শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

নববর্ষ উদযাপিত হোক আনন্দে ও গৌরবে

হো সে ন মা হ মু দ | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

মানুষ তার সুবিধার জন্য সময় গণনা করে। সময় তো কালের অংশ, আর কাল নিরবধি। পক্ষান্তরে মানুষের জীবন স্বল্পকালের। মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে, বহু দুর্লঙ্ঘ্য বাধাকে জয় করেছে। কিন্তু একটি বিষয়ে মানুষ চির-ব্যর্থতার শিকার হয়েছে। মানুষ অমর হতে পারেনি। কোনো মানুষ সর্বোচ্চ পঞ্চাশ বছরের বেশি সক্রিয় কর্মজীবন অতিবাহিত করেছে, এ রকম নজির বেশি নেই। তবে জীবন ও কর্মকালের মধ্যেই মানুষ মহাকালের বুকে তার স্মৃতিচিহ্ন এঁকে যেতে চায়। মানুষের এ সাধ, অদম্য প্রচেষ্টা কখনো কখনো সফল হয়েছে। কখনো অবিস্মরণীয় কীর্তি প্রতিষ্ঠা বা দোর্র্দন্ড প্রতাপ শাসনের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটেছে। যেমন মিসরের পিরামিড তৈরি ও মৃতদেহকে অনন্তকাল অবিকৃত রাখার চেষ্টা। অন্যদিকে ইতিহাসের পাতায় নিন্দা ও ঘৃণার কালো চাদরে ঢাকা পড়েছে বিশ্বের এক বিরাট এলাকাজুড়ে হত্যা-ধ্বংসের ক্ষতের দাগ রেখে যাওয়া শাসকরা যেমন চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং প্রমুখ।
মানুষ যেহেতু সময়কে হিসেবের মধ্যে রাখার জন্য প্রধানত বছরের সীমায় চিহ্নিত করেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার কর্মকান্ড মূল্যায়নের জন্য একটি বছরকেই ধরা হয়। একটি বছর শেষ হয়, সে সাথে শুরু হয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের সালতামামি। এখানে বলা দরকার, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন প্রত্যাশা করে। কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য যে বেশিরভাগ মানুষেরই এ প্রত্যাশা পূরণ হয় না। প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি জনগোষ্ঠিতে, প্রতিটি রাজ্যে এ রকম মানুষের দেখা মেলে যারা উচ্চাভিলাষী, হিংস্র, কুটিল ,স্বার্থপরায়ণ, নির্মম, মানবিক বোধহীন। তারা সংখ্যায় কম, কিন্তু এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় ক্ষমতার বোড়ে, তারপর শুরু করে ইচ্ছে ও উচ্চাশার ঘোড়া দাবড়ানো। তাদের শক্তিশালী ঘোড়ার পদাঘাতে বাকি মানুষগুলো ভয়ে কুঁকড়ে যায়। নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় শক্তিমানের দাপটের কাছে। বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম নুয়ে পড়া দেশ ও জনসমাজের প্রচুর চিত্র আছে। কখনো কখনো কোথাও কোথাও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে বলে দেখা যায়। তখন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জনজীবনে সাধা হয়েছে নতুন সুর ও বাণী। যেমন ফরাসী বিপ্লব। তবে এমন ঘটনার সংখ্যা বেশি নয় বলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থেকেছে, স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়নি। আর সকল ক্ষেত্রে তা স্থায়িত্বও লাভ করেনি।
পৃথিবীতে মোটামুটি সুখী জনসমাজের সংখ্যা একোরে কম নয়। বিশেষ করে প্রায় গোটা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলেশিয়া মহাদেশের বড় অংশ এবং এশিয়ার কিছু দেশে সাধারণ বিচারে মানুষ ভালো আছে। এসব দেশে আছে যোগ্যতম নেতৃত্ব, সম্পদ প্রচুর বলে নেই দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব, আছে আইনের শাসন ও মানবাধিকার। তাই তারা ভালো আছে। আর ভালো থাকলে তাদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই একটি বছর শেষে যখন নতুন আরেকটি বছর বরণের সময় আসে, তারা প্রচুর আনন্দে সে বরণোৎসবে যোগ দেয়। কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এর বিপরীত চিত্র। সম্পদের অভাব, বেকারত্ব, হতাশা, জীবন গঠনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের জীবনের আনন্দ অনেকটাই ম্লান করে দেয়। বর্ষবরণের মত আনন্দোৎসব তাদের অনেকের কাছেই অন্যায্য ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
তবে মানুষের জীবন নদীর মতই প্রবহমান। স্রোত হারিয়ে মৃত নদীতে পরিণত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নদী যেমন কোনোমতে বয়ে চলে, মানব জীবনও সে রকমই। আশাহীনতা, অনুজ্জ¦ল আলো, অতলান্ত সমস্যা বহু মানুষের জীবনকে খড়কুটোতে পরিণত করে। এর মধ্যে যারা ঝরে যাবার ঝরে যায়, আর বাকিরা দিন পাড়ি দিয়ে চলে জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর জন্য। তারা নতুন বছরের প্রাক্কালে উপনীত হয়ে দেখতে পায়, যে একটি বছর তারা ফেলে এল, সে বছরটি তাদের জন্য আশার বার্তা বয়ে আনেনি। হতাশার গভীর খাদে ডুবে থেকে তাদের অনেকের মনে এ কথাটা ঘোরাফেরা করে- নতুন বছরটি তো ভালো হতেও পারে। অনেক কিছু হয়ত পাল্টেও যেতে পারে। তবে দিন পাল্টাক আর না পাল্টাক, এই যে হৃদয়ে আশার উঁকি, এভাবেই বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে নববর্ষের সলজ্জ উপস্থিতি ঘটে।
পূর্বের অতীত বছরগুলো কথা বাদ দিই, আমরা সদ্য বিগত ২০১৮ সালের দিকে তাকাই। বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের পর এ রকম শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে আর পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাসে জনগণের মোটা দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার কথা সবারই জানা, কিন্তু সহিংসতার তীব্রতা ও নির্মমতার এমন কূল উপচানো রূপ আগে আর কখনো চোখে পড়েনি। প্রতিপক্ষের প্রতি এমন কঠোর-কঠিন হামলা ও নিঃশেষ করে দেয়ার এমন ভয়াবহতা অভ‚তপূর্ব। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করা যায়। এমন নীতিহীন ও ঘৃণ্য হামলা বাংলাদেশে এর আগে ঘটেনি। তবে যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও ঢাকায় রমনার বটমূলে বহু লোকের মৃত্যুর কথা স্মরণ করা যায়। আবার ৬৩টি জেলায় বোমা হামলার নৃশংসতার বিষয়ও স্মরণযোগ্য। এসব হামলা মানুষকে স্থবির করে দিয়েছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে এগুলোর সেখানেই ইতি ঘটেছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে দেশে যা ঘটছে তার কোনো ইতি-অন্ত নেই। বিরোধী দলগুলোর উপর যেভাবে দমন, নিপীড়ন চলেছে এবং এখনো চলছে নেই তার কোনো ব্যাখ্যা। এমন চিত্রও কেউ আর দেখেনি। আওয়ামী সমর্থকরা সুখে-শান্তিতে পাঁচটি বছর পার করলেন। তাদের গায়ে কেউ ফুলের টোকাটিও দেননি- না পুলিশ ভাইয়েরা, না মাস্তানরা। সারাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তার সুফল তাদের কাছে এসে হামলে পড়েছে। এত প্রকল্প গ্রহণ ও সেগুলোর জন্য দেদারসে অর্থ বরাদ্দের এত জোরালো স্রোত দেশে আর বয়নি কখনো। অবশ্য নিন্দুকেরা বলেন, নিজের লোকদের অর্থপুষ্ট করার জন্যই এসব প্রকল্প। আর বিরোধী দলের যারা তারা মামলা, রিমান্ডের কাঁটার মালা গলায় পরে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন। তাদের কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই বলে নিষ্ফল আক্ষেপ করেন। দেশের চোর-ডাকাত, খুনি, ধর্ষকরাও পুলিশের এমন গ্রেফতার, হেনস্তার শিকার হয় না। বিরোধী নেতা-কর্মীদের অবস্থা যেন সরকারী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের তুলনায় প্রখ্যাত ভারতীয় গায়ক অখিলবন্ধু ঘোষের গাওয়া সেই ভীষণ জনপ্রিয় গানেরই প্রতিধ্বনি- ‘তোমার ভুবনে ফুলের মালা, আমি কাঁদি সাহারায়।’
অনেক প্রতীক্ষা ও ঝড়-ঝাপটার পর বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের সাথে নির্বাচনে এসেছে। যা প্রয়োজন ছিল- সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এত চেয়েও পাওয়া গেল না। রক্ত, হামলা-গ্রেফতারে জেরবার হয়েও নির্বাচনী প্রবাহে তারা পথ হেঁটেছেন। অথচ এ নির্বাচন ও নতুন বর্ষের পূর্বদিনগুলো, তাদের জন্য, দেশের সর্বশ্রেণির জনগণের জন্য সত্যিকার আনন্দ ও উৎসবমুখর হতে পারত।
নববর্ষ জীবিত মানুয়ের জন্য প্রতিবছরই আসবে। এ নববর্ষে বিশ্বের আরো বহুদেশের মত বাংলাদেশের মানুষও আনন্দে উদ্বাহু হয়ে দিনটি যাপন করতে পারে। সে জন্য চাই সুব্যবস্থা, সহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মুক্ত একটি দেশ। আমরা সব সময় যা আশা করি তার অনেক কিছুই হয় না। তারপরও জীবন প্রবাহে ভেসে চলা মানুষ দিন পাড়ি দেয়। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মিশেলে মানুষ পা ফেলে। উচ্চাকাঙ্খীরা নতুন ইতিহাস তৈরি করতে সচেষ্ট হয়। তখন তার সামনে অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে দূর দিগন্ত, ক্ষুদ্র স্বার্থ, নীচতা-হীনতা নয়।
বাংলাদেশ বিগত সাতচল্লিশ বছরে অনেকদূর এগিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বলে দেশ-বিদেশের ভাষ্য শোনা যায়। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে যাওয়ার জন্য কেন মরিয়াপ্রায়, তার কোনো জবাব মেলে না। আমার দেশ আমার অহঙ্কার এই স্লোগান কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা প্রাণের আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই। তাই নববর্ষ উদযাপন হোক সর্বজনীন আনন্দ ও গৌরবে।

লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন