মানুষখেকো হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর নদীখেকোরা। বাঘ মানুষ খেলে একজনের প্রাণ যায়; কিন্তু একটি নদী দখল হলে হাজার হাজার মানুষের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। নদীখেকোরা বিত্তবৈভবের সাগরে ডুবে থাকতে প্রাণীকুলের জন্য আল্লাহর দান প্রকৃতির সম্পদ নদ-নদী দখল করে পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এর পরিবেশে বিরুপ প্রভাবে সাধারণ মানুষ, প্রাণীকুল, উদ্ভিদ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। সমাজের বৃত্তশালী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মানুষরুপী নদীখেকোদের নিয়ন্ত্রণ দূরুহ হয়ে পড়েছে। একদিকে উজান বাঁধ দিয়ে ভারত পানি তুলে নেয়ায় দেশের শত শত নদী শুকিয়ে গেছে; অন্যদিকে নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ ও নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলায় সংকুচিত হচ্ছে এবং নদীর পানি হয়ে পড়েছে ব্যবহারের অনুপযোগী। প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্থ এবং নদীখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় নানা চেষ্টা করে তাদের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট নদীখেকোদের লাগাম টেনে ধরতে গতকাল ঐতিহাসিক নির্দেশনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে এই রায় বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া রায়ের কপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর নির্দেশও দিয়েছেন। এদিকে পরিবেশবাদীরা এই রায কার্যকরের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
হাইকোট নির্দেশনায় বলেছেন, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নদ-নদী দখলের অভিযোগ উঠলে তিনি এখন থেকে সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণও পাবেন না বলে মর্মে নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা (লিগ্যাল পারসন) ঘোষণা করে হাইকোর্টের এক রায়ে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রায়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ ১০ দফা নির্দেশনাও দিয়েছেন। এর আগে নদী নিয়ে লুকোচুরি না খেলার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশনা দেন আদালত।
টানা তিন দিন ধরে ঘোষণা করা রায়ে গতকাল রোববার তুরাগ নদী রক্ষায় রিট মামলার বিচার শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক আদেশ দেন। গত বুধবার রায় ঘোষণা শুরু করেন। ওই দিন পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, দেশে শত শত নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫০ নদ-নদী অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত। এসব নদী দখলকে কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক মামলা হয়, পৃথক পৃথক আদেশ হয়। দখলদাররা ফের গিয়ে দখল করে, এমনটি চলতে দেয়া যায় না। আমরা সব একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চাই। নদ-নদী নিয়ে এসব কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। পরদিন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আইনজীবীর বক্তব্য উপস্থাপন ও পর্যালোচনার জন্য সময় দিয়ে রোববার অসমাপ্ত রায় ঘোষণার দিন রাখা হয়।
আদালতে মামলার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ; তাকে সহায়তা করেন অ্যাড. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী, এ্যাড. একলাছ উদ্দিন ভূইয়া, এ্যাড. রিপন বাড়ৈ ও এ্যাড. সঞ্জয় মন্ডল। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পূরবী রানী শর্মা ও পূরবী সাহা। বিআইডব্লিউ পক্ষে মফিজুর রহমান। রাজউকের পক্ষে মো. ইমাম হাসান।
শুনানিতে মনজিল মোরসেদ বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তে প্রায় ৩৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ স্থাপনা রয়েছে এ মর্মে চীফ জুডিসিয়ালর ম্যাজিস্ট্রেট জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেন, ৩৫০৩/ ২০০৯ রায় অনুসারে নদীর সীমানার জায়গা ক্রয় সূত্রে অন্যোর মালিকানা স্বত্ব সৃষ্টি হয় না। আদালতের নির্দেশে অনুসারে রিটের প্রেক্ষিতে যে জরীপ সম্পাদন হয়েছিল তা হাইকোর্ট গ্রহণ করে প্রশংসা করেছেন। ওই রায়ের নির্দেশনা অনুসারে সিএস ম্যাপকে ধরে জিপিআরএস পদ্ধতিতে একজন বিচারকের জরিপ প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য রয়েছে এবং রিপোর্টে উল্লেখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তুরাগ নদীতে দখল উচ্ছেদ এর নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।
এ মামলায় বাদি হলেন হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশ। বিবাদীরা হলেন, পানি সম্পদ সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান, বিআইডবিøউ এর চেয়ারম্যান, রাজউক চেয়ারম্যান, পরিবেশের মহাপরিচালক, গাজীপুরের ডিসি এসপি, তুরাগ ও টংগি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
নদী রক্ষায় ১০টি নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন আদালত। ঢাকার তুরাগ নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়কে রক্ষার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেছেন। নদী রক্ষা কমিশন যাতে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, সেজন্য আইন সংশোধন করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে সরকারকে। একইসঙ্গে জলাশয় দখলকারী ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা প্রকাশ, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরি এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে বলা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে।
পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করেছিল বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি। ওই তালিকায় আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হন। উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত বুধবার নদী রক্ষায় রায় ঘোষণা শুরু করে। সেদিনই তুরাগ নদীকে লিগ্যাল পারসন বা জুরিসটিক পারসন ঘোষণা করা হয়, যা দেশের সব নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তুরাগ নদী। নদীর কালো পানি সে কথাই জানান দিচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তুরাগ নদী। নদীর কালো পানি সে কথাই জানান দিচ্ছে। আইনের চোখে ব্যক্তি দুই ধরনের- নেচারাল পারসন ও লিগ্যাল পারসন। একজন মানুষ নেচারাল পারসন হিসেবে যেসব আইনি সুবিধা ভোগ করেন, লিগ্যাল পারসন এর ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনি অধিকার প্রযোজ্য হয়। জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করায় নদীর ক্ষেত্রেও তেমন কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে। এ মামলার অবশিষ্ট রায় গত বৃহস্পতিবারই ঘোষণা করার কথা থাকলেও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে রায়ের নির্দেশনা যেন সাংঘর্ষিক বা পরস্পরবিরোধী না হয়, সে জন্য সময় নেন আদালত। এরপর বিস্তারিত নির্দেশনা সহ রায় ঘোষণা করা হয়।
আদালত বলেছেন, দেশের সকল নদ-নদী খাল-বিল জলাশয় রক্ষার জন্য পারসন ইন লোকো পেরেনটিস বা আইনগত অভিভাবক হবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ফলে দেশের সকল সকল নদ-নদী খাল-বিল জলাশয়ের সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সকল দায়িত্ব বর্তাবে নদী রক্ষা কমিশনের ওপর। নদী রক্ষা কমিশন যাতে কার্যকর একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পাবে, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে ৪ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নদ-নদী, খাল-বিল জলাশয় দখলের অপরাধে কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ করতে হবে। সে অনুযায়ী তদন্ত ও বিচারের আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ৬ মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে। আদালত বলেছেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত করে একটি ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরি করতে হবে। সেই ডেটাবেইজ দেশের সকল ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দুই তীরেই গড়ে উঠেছে বালু-পাথরের ব্যবসা; এখন যেন নদীর চেহারা হারাতে বসেছে এক সময়ের প্রমত্তা তুরাগ।
প্রতিরোধমূলক নির্দেশনাও দিয়েছেন আদালত:
নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন না। ঋণ দেয়ার সময় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জাতীয় বা স্থানীয়- কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখল বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।
দেশের সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে একদিন এক ঘণ্টা ‘নদী রক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ’ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্লাস নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
দেশের সকল শিল্প কারখানার সকল শ্রমিক কর্মচারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাসে এক দিন এক ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে প্রতি তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ করতে হবে। সরকারকে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদার হিসেবে নাম আসায় যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এই রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছিলেন, তাদের অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ৩০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, এই নির্দেশনা অনুযায়ী বিবাদীরা স্থাপনা সরিয়ে না নিলে সরকার বিবাদীদের খরচেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবে। বিবাদীদের মধ্যে কেউ সরকারি ইজারার মাধ্যমে নদী তীরের জমি দখল করে স্থাপনা তৈরি করে থাকলে সেই ইজারাও বাতিল বলে গণ্য হবে। হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করলেও তুরাগ নদী নিয়ে এই রিট মামলা একটি চলমান মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে যেন আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন সময় সময় পর্যালোচনা করা যায়। রায়ের একটি অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পাঠাতে বলেছেন আদালত, যাতে এ রায়ের ভিত্তিতে তিনি অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন