দেশে সম্ভাবনা যে অঢেল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সম্ভাবনা অঢেল না হলে বছরের পর বছর ধরে দেশ শাসনে শাসকদের উপর্যুপরি ব্যর্থতা সত্তে¡ও আমরা এতটা এগুলাম কী করে? সমাজ ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যে অনেকÑ তা যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি শাসকদের আত্মঘাতী কান্ড-কারখানা থেকেও মুখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
পৃথিবী বদলে গেছে। গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অর্ধশতক আগের আত্মকোন্দলে জর্জরিত শ্লথগতির সেই পৃথিবী এখন জাদুঘরে ঠাঁই নিতে চলেছে। পরিবর্তনের এই বিশ্ব মিছিলে শামিল হতে হলে আমাদেরও দ্রæত বদলানো দরকার। সাধারণ মানুষ তার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তার অকাট্য প্রমাণ হলÑ যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই তারা পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে। রাজনীতিকদের দিন বদলের ডাকে সাড়া দিয়ে বার বার নেমে এসেছে রাজপথে। রক্ত ও ঘামও ঝরিয়েছে অনেক। কিন্তু ফলাফল অভিন্নই থেকে গেছে । জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন হয়েছে। সবই হয়েছে ঠান্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে। কারা করেছে, কীভাবে করছে তা সকলেই কমবেশি জানে। আর ক্ষমতার কলকাঠি যাদের হাতে, তাদের আশীর্বাদ ছাড়া যে কিছুই হয় না তাও কারো অজানা নয়। কেলেঙ্কারি নিয়েও এখন যথারীতি চলেছে ব্যাপক কাদা ছোঁড়াছুড়ি। চাপানোর চেষ্টা চলেছে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। সবচেয়ে হৃদয়বিদায়ক বিষয় হলো, সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যাওয়া মানুষগুলোর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া হচ্ছে নির্দয়ভাবে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার জন্য পানি ঘোলা করার এ- কৌশলও নতুন নয়। কিন্তু ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। বরাবরের মতোই লুটেরা চক্রও থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা পরবতীকালে ক্ষমতাসীন কোনো কোনো সরকার সুপরিকল্পিতভাবে তাদের আজ্ঞাবহ কিছু ব্যক্তিকে টাকা বানানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কখনও শিল্পায়নের নামে, কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের নামে এবং কখনও বা উন্নয়নের নামে জনগণের সম্পদের অপচয় করা হয়েছে। ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতপুষ্ট হয়ে তারা কখনও সরাসরি জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সুকৌশলে। আবার কখনও বা নিজের করে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। উভয় ক্ষেত্রেই তার খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কারণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের জোগানও আসে জনগণের পকেট থেকেই। পাশাপাশি এও সত্য যে, প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও নিজেদের স্বার্থেই এক পর্যায়ে ঠিকই লাগামও টেনে ধরেছে তারা। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে, জনগণের পিঠ যে দেয়ালে ঠেকে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, নিকট অতীতের ইতিহাস থেকেও শাসকরা কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি বা করছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা নিজেদেরকে যতটা বুদ্ধিমান মনে কবেন, জনগণকে ঠিক ততটাই বোকা ভাবেন। ক্ষমতায় থাকা কালে জনগণকে তারা গ্রাহ্যই করেন না, এমনকি এটাও তারা ভুলে যান যে, গত কয়েক দশকে দেশ পরিচালনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকে দেশেই বসবাস করেন। আছেন আরো অনেক ডাকসাইটে লোক, ক্ষমতার অভিসন্ধি সব যাদের নখ দর্পণে। কোথায় কী হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, কিছুই তাদের অজানা নয়। তারা সবাই বুঝেন, সবই জানেন। যারা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন, তারাই বরং অভিজ্ঞজনদের চোখে হাস্যস্পদ হয়ে যান। মোটকথা নিজেদের মতলব চরিতার্থ করার জন্য যে বা যারা নানা কথাবার্তা বলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন, তারা জানেন না যে, এতে শেষ রক্ষা হবার নয়।
এখন কথা হল, সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। এ প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক সুনামি’ কিংবা ‘মহাপ্রলয়’-এর যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় একটাই। সেটি হলো, একটি অর্থবহ নির্বাচন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাতবদল। একই সঙ্গে প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত রাখা আর সর্বপ্রকার সীমা লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকা।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন