পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে নৃ-তাত্তি¡কভাবে ও ভাষাগতভাবে একাধিক জাতির অস্তিত্ব ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতম ছিল বাঙালি। অতঃপর ছিল পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী ও বালুচি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চব্বিশ বছরের তো বটেই, আজও সকল পাঠান ও বালুচিকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আত্মার কাঠামোতে অলঙ্ঘনীয়ভাবে প্রথিত করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই যেই পাঠান ও বালুচিগণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করত; রাষ্ট্র বিজ্ঞানের নিয়ম মোতাবেক কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না। তাই তাদেরকে পাকিস্তানের আত্মার সঙ্গে একাত্ম করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাঙালি?
একটি জনগোষ্ঠীকে জাতিতে রূপান্তরিত করার জন্য যেইরূপ দূরদর্শিতাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতা প্রয়োজন, সেইরূপ নেতা পাকিস্তান নামক দেশে ছিল না। অধিকন্তু বিভিন্ন নৃ-তাত্তি¡ক ও ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠী যারা ভৌগোলিকভাবে দূরত্বে অবস্থানকারী ছিল তাদেরকে একাত্ম করা অবশ্যই কঠিন কাজ ছিল। ঐ কঠিন কাজ সম্পাদনের জন্য কঠোর নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল। যার কারণে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ভেঙে যায়।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি নামে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ছিল তথা ইসলামী রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু তার শাসকগণ কোনো অবস্থাতেই ইসলামের শিক্ষার আলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলোকিত ছিলেন না। আলোকিত ছিলেন না এই কারণে বলি যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রদর্শিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল সেটা কোনো দ্বীন-ইসলামের চেতাসম্পন্ন নেতৃত্বের পক্ষে উচিত ছিল না। সেই বঞ্চনা ও বৈষম্য অনেক আঙ্গিকেই বিদ্যমান ছিল। সবচেয়ে বড় ছিল ভাষা, চাকরি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্তে¡ও এবং পূর্ব পাকিস্তানের কারণে কৃষি রপ্তানী তুলনায় বেশি হওয়া সত্তে¡ও, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোতে ও প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত ছিল। সমসাময়িক রাজনৈতিক ভাষায় পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছিল। এই শোষণের বিরুদ্ধেই তৎকালীন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে। ঐ ছয় দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের ফলাফল প্রচন্ডভাবে আওয়ামী লীগের অনুকূলে তথা ছয় দফার অনুকূলে যায়। গণতান্ত্রিক রেওয়াজ মোতাবেক পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই ভোটের রায় মেনে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও তাদের একান্ত বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি অনুমান করে এবং প্রচারণা করে যে, ছয় দফার ভিত্তিতে জয়ী হওয়া আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গেলে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে!!
এ প্রসঙ্গে আমি পাক-ভারত উপমহাদেশের ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি অভিযোগ করছি, রাজনৈতিক ছলনার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারণার। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মোতাবেক তৎকালীন উপমহাদেশের পশ্চিম অংশে ও পূর্ব অংশে মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান অঞ্চলগুলো আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উদ্ভূত হওয়ার কথা ছিল। ১৯৪৬ সালে হঠাৎ করেই মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করে পশ্চিমের ও পূর্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে একটিমাত্র স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রস্তাব করে। আমি দ্বিতীয় অভিযোগ আনছি ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাসের পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যে, তারা জনগণের ভোটের রায়কে উপেক্ষা করে গায়ের জোরে ও বন্দুকের জোরে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে বাঁচাতে গিয়ে মানব ইতিহাসের একটি অন্যতম জঘন্য গণহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। স্বাধীনতা মানুষের জন্যই; স্বাধীনতাকে উপলদ্ধি করার জন্যই রাজনৈতিক কাঠামো। অতএব, সেখানে বাধ্যতার বা জোর প্রদর্শনের কোনো অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সামনে স্বাধীনতা ঘোষণা ব্যতীত আর কোনো বিকল্প রাস্তা খোলা ছিল না। মার্চ মাসের ঘটনাবহুল ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিকভাবেই চেষ্টা করেছেন। অপরপক্ষে এটাও নিরেট সত্য যে, একাত্তরের পূর্বে বহু বছর ধরেই একাধিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে বা গোপনে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে, বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার জন্য নিরলস সুকৌশল সংগ্রাম করেছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগের মাস ও বছরগুলোর কথা উল্লেখ না করলেও, ১৯৭০ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ এর মার্চ এই সময়ের ইতিহাস এই উজ্জ্বল সাক্ষ্য প্রদান করে যে, ধীরে ধীরে, তিলে তিলে, ক্রমে ক্রমে, বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এই প্রস্তুতি সংগ্রামের নায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানি এবং মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে ২৬ মার্চ দ্বিতীয়বার আর আসবে না। সেই দিন নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। অপরপক্ষে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাত্তি¡কভাবে বা থিওরিটিকালী বলতে গেলে এইরূপ দাঁড়ায় যে, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ঐ তারিখে বাংলার মাটিতে উপস্থিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মর্যাদা হয় অবাঞ্ছিত দখলদার হানাদার বাহিনীর। এই দখলদার বাহিনীর দখল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যেই যুদ্ধ শুরু হয়, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। নিদেনপক্ষে ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ব্যাপী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে তার যৌক্তিক চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়সীমা হচ্ছে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত; দুইশত ছেষট্টি দিন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একযোগে শুনতে পায়, এমনভাবে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা হয়নি। ঘোষণা হোক বা না হোক, স্বাধীনতার স্থপতি ও রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বটে। ক্যালেন্ডারে ২৬ মার্চ তারিখ শুরু হওয়া মাত্রই প্রথম আধাঘণ্টার মধ্যেই, চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকগণের সামনে মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সৈনিকগণকে নিয়ে সকালের মধ্যেই যুদ্ধযাত্রা করেন। চট্টগ্রাম মহানগরের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম শহরের অদূরে অবস্থিত কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন বা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করলে এটাও বলা যায় যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রথমে তিনি নিজের নামে ঘোষণা প্রদান করেন। চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনৈতিক মুরুব্বীগণ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এই ভুলটি দৃষ্টিতে আনার পর, দ্বিতীয়বার মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বা প্রদান করেন। সেই সময় ঐ ঘোষণাটি অতি সময়োপযোগী ও কৌশলগতভাবে অতি প্রয়োজনীয় ছিল। কাজটি অত্যন্ত সম্মানজনক ছিল, অত্যন্ত সাহসের কাজ ছিল। অথচ কাজটিকে বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে। আমরা বিতর্কের বিরুদ্ধে। আজ এত বছর পর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে গিয়ে আমরা পর্যালোচনা করতেই পারি যে, কী পেলাম আর কী পাইনি? স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, সংবিধান পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, জাতীয় সংগীত পেয়েছি, আলাদা ভূখন্ড পেয়েছি, আলাদা সংসদ পেয়েছি এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার জন্য অসীম অবকাশ পেয়েছি। এই সময়ে আমরা উন্নতি বা অগ্রগতি করিনি এটা বলা ভুল; আমরা উন্নতি ও অগ্রগতি অবশ্যই করেছি, বিভিন্ন সেক্টরে বা আঙ্গিকে, কম বা বেশি। কিন্তু যতটুকু করা উচিত ততোটুকু অগ্রগতি ও উন্নতি হয়েছে কিনা সেটাই হল মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গণভোটের প্রয়োজন নেই। সচেতন বাংলাদেশি মাত্রই একবাক্যে বলবেন, আমাদের অগ্রগতি ও উন্নতি সমসাময়িক অনেক দেশের তুলনায় কম। এর জন্য দোষারোপের রাজনীতি নয় বরং আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। কেন আমরা পিছিয়ে পড়লাম বা কেন আমরা উপযুক্ত অগ্রগতি ও উন্নতি রচনা করতে পারলাম না?
আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মতো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে কতজন বেঁচে আছে তার কোনো পরিসংখ্যান বাংলাদেশে নেই। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যান স্থির করার কোনো সংকল্প উপযুক্ত সময়ে গ্রহণ করেনি। বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান থাক বা না থাক, সাধারণ চেতনার ভিত্তিতে বলছি যে, এক লক্ষের কিছু কমসংখ্যক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছে। তাদের সকলের বয়স কমে ষাট বছর এবং বেশিতে পঁচাশি বছর। এখন থেকে বিশ বছর পর, পাঁচ থেকে দশ হাজার বেঁচে থাকতে পারেন। এখন থেকে ত্রিশ বছর পর সম্ভবত কোনো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে থাকবেন না। অতএব, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী এবং ইতিহাস সঠিকভাবে রচনার আহ্বান জানাই এই স্বাধীনতা দিবসে। যদি এই ইতিহাস সঠিকভাবে রচনা না করি তাহলে স্বাধীনতা দিবস অপমানিত হবে; স্বাধীনতার জন্য যারা শহীদ হয়েছে তাঁদের আত্মা অপমানিত হবে।
অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। জানানোর দায়িত্ব আমাদের। আমরা কেউ কেউ চেষ্টা করছি, কেউ কেউ করছি না। আহ্বান জানাই, সকলেই যেন চেষ্টা করি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে নৃ-তাত্তি¡কভাবে ও ভাষাগতভাবে একাধিক জাতির অস্তিত্ব ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতম ছিল বাঙালি। অতঃপর ছিল পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী ও বালুচি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চব্বিশ বছরের তো বটেই, আজও সকল পাঠান ও বালুচিকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আত্মার কাঠামোতে অলঙ্ঘনীয়ভাবে প্রথিত করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই যেই পাঠান ও বালুচিগণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করত; রাষ্ট্র বিজ্ঞানের নিয়ম মোতাবেক কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না। তাই তাদেরকে পাকিস্তানের আত্মার সঙ্গে একাত্ম করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাঙালি?
একটি জনগোষ্ঠীকে জাতিতে রূপান্তরিত করার জন্য যেইরূপ দূরদর্শিতাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতা প্রয়োজন, সেইরূপ নেতা পাকিস্তান নামক দেশে ছিল না। অধিকন্তু বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক ও ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠী যারা ভৌগোলিকভাবে দূরত্বে অবস্থানকারী ছিল তাদেরকে একাত্ম করা অবশ্যই কঠিন কাজ ছিল। ঐ কঠিন কাজ সম্পাদনের জন্য কঠোর নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল। যার কারণে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ভেঙে যায়।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি নামে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ছিল তথা ইসলামী রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু তার শাসকগণ কোনো অবস্থাতেই ইসলামের শিক্ষার আলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলোকিত ছিলেন না। আলোকিত ছিলেন না এই কারণে বলি যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রদর্শিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল সেটা কোনো দ্বীন-ইসলামের চেতাসম্পন্ন নেতৃত্বের পক্ষে উচিত ছিল না। সেই বঞ্চনা ও বৈষম্য অনেক আঙ্গিকেই বিদ্যমান ছিল। সবচেয়ে বড় ছিল ভাষা, চাকরি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্তে¡ও এবং পূর্ব পাকিস্তানের কারণে কৃষি রপ্তানী তুলনায় বেশি হওয়া সত্তে¡ও, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোতে ও প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত ছিল। সমসাময়িক রাজনৈতিক ভাষায় পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছিল। এই শোষণের বিরুদ্ধেই তৎকালীন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে। ঐ ছয় দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের ফলাফল প্রচন্ডভাবে আওয়ামী লীগের অনুকূলে তথা ছয় দফার অনুকূলে যায়। গণতান্ত্রিক রেওয়াজ মোতাবেক পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই ভোটের রায় মেনে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও তাদের একান্ত বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি অনুমান করে এবং প্রচারণা করে যে, ছয় দফার ভিত্তিতে জয়ী হওয়া আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গেলে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে!!
এ প্রসঙ্গে আমি পাক-ভারত উপমহাদেশের ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি অভিযোগ করছি, রাজনৈতিক ছলনার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারণার। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মোতাবেক তৎকালীন উপমহাদেশের পশ্চিম অংশে ও পূর্ব অংশে মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান অঞ্চলগুলো আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উদ্ভূত হওয়ার কথা ছিল। ১৯৪৬ সালে হঠাৎ করেই মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করে পশ্চিমের ও পূর্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে একটিমাত্র স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রস্তাব করে। আমি দ্বিতীয় অভিযোগ আনছি ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাসের পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যে, তারা জনগণের ভোটের রায়কে উপেক্ষা করে গায়ের জোরে ও বন্দুকের জোরে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে বাঁচাতে গিয়ে মানব ইতিহাসের একটি অন্যতম জঘন্য গণহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। স্বাধীনতা মানুষের জন্যই; স্বাধীনতাকে উপলদ্ধি করার জন্যই রাজনৈতিক কাঠামো। অতএব, সেখানে বাধ্যতার বা জোর প্রদর্শনের কোনো অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সামনে স্বাধীনতা ঘোষণা ব্যতীত আর কোনো বিকল্প রাস্তা খোলা ছিল না। মার্চ মাসের ঘটনাবহুল ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিকভাবেই চেষ্টা করেছেন। অপরপক্ষে এটাও নিরেট সত্য যে, একাত্তরের পূর্বে বহু বছর ধরেই একাধিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে বা গোপনে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে, বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার জন্য নিরলস সুকৌশল সংগ্রাম করেছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগের মাস ও বছরগুলোর কথা উল্লেখ না করলেও, ১৯৭০ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ এর মার্চ এই সময়ের ইতিহাস এই উজ্জ্বল সাক্ষ্য প্রদান করে যে, ধীরে ধীরে, তিলে তিলে, ক্রমে ক্রমে, বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এই প্রস্তুতি সংগ্রামের নায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানি এবং মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে ২৬ মার্চ দ্বিতীয়বার আর আসবে না। সেই দিন নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। অপরপক্ষে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাত্তি¡কভাবে বা থিওরিটিকালী বলতে গেলে এইরূপ দাঁড়ায় যে, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ঐ তারিখে বাংলার মাটিতে উপস্থিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মর্যাদা হয় অবাঞ্ছিত দখলদার হানাদার বাহিনীর। এই দখলদার বাহিনীর দখল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যেই যুদ্ধ শুরু হয়, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। নিদেনপক্ষে ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ব্যাপী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে তার যৌক্তিক চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময়সীমা হচ্ছে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত; দুইশত ছেষট্টি দিন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একযোগে শুনতে পায়, এমনভাবে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা হয়নি। ঘোষণা হোক বা না হোক, স্বাধীনতার স্থপতি ও রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বটে। ক্যালেন্ডারে ২৬ মার্চ তারিখ শুরু হওয়া মাত্রই প্রথম আধাঘণ্টার মধ্যেই, চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকগণের সামনে মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সৈনিকগণকে নিয়ে সকালের মধ্যেই যুদ্ধযাত্রা করেন। চট্টগ্রাম মহানগরের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম শহরের অদূরে অবস্থিত কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন বা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করলে এটাও বলা যায় যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রথমে তিনি নিজের নামে ঘোষণা প্রদান করেন। চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনৈতিক মুরুব্বীগণ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এই ভুলটি দৃষ্টিতে আনার পর, দ্বিতীয়বার মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বা প্রদান করেন। সেই সময় ঐ ঘোষণাটি অতি সময়োপযোগী ও কৌশলগতভাবে অতি প্রয়োজনীয় ছিল। কাজটি অত্যন্ত সম্মানজনক ছিল, অত্যন্ত সাহসের কাজ ছিল। অথচ কাজটিকে বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে। আমরা বিতর্কের বিরুদ্ধে। আজ এত বছর পর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে গিয়ে আমরা পর্যালোচনা করতেই পারি যে, কী পেলাম আর কী পাইনি? স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, সংবিধান পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, জাতীয় সংগীত পেয়েছি, আলাদা ভূখন্ড পেয়েছি, আলাদা সংসদ পেয়েছি এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার জন্য অসীম অবকাশ পেয়েছি। এই সময়ে আমরা উন্নতি বা অগ্রগতি করিনি এটা বলা ভুল; আমরা উন্নতি ও অগ্রগতি অবশ্যই করেছি, বিভিন্ন সেক্টরে বা আঙ্গিকে, কম বা বেশি। কিন্তু যতটুকু করা উচিত ততোটুকু অগ্রগতি ও উন্নতি হয়েছে কিনা সেটাই হল মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গণভোটের প্রয়োজন নেই। সচেতন বাংলাদেশি মাত্রই একবাক্যে বলবেন, আমাদের অগ্রগতি ও উন্নতি সমসাময়িক অনেক দেশের তুলনায় কম। এর জন্য দোষারোপের রাজনীতি নয় বরং আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। কেন আমরা পিছিয়ে পড়লাম বা কেন আমরা উপযুক্ত অগ্রগতি ও উন্নতি রচনা করতে পারলাম না?
আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মতো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে কতজন বেঁচে আছে তার কোনো পরিসংখ্যান বাংলাদেশে নেই। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যান স্থির করার কোনো সংকল্প উপযুক্ত সময়ে গ্রহণ করেনি। বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান থাক বা না থাক, সাধারণ চেতনার ভিত্তিতে বলছি যে, এক লক্ষের কিছু কমসংখ্যক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছে। তাদের সকলের বয়স কমে ষাট বছর এবং বেশিতে পঁচাশি বছর। এখন থেকে বিশ বছর পর, পাঁচ থেকে দশ হাজার বেঁচে থাকতে পারেন। এখন থেকে ত্রিশ বছর পর সম্ভবত কোনো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে থাকবেন না। অতএব, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী এবং ইতিহাস সঠিকভাবে রচনার আহ্বান জানাই এই স্বাধীনতা দিবসে। যদি এই ইতিহাস সঠিকভাবে রচনা না করি তাহলে স্বাধীনতা দিবস অপমানিত হবে; স্বাধীনতার জন্য যারা শহীদ হয়েছে তাঁদের আত্মা অপমানিত হবে।
অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। জানানোর দায়িত্ব আমাদের। আমরা কেউ কেউ চেষ্টা করছি, কেউ কেউ করছি না। আহ্বান জানাই, সকলেই যেন চেষ্টা করি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন