শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

বছরজুড়ে আলোচনায় চাঞ্চল্যকর খুন ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল চাঞ্চল্যকর খুন আর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। একাধিক জোড়া খুনসহ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। একই সময়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১ জেলায় খুন হয়েছে ৬৭৮ জন। মে মাস থেকে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে এ অঞ্চলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে অন্তত ২০ জন। তার আগের বছর চট্টগ্রাম নগরীতে ৭০টি এবং রেঞ্জে ৬২২টি খুনের ঘটনা রেকর্ড হয়। এ হিসেবে আগের বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে মহানগর এবং রেঞ্জে খুনের ঘটনা অনেক বেড়েছে। 

পারিবারিক কলহ, পরকীয়াসহ অনৈতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব আর ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঘটেছে বেশিরভাগ খুনের ঘটনা। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে নগরীর বন্দর থানার মেহের আফজাল উচ্চ বিদ্যালয়ে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সভাকালে খুন হন যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন মহিদ। আওয়ামী লীগ নেতা হাজী ইকবালের নেতৃত্বে তার ভাই, ছেলে ও দলীয় ক্যাডাররা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে তাকে। স্বাধীনতা দিবসে চাঞ্চল্যকর এ খুনের ঘটনায় তোলপাড় হয় নগরজুড়ে। এ মামলায় হাজী ইকবালসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। তবে বেশিরভাগ আসামি জামিনে বের হয়ে গেছে।
দলীয় কোন্দলে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে খুন হন সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা কর্মী ইয়াছির আরাফাত। একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার গ্রহণকালে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক কোন্দলের হত্যার পাশাপাশি পারিবারিক কলহ বিরোধেও ঘটেছে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নগরীর টাইগারপাস আমবাগানের ফ্লোরাপাস আবাসিক এলাকায় জোড়া খুন। দাদি মনোয়ারা বেগম (৯৭) ও ফুফু রূপালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা বেগমকে (৬৭) কুপিয়ে হত্যার পর লাশ পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেয় মুশফিকুর রহমান। ছোঁবেলায় বাবার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে বসেন মা। এরপর থেকে মুশফিককে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন দাদি এবং চিরকুমারী ফুফু মেহেরুন নিছা। ৮ লাখ টাকা না দেয়ায় এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটায় বখাটে মুশফিক।
নগরীর ডবলমুরিং থানার পাঠানটুলি গায়েবি মসজিদ এলাকার একটি বাসায় খুন হন মা মেয়ে। পুলিশের দাবি শাশুড়ি হোসনে আরা (৫০) ও স্ত্রী পারভীনকে (১৮) খুন করে পালিয়ে যায় স্বামী আবদুল মতিন। রাতে যেকোন সময় প্রথমে স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। এরপর বৃদ্ধ হোসনে আরাকে হত্যা করে লাশ বিছানায় ফেলে যাওয়া হয়। পরদিন খবর পেয়ে পুলিশ লাশ দু’টি উদ্ধার করে। খুনি হিসেবে আবদুল মতিনকে সন্দেহ করা হলেও এখনও আলোচিত এ মামলার রহস্য উদঘাঁন করা যায়নি।
পরকীয়ার জেরে নগরীর হালিশহর এলাকায় খুন হন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুমি ইসলাম। প্রথমে ছোঁপোলের একটি নালা থেকে সুমি ইসলাম মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দুইদিন পর সুমি ইসলামের স্বামী জাহিদ হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে খুনের দায় স্বীকার করেন জাহিদ। পরে তার দেখানো মতে হালিশহর রোডের বেপারী পাড়া পইট্যা দীঘির পাড়ের কবরস্থান থেকে সুমির বিচ্ছিন্ন মাথা উদ্ধার করা হয়। জাহিদ স্বীকার করেন, কারও সাথে পরকীয়া আছে এমন সন্দেহের বশে বন্ধু ও তার স্ত্রীর সহযোগিতায় সুমিকে হত্যা করেন তিনি। প্রথমে তাকে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অচেতন করা হয়। এরপর মস্তক বিচ্ছিন্ন করে লাশটি নর্দমায় আর খন্ডিত মস্তক কবরস্থানে রেখে দেয়া হয়।
নগরীর অভিজাত সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের মৃত্যুর রহস্য এখনও আড়ালেই রয়ে গেছে। বন্ধু আদনান মির্জার সাথে বেড়াতে গিয়ে লাশ হন তাসফিয়া। পতেঙ্গা সৈকত থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাসফিয়ার বাবা ব্যবসায়ী আমিন এ ঘটনার জন্য ছয়জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। তার অভিযোগ, তার প্রেমিকসহ আসামিরা তাকে নির্যাতনের পর হত্যা করেছে। তদন্তের পর পুলিশ তাসফিয়া আত্মহত্যা করেছে বলে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ঁ দিয়েছে। পুনঃতদন্ত চেয়ে আদালতে নারাজি দিয়েছেন তাসফিয়ার বাবা।
স্কুলছাত্রী ইলহাম হত্যারও রহস্য উদঘাঁন হয়নি। ২৭ জুন নগরীর বাকলিয়া সৈয়দশাহ রোডের ল্যান্ডম্যার্ক সোসাইটি এলাকার এমএস লায়লা ভবনের ৬ষ্ঠ তলার নিজ বাসায় গলা কেটে খুন করা হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ইলহাম বিনতে নাছিরকে (১২)। ইলহাম সাতকানিয়া ঢেমশা এলাকার সউদী প্রবাসী মো. নাছির উদ্দিনের মেয়ে। একজন শিশুকন্যাকে কারা কী কারণে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তা এখনও উদ্ঘাঁন করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের চাচির এক ভাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। এ ঘটনারও কোনো ক্লু পায়নি পুলিশ। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।
নিজ বাসায় শিশু সন্তানের সামনে খুন হন বিবি রহিমা। তার স্বামী চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী এহতেশামুল পারভেজ সিদ্দিকী জুয়েল। ১ আগস্ট বহদ্দারহাঁ ফরিদা পাড়ার নিজ বাসা থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় রহিমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের মা বেদুরা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে চান্দগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ খুনের রহস্যও এখনও জানা যায়নি।
১৫ মে রাত থেকে দেশব্যাপী শুরু হয় মাদকবিরোধী যুদ্ধ। শুরুতেই চট্টগ্রাম নগরীর বরিশাল কলোনীতে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে খুন হন দুই মাদক ব্যবসায়ী। এ ধারাবাহিকতায় অভিযানে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে অন্তত ২০ জন মাদক কারবারি প্রাণ হারিয়েছে। এসব বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। নিহত পরিবারের দাবি, বন্দুকযুদ্ধের আগে তাদের তুলে নেয়া হয়েছে। ২৫ জুলাই নগরীর খুলশী থানার রেলওয়ে ক্যান্টিন গেট এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হয়। পরবর্তীতে নিহত তিনজনের একজনকে ভারতীয় দাবি করে তার লাশ ফেরত চাওয়া হয় ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে।
১২ অক্টোবর রাতে নগরীর মুরাদপুরে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নগরীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী যুবলীগ নেতা অসিম রায়। এ সময় গুলিতে আহত হন চার র‌্যাব কর্মকর্তা। পরে তার কাছ থেকে দুটি বিদেশী অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। মাদক নির্মূলে দীর্ঘদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলে। দেশে মাদকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা। কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে নৌ, স্থল ও পাহাড়ি পথে আসা ইয়াবার চালান চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ইয়াবার ট্রানজিট পয়েন্ট চট্টগ্রাম হলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কোন শীর্ষ মাদকের কারবারিকে গ্রেফতার করা যায়নি। ফলে এখনও অক্ষত থেকে গেছে ইয়াবা পাচারের নেটওয়ার্ক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন