শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েই চলছে। মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর প্রায় ৬০ শতাংশই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী। পড়াশুনার পাশাপাশি যোগাযোগের জন্য এ যন্ত্রটি ব্যবহার করা হলেও প্রভাব পড়ে পড়াশুনার উপর। ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ইনকামিং আউটগোয়িং কল, ফেসবুক-টুইটারের মতো শতাধিক সামাজিক বন্ধনের বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে ক্লাশে অমনোযোগী হওয়া, রাতভর কমরেটে কথাবলার সুযোগ পেয়ে বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করা, প্যাকেজরেটে দিনরাত আনলিমিটেড ডাউনলোড করাসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা।
ভালকে দূরে রেখে মন্দের প্রতি আকর্ষিত হওয়া, চুল-নখ অঙ্গের স্টাইল করে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়ানো, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্বল হওয়া, মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা, ফেসবুক-টুইটারের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ব্যবহারের নেশায় তারা আসক্ত। নতুন নতুন সফটওয়্যার আপডেট করার মতো ক্ষণে ক্ষণে গেটআপ, মেকআপ, চলন-ধরন ও মতের পরিবর্তন তাদের মানসিক বিকাশ, স্বকীয়তাবোধ, ভবিষৎ জীবন গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোবাইল কোম্পানি, ফাস্টফুডের দোকানমালিকসহ অনেকেই লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অভিবাভক ও শিক্ষার্থী নিজেই। প্রশংসার এক ঝুড়ি মিথ্যা, মন নামক বিষয়টাকে প্রেমের রশি দিয়ে টানাটানি, ভাব-ভালবাসা, হুমকি, ভূয়া বন্ধু ইত্যাদির প্রধান উৎস মোবাইল ফোন।
মেমরি কার্ড সমৃদ্ধ মোবাইল ফোনে বইয়ের স্টিল পিকচার নিয়ে আসছে পরীক্ষার কক্ষে। সময় দেখার নাম করে মোবাইল ফোনের ইমেজ ভিউয়ার জুম করে দেখে নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টস বা চিত্রগুলো। নকল করার আধুনিক মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে মোবাইল ফোনটিকে। কোনো প্রশ্নোত্তর না পারলে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে পরীক্ষার কক্ষ থেকে বেরিয়ে ফেসবুকের ওয়ালে সার্কুলেশন করছে। ছোট স্পিকার কানে লাগিয়ে ওয়ারলেস কানেকশনে উত্তর চেয়ে নিচ্ছে বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে। এভাবে মোবাইলে নকল প্রথা চলে আসছে মহামারী আকারে।
শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের ব্ল-টুথ ডিভাইসটি অন করে আপনার সকল তথ্য, ভিডিও, সেভ করা নম্বর চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই। শুধু তাই নয় বু-টুথ ডিভাইস চালু করে আপনার ম্যাসেজ অপশন থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্য কোনো মোবাইলে। শিক্ষার্থীরা চুরি বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠছে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মোবাইল ফোন আবিষ্কারে জীবনযাত্রার মান যতটা বেড়েছে ঠিক ততটাই অনাচার, মিথ্যাচার, অপরাধ বেড়েছে। মোবাইল ফোনের যথাযোগ্য ব্যবহারে যোগাযোগ যতটা সহজ হয়েছে তেমনি নানা অপকর্ম, কুকর্ম জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করছে- অপকর্ম, কুকর্মের ভিডিও চিত্র কয়েকমিনিটেই ভয়েস কল, ডাটা কল, সার্কুলেশনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববাসীকে। ছাত্র-ছাত্রীদের নকল প্রবণতা, যুবকের যৌন প্রবণতা, বৃদ্ধদের আক্ষেপ প্রবণতা সবকিছু উপেক্ষা করেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, দিনমজুর সবার কাছেই মোবাইলের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে চলেছে। যে দেশের মানুষ মৌলিক চাহিদা জোগাতে হোচট খায় সে দেশে মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলে হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল ফোনটিকে। রক্তচোষা ছারপোকার মতো কষ্টার্জিত উপার্জনগুলো চুষে নিচ্ছে। উপার্জন মিলিয়ে যাচ্ছে নেটওয়্যার্কের অদৃশ্য ফ্রিকুয়েন্সিতে।
সবার বাসায় কম্পিউটার না থাকা, কম্পিউটার পরিবহনে অক্ষমতা অথবা কম্পিউটারে মডেম সংযোগ ইত্যাদি জটিলতায় প্রতিদিন মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নেটিজেন হচ্ছে কোটি কোটি আবালবৃদ্ধবনিতা। মুহূর্তেই ডাউনলোড করে নিচ্ছে আজেবাজে ডকুমেন্টস। সহজেই তা ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধু-বান্ধবীদের মোবাইল ফোনে। ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেনজার ইত্যাদি সামাজিক বন্ধুত্বের সাইটে অডিও কনফারেন্সিং বা চ্যাট করে সময় নষ্ট করছে ছাত্রছাত্রী, যুবক, বৃদ্ধরা। সম্প্রতি আমাজান জঙ্গলে এক প্রকার প্রাণির সন্ধান পাওয়া গেছে যারা অমাবশ্যার রাতে দল বেঁধে আত্মহত্যা করে। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের মতোই। ইন্টারনেট (সব ধরনের ইনফরমেশন থাকে) আবিষ্কারের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষকে সহায়তা করা অথচ সার্ভার কাউন্ট করলে দেখা যায় নিষিদ্ধ সাইটগুলোতে উপচে পড়া ভীড়, ভালো শিক্ষণীয় সাইটগুলোতে ক্লায়েন্ট সংখ্যা অতি নগণ্য। শিক্ষার্থীরা পঞ্চ ইন্দ্রীয়, সময়, অর্থ নষ্ট করে জাতিকে কোন দিকে ধাবিত করছে? সম্প্রতি ফেসবুকে ভিডিও সংযুক্ত হয়ে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম মোবাইলফোনে চালু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এর পিছনে সময় নষ্ট করছে রাতের পর রাত। সেবা দেবার নাম করে বড় বড় মোবাইল কোম্পানি বুকে টেনে নিলেও, তাদের উদ্দেশ্য থাকে অর্থের দিকে। দেশের অর্থ বাইনারী ডিজিট ১ থেকে ০ মতোই মিলিয়ে পাড়ি জমায় উন্নত কোনো রাষ্ট্রের, নয়তো বিদেশি কোনো ব্যক্তির একাউন্টে। টিভি চ্যানেলে বড় বড় কনটেস্টে কোনো কোম্পানি স্পন্সর হলেও টাকাগুলো আমাদের কাছ থেকেই নিয়ে থাকে।
মোবাইল ফোন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলেও, শখের বশবর্তী হয়ে শিক্ষার্থীরা যে সকল অপব্যবহার শুরু করেছে, এতে তারা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে মারাত্মক বিপর্যস্ত হচ্ছে। সমাজ থেকে তারা বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী যেন আটকে যাচ্ছে ২-৩ ইঞ্চির এই ছোট্ট মনিটরে। পড়ালেখা বাদ রেখে তার চিন্তা চেতনা, যোগাযোগ, বন্ধুত্ব- সব কিছুর মূল মোবাইল ফোন। এ কালস্রোতকে থামাতে না পারলে মরণব্যাধির চাইতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে যে জাতির পথ চলা- সে জাতির একাংশ শিক্ষার্থী, যারা ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার উপাদান। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা আমাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। তবে তাদের অনেকেই নিজের ভালমন্দ বুঝতে পারে না। অথচ তাদের চোখে আমরা ব্যাকডেটেড। এ ধরনের আলট্রামডার্ন শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে অভিভাবকগণ নিশ্চিন্তে বসে থাকেন। এ প্রবণতা দূর করার দায়িত্ব কি শুধুই বিদ্যালয়ের শিক্ষকের? নতুন নতুন সফটওয়্যার আপডেট করার মতো ক্ষণে ক্ষণে গেটআপ, মেকআপ, চলন-ধরন ও মতের পরিবর্তন তাদের মানসিক বিকাশ, স্বকীয়তাবোধ ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে? এ থেকে তাদের ফেরানোর উপায় কী? অভিভাবকদের কি কোন দায় নেই?
একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ৬/৭ ঘণ্টা (ছুটির দিন বাদে) সময় কাটে শিক্ষকদের কাছে, বাকী ১৭/১৮ ঘণ্টায় শিক্ষার্থী কী করে, কোথায় যায়, কী খায়, কাদের সাথে মেশে এ বিষয়গুলো খুব ভালভাবে লক্ষ রাখতে হবে অভিভাবকদের।
শ্রদ্ধেয় অভিভাবক, আপনার সন্তান কি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে? ব্যবহার করলে মোবাইল ফোনটিকে কয়েকদিনের জন্যে ছিনিয়ে নিন, দেখবেন সে তা পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে। আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে- খাবে না, লেখাপড়া করবে না ইত্যাদি। সে মোবাইল ফোনটির জন্য তার মৌলিক চাহিদাগুলোও ছাড়তে রাজি হবে। মোবাইল বিষয়টি যেন পড়ালেখার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল ফোনের বিড়ম্বনায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভবিষৎ কর্ণধার ছাত্র-ছাত্রীরা এভাবে চলতে থাকলে জাতি মেরুদন্ডহীন এবং অলস হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ‘দেশের সকল পরীক্ষার কক্ষে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার নিষেধ’ এমন নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্তে¡ও স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ কি পেরেছেন পরীক্ষার কক্ষকে মোবাইলমুক্ত রাখতে?
‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা’, ‘সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়া’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া’র আন্দোলনের মতোই শিক্ষাঙ্গন মোবাইলমুক্ত করার দাবি সকল অভিবাভক ও শিক্ষিত সচেতন জনগণের। তাই শিক্ষামন্ত্রণালয়, স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ, অভিবাভকসহ সকলকেই শিক্ষার্থীর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার অভিপ্রায়ে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে, লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইসিটি বিভাগ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Sharif Ali Pir. PLHS Sylhet ৬ জুলাই, ২০২০, ৩:০৫ পিএম says : 0
স্যার awesome লেখছেন। আমার মনের মত লেখা
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন