শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দুদক চেয়ারম্যানের উক্তি এবং আমরা

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশেনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অনেক সমস্যার মধ্যে ‘আমিত’ একটি বড় সমস্যা। আমি বড়, আমিই শ্রেষ্ঠ-এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অহংবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নয়তো প্রতিষ্ঠান এগোবে না, দেশ এগোবে না।’ শিশুদের পাঠ্য বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার বই’, ‘আমার পতাকা’ না করে ‘আমাদের বই’, ‘আমাদের পতাকা’ লিখলে শিশুমনে আমিত্বের বীজ অঙ্কুরিত হতো না। দুদক চেয়ারম্যান তার বক্তৃতায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন নিঃসন্দেহে। কেননা, আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রে যেসব অন্যায়- অনাচার সংঘটিত হয় বা অসঙ্গতি দেখা যায়, তার মূলে রয়েছে এই আমিত্ব বা আত্মকেন্দ্রিকতা। আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক যে, সামষ্টিক বলে যে একটি বিষয় আছে, তা বেশিরভাগ সময়ই বিস্মৃত হই। এর ফলে মমত্ববোধ, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়নতার কথাও আমাদের মনে থাকে না।
যে দিবসের অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান কথাগুলো বলেছেন, সে দিবসটির তাৎপর্য নিয়ে আমরা যদি ভাবি, তাহলে ওই বক্তব্যের মর্মার্থ উপলব্ধি করা সহজতর হবে। এ দিবসটির উৎপত্তির উৎসমূলে আমি বা আমিত্ব ছিল না। ছিল আমরা এবং আমাদের। ১৯৭১ সালের মার্চের সে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এদেশের মানুষ আমি শব্দটি যেন ভুলে গিয়েছিল। তখন সবাই ভাবত আমরা। আমরা একটি জাতি, আমাদের জাতীয় স্বার্থ, আমাদের অধিকার, সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতাই ছিল মূখ্য বিষয়। তখন কেউ নিজের স্বার্থচিন্তায় নিমগ্ন থাকেনি। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ািবষয়টি হয়ে গিয়েছিল গৌণ। আর সব আমি মিলে আমরা সৃষ্টি হতে পেরেছিল বলেই পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস আমরা পেয়েছিলাম।
আমি বা আমিত্ব যে একটি অত্যন্ত সর্বনাশা ব্যাধি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ যখনই আমিত্বের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তখনই তার বিবেক, বুদ্ধি, চেতনা, মানবিক গুণাবলী লোপ পেতে থাকে। এক সময় তা এমন রূপ পরিগ্রহ করে যে, তার মধ্যে ন্যুনতম মনুষ্যত্ববোধও আর অবশিষ্ট থাকে না। আর একজন মানুষের যখন মনুষ্যত্ব লোপ পায়, তখন তার পক্ষে যে কোনো অপরাধকর্ম সম্পাদন করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজে যেসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে বিব্রত করছে, তার মূলে রয়েছে আমিত্ব বা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। আমি শুধু আমারটা নিয়েই ভাববো, থাকবো- এই সংকীর্ণতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে করে তুলছে সরু থেকে সরু। সবাই এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিবেশীর কথা, আপনজনের কথা, দেশের কথা, জাতির কথা ভাবার যেন সময় নেই কারো। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার গোষ্ঠিস্বার্থের কথা ভাবে। রাজনীতিকরা ভাবে নিজেদের দলের কথা। আমলারা ভাবে নিজ নিজ স্বার্থের কথা।
এই যে আমাদের দেশ আজ দুর্নীতির সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে, এর পেছনে কী আমি চিন্তাটা কাজ করছে না? যারা দুর্নীতি করছে, ঘুষ খাচ্ছে, রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ-বিদেশে অর্থ-বিত্তের পাহাড় বানাচ্ছে, তারা কি দেশ ও জাতির কথা ভাবে? না, সে ভাবনার সময় তাদের নেই। কারণ তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। অন্যের দিকে তাকানোর সময় তাদের নেই। কীভাবে অন্যকে ঠকিয়ে নিজের পকেট স্ফীত করা যায়, সে ভাবনায় ডুবে আছে তারা। ফলে সামষ্টিক স্বার্থ তাদের কাছে অর্থহীন। স্বার্থের ঠুলি তাদের চোখে এমনভাবে আঁটা যে, তারা নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। এই স্বার্থান্ধতা আমাদের আজ বড় বেশি সংকীর্ণমনা করে তুলেছে, পরিণত করেছে মায়া-মমতাহীন নিষ্ঠুর জীবে।
আমিত্ব একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ। এ রোগে কেউ আক্রান্ত হলে সহজে নিরাময় মেলে না। আমার চেয়ে বড় কেউ নাই, আমিই সবার শ্রেষ্ঠ- এ ধারণা মানুষকে বিবেকহীন করে তোলে। আমার চেয়ে কেউ ভালো হতে পারে, ভালো ভাবতে পারে এবং ভালো কাজ করতে পারে-এটা যেন আমরা মানতেই পারি না। আর তাই সমাজে এত বিশৃঙ্খলা, হানাহানি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা বেশি দেখা যায়। পরষ্পর প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলো কখনোই মেনে নিতে পারে না তাদের চেয়ে অন্য কোনো দল দেশ ও জনগণের জন্য ভালো চিন্তাভাবনা করতে পারে, ভালো কিছু করার কর্মসূচি নিতে পারে। নিজেদের সর্বসেরা প্রমাণ করার জন্য এরা একে অপরের বিরুদ্ধে হক নাহক অপবাদ দিতে দ্বিধা করে না। তারা এটা খেয়াল করে না যে, এর দ্বারা তারা নিজেদেরকেই ছোট করে। একজন রাজনীতিক যখন প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে গালি দিচ্ছে, তখন সে ভুলে যায় প্রতিদ্ব›দ্বী দলের লোকটিও তাকে একইভাবে গালি দিতে দ্বিধা করবে না। দুই পক্ষের এ ‘গালাগালি’ জনমনে যে ধারণাটি সৃষ্টি করে তা একেবারেই সুখকর নয়। আর সেজন্যই আজকাল রাজনীতিকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে দেখা যায়।
দুদক চেয়ারম্যান ‘আমি’ বা ‘আমার’ বাদ দিয়ে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ কথা ভাবতে বলেছেন। তার বক্তব্যের যর্থাথতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। আমাদের ভেতরে যে আমিত্ব বা আত্মকেন্দ্রিকতা বাসা বেঁধে আছে তা এ সমাজ, এ রাষ্ট্রকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ’৭১ সালে যে একাত্মতা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন যেন উধাও হয়ে গেছে। অন্তত জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে সে একাত্মতা বা ঐকমত্য আজো প্রয়োজন। অথচ ব্যক্তি ও গোিষ্ঠগত স্বার্থচিন্তা আমদের সে একাত্মবোধকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ’৭১-এ আমাদের চেতনার কেন্দবিন্দুতে ছিল স্বাধীনতা। সেখানে কোনো সংকীর্ণ দলীয় ভাবনার ঠাঁই ছিল না। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পূর্ণ মালিকানা আমাদের হবে, আমরা হবো স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ-এ ভাবনা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অল্প সময় পরেই সে চেতানার জোয়ারে ভাটার টান সৃষ্টি হয়। দলীয় সংকীর্ণতা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করেছিল। গুটিকয় বিরোধী ছাড়া দেশের সব মানুষই স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। তাদের কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, আবার অনেকে দেশের অভ্যন্তরে থেকে যার যার সাধ্যানুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল। এমন কি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্বেও ওই দলের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে কেউ দ্বিধা করেনি। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ তখনই উঠেছিল। তবে, স্বাধীনতার পর যখন প্রধান দলটি মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব এককভাবে দখল করতে চাইল, বিভেদের সূত্রপাত হলো তখনই। একটি বিশেষ দলই স্বাধীনতা এনেছে-এ স্লোগান যখন তোলা হলো, তখনই যুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা ঐক্যে ফাটল ধরলো। এ স্লোগানের দ্বারা ওই দলটি ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অপরাপর দলের অবদানকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হলো। সেই যে বিভেদের বীজ বপন করা হলো, তারপর থেকে বারবার তার অঙ্কুরোদগম হয়েছে সময়ে সময়ে অনুক‚ল তাপমাত্রা আর জল সিঞ্চন পেয়ে। সে বিভেদের দেয়াল সরিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস যে কেউ নেননি, তা নয়। নিয়েছেন। কিন্তু স্বার্থান্ধগোষ্ঠির কারণে সে ক্ষেত্রেও কাক্সিক্ষত সফলতা আসেনি।
আমাদের রাজনীতিকগণ প্রায়ই জাতীয় ঐক্যের কথা বলে। কেউ কেউ ডাকও দেয় জাতীয় ঐক্যের। কিন্তু সে জাতীয় ঐক্য মুখ দেখায় না। কেন? কারণ যারা সে ডাক দেয়, তাদের সে ডাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া জনগণ অনুভব করে না। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করার জন্য যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন, মানুষ তাতে আন্তরিকতার উপস্থিতি অনুভব করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়া (তৎকালীন) স্বাধীনতা যুদ্ধের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাতেও এদেশের মানুষ আন্তরিকতার উপস্থিতি দেখতে পেয়েছিল। আর তাই তাঁদের আহ্বানে দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সাড়া দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। কারণ, সেখানে আমিত্বের কোনো সংস্পর্শ ছিল না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, জাতিকে বিভক্তির যুপকাষ্ঠে শুইয়ে রেখে আমাদের রাজনীতিকরা এখন জাতীয় ঐক্যের কথা বলে। আর সেজন্যই সে আহ্বান শুধু বাতাসে উড়ে বেড়ায়, বাস্তবে ধরা দেয় না।
এবার আমারা যথাযোগ্য মর্যাদায় ৪৮তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলাম। আমাদের জাতীয় জীবনের এই অন্যতম মর্যাদাকর দিনটিতেও আমরা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। কেবলমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যজনিত কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে কারো কারো অসামান্য অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা বিবেকবান মানুষ মাত্রকেই ব্যথিত করেছে। হতে পারে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা একেকজন একেক রাজনৈতিক পথে চলেছি। তাই বলে কি স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার অবদান মূল্যহীন হয়ে যাবে?
আসলে দুর্ভাগ্য বোধকরি আমাদেরই। কারণ, আমরা আমাদের জাতীয় নেতাদের স্ব-মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে চলেছি। এ ব্যর্থতা আমাদের জন্য সীমাহীন লজ্জার। এ লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে, প্রসারিত করতে হবে অন্তরকে। দুদক চেয়ারম্যান তার বক্তৃতায় শিশুদের বইয়ে ‘আমার বই’ ‘আমার পতাকা’ জাতীয় শব্দের পরিবর্তে ‘আমাদের বই’ ‘আমাদের পতাকা’ ব্যবহার করলে তাদের মধ্যে আমিত্বের প্রভাব কমে আসবে, হৃদয়ে বড়ত্বের প্রসার ঘটবে বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু শিশুদের অন্তরে সে বড়ত্ব সৃষ্টির দায়িত্ব যাদের, তারা বিষয়টি উপলবদ্ধি করতে পারছেন কিনা সেটাই প্রশ্ন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন