বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

স্বাধীনতা

শে খ দ র বা র আ ল ম | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

এক
সাতচল্লিশের মধ্যে আগস্টের অব্যাবহিত আগে আমার জন্ম। আমার শৈশব, বাল্য ও কৈশোর কেটেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে। ১৯৭১-এর আগে ভারতের মুসলমানদের অনেকেই মনে করতেন যে, তাদেরকে পাকিস্তানে যেতে হবে। কিন্তু সেই পাকিস্তানে গিয়ে জীবন ধারণ করে টিকে থাকার সুযোগ হতো স্বাধীন ভারতের খুব কম মুসলমানের। নাগরিকত্ব না পেয়ে, নাগরিকত্ব না পাওয়ার কারণেও আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির সংস্থান করতে না পেরে অনেকেই ফিরে যেতেন। এ সব জানা সত্তে¡ও অনেকেই আসতেন অনেক আশা নিয়ে। এই আশা নিয়ে আসার ব্যাপারটা মোটামুটি বন্ধ করে দিতে পেরেছে ১৯৭১। সেই একাত্তরকে এখনকার অনেক মুসলমান যেভাবে দেখতে চেয়েছেন সেভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে স্বাধীন ভারতের মুসলমানদের অভিজ্ঞতা সায় দেয়নি। তবে তারা চান যে, ভারতীয় উপমহাদেশের একাত্তরের মুসলিম প্রধান দেশে দুটোর মুসলমানরা প্রকৃত স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করার সুযোগ দেন পান।
দুই
১৯৬৯-এর যে আন্দোলনের কথা বলা হয়, সে সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইকবাল হলে। তখন স্বনামধন্য ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব ভাই, তোফায়েল আহমদ ভাই, নূরে আলম সিদ্দিকী সাহেব ইকবাল হলেই থাকতেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন সাহেব তখন সম্ভবত জিন্নাহ হলে থাকতেন। শাহজাহান সিরাজ সাহেব কোন হলে থাকতেন জানি না। তবে তাকে কখনো কখনো নিচতলায় আমার বন্ধু এ কে এম কামাল উদ্দিনের ১০৮ নম্বর রুমে থাকতে দেখেছি। এ কে এম কামাল উদ্দিন ফরিদপুরের মানুষ।
আমি থাকতাম ইকবাল হলের তিনতলায় ৩২৮ নম্বর রুমে। সে সময়কার বিখ্যাত ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ ভাই থাকতেন ৩১৪ নম্বর রুমে। খুব কাছেই। তিনি প্রায়ই গোসল করে নারিকেল তেল মাখতে আমার রুমে আসতেন। ডেফোডিল নামে নারিকেল তেলের শিশি কিনতাম আমি। অত্যন্ত ব্যস্ত ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ সাহেবের এই তেল, টেলের মতো সামান্য জিনিস কেনার অবসর তখন সম্ভবত ছিল না। বড় বড় সভায় দেখতাম তার ভ‚মিকা ছিল যথার্থ নেতার মতো। দু-একদিন সন্ধ্যায় বা রাতে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে মিটিংয়ে আমাকে তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছেন। নূরে আলম সিদ্দিকী সাহেব মাঝে মাঝে আমার রুমে আসতেন পড়াশোনার কাজে। তিনি আমাকে ‘মিতে’ বলতেন। আ স ম আব্দুর রব ভাইয়ের কথাবার্তাও আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। কিন্তু শৈশব থেকে আজো আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হইনি। কোনো রাজনীতি করার মতো কোনো মানসিক যোগ্যতাও আমার নেই।
তিন
কোনো দেশের এবং কোনো সমাজের বিরুদ্ধেও আমি নই। কোনো রকম জাতীয়তাবাদী নই আমি। আক্ষরিক অর্থেই সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ আমি। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং সংবেদনশীল মনের মানুষ আমি পছন্দ করি। তবে এটাও জানি যে, ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বিশ্বের মুসলমানদের স্বাধীনতার ব্যাপারটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে ইতিহাসটা জানতে হবে।
আমাদের সমাজের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাটা জানতে হবে। জাতীয়তাবাদ কী, এক জাতিতত্ত্ব কী, সাম্প্রদায়িকতা কী, ফ্যাসিবাদ কী, এসবও সঠিকভাবে জানতে হবে। আর এটাও জানতে হবে যে, কোনো দেশে অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের এ বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোাষ্ঠীর, বিভিন্ন বর্ণের বা গায়ের রঙের মানুষের বিভিন্ন এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্থান না থাকলে সব মানুষ কার্যত স্বাধীন হন না। সেটা এখন এ দেশেও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে দেখছি। বিষয়টা সবার ভেবে দেখা দরকার।
চার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থেকে আমি যখন এম এ পড়তাম, তখন আমি আমার খরচ চালাতাম বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার মুনীর চৌধুরী সাহেবের মেজো ছেলে আশফাক মুনীর (মিশুক) আমার ছাত্র ছিল। এটা ঠিক করে দিয়েছেন ডক্টর আনিসুজ্জামান সাহেব। এ দুজন মানুষ আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমার শ্রদ্ধেয় অভিভাবকপ্রতিম শিক্ষক আনোয়ার পাশা এবং সাহিত্যিক অধ্যাপক শওকত ওসমান সাহেবও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আমি ধানমন্ডিতে একটা উর্দ্দুভাষী মুসলিম পরিবারের মেয়েকেও পড়াতাম। সূত্রাপুর এলাকায়ও একটা ছেলেকেও পড়াতাম। মূলত এভাবেই আমি আমার খরচ চালাতাম তখন।
পাকিস্তান আমলে আমি নাগরিকত্ব পাওয়ার একটা চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি। বিশাল স্বাধীন ভারত থেকে ছোট্ট পাকিস্তানে মুসলমানদের আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে সম্ভবত পাকিস্তান সরকারের একটা নীতি ছিল। অন্য দিকে পাকিস্তান থেকে হিন্দ-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের কেউ ভারতে গিয়ে থাকতে চাইলে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে কারো কোনো অসুবিধা কখনোই হতো না। কেন এমন হয়, এর জবাব আছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের ইতিহাসে বিশেষ করে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের ইতিহাসে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে ও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্তে¡। এম এ পাস করার পরও বহুদিন আমি এসব জানতাম না। আমাদের এই সমাজহীন মুসলমান সমাজের কারো কাছ থেকেই এসব জানার সুযোগ আমার হয়নি। এসব জেনেছি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের গুণীজনদের লেখা বইপত্র পড়ে এবং কখনো কখনো তাদের কারো কারো কথাবার্তা জেনেও। এ সব জানার এবং জানবার ও বোঝাবার যোগ্যতা আমাদের সমাজহীন মুসলমান সমাজ এখনো অর্জন করেনি।
পাঁচ
এম এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর একটা সময়ে আমার ইকবাল হলে থাকার মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আমি বিএড-এ ভর্তি হয়েছিলাম। পার্ক সার্কাস এলাকায় সেন্ট জেভিয়ার্স হোস্টেলে থাকতাম। ওই হোস্টেলে থাকতেন প্রধানত হিন্দু এবং অ্যাংলোইন্ডিয়ান ছেলেরা। আমি সে সময় কলকাতার ৪৩ নম্বর রিপন স্ট্রিটস্থ সেন্ট আগাস্টাইনস ডে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছি। আমার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সহপাঠী সি আর গ্যাসপার ছিলেন ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল। সে সময় ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছেলেরা, লেডি ব্রাবোন কলেজের মেয়েরা এবং নিকটস্থ ব্যানার্জি বিল্ডিংয়ের এক্সপ্লোরার ক্লাবের ছেলেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল বের করেছিলেন। নিউমার্কেট এলাকা, এসপ্লানেড, কলেজ স্ট্রিট হয়ে সে মিছিল বালিগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছিল। মোড়ে মোড়ে থেমে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিল। আমি সেই টুলের ওপর দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী, পোড়াময়ী ভাষায় কত বক্তৃতাই না দিয়েছি! মিছিলের স্লোগানগুলোও মূলত লিখে দিয়েছিলাম আমি। সব্যসাচী সেনগুপ্ত নামে একটা ছেলে এ বিষয়ে ছিলেন খুবই সক্রিয়। তার ছোটভাই সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তও খুব সক্রিয় ছিলেন। সেই মিছিল ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে পর পর তিন দিন বের হয়েছিল।
মিছিলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য টাকা-পয়সা সংগ্রহ করা হতো। পরে বিভিন্ন সময়ে পোশাক-পরিচ্ছদ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা হতো। এর পরে হেলমেট, সাইক্লোস্টাই মেশিন, এসবও কিনে পাঠানো হয়েছিল। এসব কাজেও আমি দু-এক দিন ছিলাম ওদের সঙ্গে। মিছিলে তিতুমীরে বাংলাদেশ, সূর্যসেনের বাংলাদেশ এসব স্লোগান দেয়া হতো। আজ ভাবী, তখন কী-বা বুঝতাম আমি! আমি তো এ বিষয়ে অজ্ঞই ছিলাম। কোনো বিষয়ে একটা গণমন সৃষ্টি হলে মানুষ অজ্ঞার মধ্যেও অনেক কিছু করে!
১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে ঢাকায় ফিরছিলাম। ইকবাল হল ইতোমধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল হয়ে গেছে। আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু এ কে এম কামালউদ্দিন ইতোমধ্যে ঢাকায় ফিরে জহুরুল হক হলের ১০৮ নম্বর রুমে ছিলেন। তার কাছেই উঠলাম। ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিজি হাসপাতালে নূরে আলম সিদ্দিকী সাহেবকে দেখতে গেলাম। উনি বললেন, ‘মিতে সাংবাদিকতা করবেন?’ উনিই পাঠালেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সাহেবের কাছে তার কাকরাইলের বাড়িতে। মইনুল হোসেন সাহেব পরদিন ইত্তেফাকে যেতে বললেন সকাল ৯টায়। প্রথমে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলাম। দেড় মাস পর কনফারমেশন লেটার পেলাম। মইনুল হোসেন সাহেব এই অবস্থায় আমাকে দিয়ে জেনারেল অ্যামনেস্টির ওপর এডিটোরিয়াল লেখালেন। কনস্টিটিউশনের ওপর এডিটোরিয়াল লেখালেন। বাণিজ্যনীতির ওপরও এডিটোরিয়াল লেখালেন।
শিক্ষানীতির ওপর পোস্ট এডিটোরিয়াল লেখলাম। ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ওপর কলাম ‘বৈদেশী’ লেখারও দায়িত্ব দিলেন। প্রথম দিকে স্বনামে লিখতাম। পরে একটা ছদ্মনাম ঠিক করতে বললেন। ‘সুমন্ত’ ছদ্মনামে লিখতাম। দৈনিক ইত্তেফাকের পুরোনো ফাইলে নিশ্চয়ই সেসব লেখা আছে।
আমার নিজের সম্পর্কে কথা এই পর্যন্তই থাক। ১৯৭১-এর জানুয়ারির আগে থেকে ১৯৭২-এর জানুয়ারি পর্যন্ত আমি ঢাকায় ছিলাম না। ওই সময় পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কেও আমার কোনো জ্ঞান-গম্যি ছিল না। অন্তত ১৭৫৭-এর ২৩ জুন থেকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়কার ইতিহাস আমাদের সবার জানা দরকার। এই ধারাবাহিকতার বা পরম্পরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পরবর্তী কালের ইতিহাসটা চর্চা করা দরকার বা দেখা দরকার। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে এই একশ’ নব্বই বছরের ইতিহাস চর্চার একটা বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে আমাদের সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চার, ধর্মীয়, সংস্কৃতির পরম্পরা চর্চার এবং সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা চর্চার এবং আমাদের সমাজের মহৎ মানুষদের জীবনৈতিহাস চর্চার এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীতাদি চর্চার একটা উপযুক্ত সংস্থান থাকা দরকার। এসব চর্চার অভাবে এ দেশের মুসলমান ঘরের সন্তানরা দ্রুত মনের সংবেদনশীলতা, মনুষ্যত্ববোধ ও ঔচিত্যবোধ হারাচ্ছেন। সুস্থ জীবনবোধ হারাচ্ছেন! আসমান-জমিন অর্থনেতিক বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয়া দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, মূলত অর্থনৈতিক অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশঙ্কাই ছিল সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, ১৭৫৭-এর ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের অব্যাবহিত পর থেকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা, বিশেষত বাংলা বিহার উড়িষ্যার মুসলমানরা সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। ভিপি মেনন প্রণীত প্ল্যান পার্টিশন মোতাবেক সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের বিভাজনে ব্রিটিশ ভারতের ২০ শতাংশ জায়গা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ১০ শতাংশের মতো জায়গা দিয়ে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ব্রিটেনের ভ‚-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে সাময়িকভাবে সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান নামে একটি মুসলিম প্রধান দেশ। ব্রিটেনও চেয়েছিল শক্তিশালী ভারত এবং সেই প্রেক্ষিতেই দুর্বল এবং অস্থায়ী পাকিস্তান! হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত কায়েম করার আকাক্সক্ষায় সে সময় পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মুনসংহিতার সমাজও চেয়েছিলেন দুর্বল এবং অস্থায়ী পাকিস্তান। ফলে সে সময় তারা ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে পাকিস্তানের পাওনা ৫৫ (পঞ্চান্ন) কোটি টাকা আটকে দিয়েছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের এই নবজাতক মুসলিম প্রধান দেশটি ১৯৪৭-এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের এই দুমাসের বেতনও তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে পারছিল না। ১৯৪৭-এর অক্টোবরে হায়দরাবাদের নিজাম ২০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ায় তখন বেতন দেয়া এবং অন্যান্য সরকারি খরচ চালানো গিয়েছিল। ১৯৪৪-এ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র উদ্যোগে মুসলমান ব্যবসায়ীদের বর্ণিক সমিতি গঠিত হয়েছিল। এই মুসলমান ব্যবসায়ীরাই শুরুতে মুসলিম প্রধান দেশটি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারকে তখন ঋণ দিয়েছিলেন। যথার্থ ইতিহাসচর্চা এসব বাস্তবতার কথা স্মরণ রেখেই করা দরকার।
সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টে মুসলিম প্রধান দেশটি পেয়েছিল একদিকে ২২টি মুসলিম ধনী পরিবার এবং অন্যদিকে হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত মুসলমানদের একটি সমাজহীন মুসলমান সমাজ। আর রাজনৈতিক নেতাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ১৯৪৭-এর মধ্য ডিসেম্বরের পরবর্তী পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে মুসলিম লীগের বাইরে অনেক দলের মাধ্যমে যে ক্ষমতা হস্তগত করতে চাইবেন সেটাও তো ছিল খুবই স্বাভাবিক। নির্বাচিত সরকার না থাকলেও বাকস্বাধীনতা নিয়ে অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। সে সাক্ষ্য সে সময়কার দৈনিক এবং সাময়িকপত্রগুলোই দিতে পারবে। যা ইতিহাস নয়, এমন অনেক কথা আমি সে সময়কার ‘সমকাল’-এর মতো সাময়িকপত্রে ১৯৬৯-এ পড়েছি। তখন বুঝিনি। পড়াশোনার কারণে এখন বুঝতে পারি। এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে। সে কথা থাক।
মূল সমস্যাটা ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা। ১৯০ বছরের অধিকারবঞ্চিত মুসলমানদের জন্য সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে এই অবস্থায় অন্য একটা জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির এবং সেই জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ ছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর আগের ১৯০ বছরের মুসলমানদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে প্রণীত হয়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের প্রতিষ্ঠিত জনদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার অনেক প্রকাশিত গ্রন্থে দেখিয়েছি যে, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজের তরফে মাহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদগান্ধী, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মাধ্যমে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের বিভাজনটা ঘটানো হয়েছিল তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত কায়েম করার আকাক্সক্ষায়। সিমলায় পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই এবং ভিপি মেননের মাধ্যমে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতামত নিয়েই ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন প্ল্যান বলকান ত্যাগ করে প্ল্যান পার্টিশন প্রণয়ন করেছিলেন ভিপি মেননকে দিয়েই। নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভা (১৯১০), ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (১৯২০) ফরোয়ার্ড বøক (১৯৩৯), রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ আরএসপি (১৯৪০) প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠন ছিল অনুশীলন সমিতি (১৯০২), যুগান্তর দল (১৯০২) ও অন্যান্য আধাসামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবাধীন।
আর ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের অব্যাবহিত পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম প্রধান দেশে অন্য ভাষাভাষী প্রধান মুসলিম প্রধান প্রদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে, মুসলিম উম্মার ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের যুগান্তর দলের সভ্যদের ও অন্যান্য আধাসামরিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের, যুগান্তর দলের সভ্যদের ও অন্যান্য আধা সামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল ও অন্যান্য আধাসামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবাধীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যদের প্রভাবে।
এভাবে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা কর্মীরা কেবল জাতীয়তাবাদী বলে অভিহিত সংগঠনগুলোর ওপর নয়, মার্কসবাদী বা সাম্যবাদী বলে পরিচিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। ১৯৭১-এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ১৯৭১-এর পরের পাকিস্তানে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। তাই সেখানকার কথা বলতে পারব না। কিন্তু হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ এবং ১৯৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মার্কসবাদ তথা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সমস্ত সম্ভাবনারই অবসান ঘটিয়ে দিয়েছে। ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে সেটা স্থায়ী করেও দিয়েছে।
ভারতে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শসস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন মুসলমানরা। আর হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্তের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত হয়ে আছে ইসলাম অর্থাৎ মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিক পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্ত্বা।
অন্যদিকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পরবর্তী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মুসলিমপ্রধান দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রধান মুসলিমপ্রধান প্রদেশের মুসলমানদের, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিকে এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরাকে এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তাকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করার এই বাংলাভাষী প্রধান মুসলিমপ্রধান দেশের মুসলমানদের মধ্যে তাত্তি¡কভাবে কার্যত একটা স্থায়ী ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা বজায় থাকলে ভারতে এবং বাংলাদেশে মার্কসবাদ বা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নেই। যখন এই কথাগুলো লিখছি তখনই ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর পঞ্চম পৃষ্ঠায় “রাজনীতির অনেকটাই এখন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে” শিরোনামে প্রতিবেদনে দেখছি লেখা হয়েছে।
‘রাজনীতি এখন অনেকটাই ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে। রাজনীতির উঁচু পর্যায়ে যারা রয়েছেন, অর্থনীতির একটা অংশ তাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এতে শুধু তাদেরই সুখ-সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে’।
‘দেশে মানবাধিকারের অবস্থা ভালো নয় উল্লেখ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সমাজে অসমতা বাড়ছে। ধনীরা দ্রুত আরো ধনী হচ্ছে, গরিবেরা আরো গরিব হচ্ছে। কতগুলো মৌলিক অধিকার থেকে অনেকেই বঞ্চিত। সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ধনীরা এগিয়ে, কিন্তু গরিবেরা তা পায় না। সুশাসন নেই বলে মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।’
সাত
সেই ১৭৫৭-এর ২৩ জুনে পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসন মঞ্চায়নের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের প্রথমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং পরে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলার ফলে এ দেশের মুসলমানরা একসময় তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছিলেন। একসময় শিক্ষার অধিকারও মুসলমানরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় পাদে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সরকারের সহযোগিতায় উচ্চবর্ণের সুবিধাভোগী শ্রেণীর হিন্দুরা হিন্দু কলেজসহ যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছিলেন, সেগুলোর কোনোটিতেই ১৮৫৫-এর আগে মুসলমান শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাতীয়তাবাদী খ্রিষ্টান সমাজের লোকদের প্রতিষ্ঠিত লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে ১৯১০ সালেও কোনো মুসলমান মেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। যথার্থ রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, এসব অনেক কিছুই জড়িত। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশের ১০ শতাংশ জায়গায় যখন একটা মুসলিমপ্রধান দেশ সাময়িকভাবে দেয়া হয়েছিল তখন অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত সমাজহীন সমাজের মানুষ। এই অবস্থায় একটা দেশ বাইরের দিক থেকে মোটামুটি স্বাধীন থাকলেও অন্ধকারে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। এই অবরুদ্ধ হয়ে থাকার একটা বড় প্রমাণ ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম প্রতিসত্তা সংশ্লিষ্ট কোনো লেখা পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অবশ্য পাঠ্য ছিল না জাতীয় কবির লেখাও।
ভারতীয় উপমহাদেশের যে কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে এসব গভীরভাবে খতিয়ে দেখে নীতি প্রণয়ন করা দরকার এবং উপযুক্ত ও সৎ মানুষদের এসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া দরকার।
লেখক : নজরুল গবেষক, সাহিত্যিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন