কিয়ামতের আগে কিছু নমূনা বা চিহ্ন প্রকাশ পাবে। এগুলো কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত বলে দেয়া হয়েছে। এগুলোর উপর বিশ্বাস আনা ঈমানের দাবী। এবং অস্বীকার করা কুফরী। তবে এইগুলো মানতে বা বুঝতে যেয়ে অনেক ভুল হয় আমাদের। তাই আমাদের কিছু মূলনীতি মেনে চলা উচিৎ, যেমনঃ
১। কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত দলীলগুলোকে বর্তমান সময়ের ঘটনা দূর্ঘটনার সাথে মিলাতে যেয়ে এমন বিশ্বাস নিয়ে আসা যাবেনা যে এইটাই কুরআন ও হাদীসের বলা জিনিষ বা বিষয়, যতক্ষন না উলামাদের বড় একটা অংশ এই ব্যাপারে একমত হয়। কেও যদি বিশ্বাস করে তা তার নিজস্ব উপলবদ্ধি বলে মানতে হবে।
উদাহরণঃ আমাদের নবী (সা) তার সময়ের ইবনে সায়্যাদ কে দাজ্জাল বলে মনে করেছিলেন। সাইয়িদুনা উমার (রা) তাকে হত্যা করতে চাইলে আল্লাহর রাসূল (স) তাকে নিষেধ করেন। বলেন, না, যদি সে না হয় তাহলে একজন নির্দোষ মানুষ কে হত্যা করা হলো। আর যদি দাজ্জাল হয়ে থাকে তা হলে ঈসা (আ) ই কেবল তাকে মারতে পারবেন।
একটা হাদীসে আমাদের নবী (স) বলেছেনঃ ইরাকে এমন অবস্থা হবে যে, এখানে খাওয়ার জন্য একদিন একখানা রুটিও মেলবেনা, কিংবা কারো হাতে কোন পয়সাও পাওয়া যাবেন। (মুসলিম) এই হাদীস কে মিলাতে যেয়ে ১৯৯০ সালে ইরাকের অর্থনৈতিক অবরোধের সময় আসা দূ্র্ভিক্ষের সময়ের কথা অনেকেই বলতেন। কিন্তু ইরাকে এমন ঘটনা তাতারদের সময়েও হয়েছে। বেশ কিছু হাদীসে দুনিয়ার বয়স সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। ৯০০ বছর বা এক হাজার বছর সংক্রান্ত কিছু হাদীস নিয়ে ইমাম সুয়ূতির মত মানুষ ও বিপদে পড়েছেন। তিনি ৯১১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। কিয়ামতের আলামত সমূহ নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা ও করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তার সময়েই ইমাম মাহদীর জন্ম হয়ে গেছে, তার কাছে নাকি ইলহাম ও হয়েছে এই ব্যাপারে। তাছাড়া তখন আমাদের নবী (সা) এর ইন্তেকালের পর ৯০০ বছর ও হয়ে গেছে। কিন্তু কই? এর পরেও কিন্তু ৫00+ বছর প্রায় হয়ে গেল পৃথিবীর বয়স।
আসরারুস সাআহ নামে ফাহাদ সালেমের একটা বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে তিনি ১৯৯১ সালের ঘটনা প্রবাহকে কিয়ামতের ঘটনা বলে দেখায়েছেন। অনেকেই সেই সময় সাদ্দামকে ইমাম মাহদীর জেনারেল মনে করতো। আমীন মুহাম্মাদ জামালের ‘আরমেদান’ (হারমিদূন) বই এ সাদ্দামকে ইমাম মাহদী দেখায়েছেন।
ইমাম মুসলিম মহানবী (সা) এর বানীসাক্বীফ এর কাযযাব (মিথ্যুক) ও মুবীর (ধ্বংশকারী) সংক্রান্ত ভবিষ্যতবাণীকে সাহাবী আসমা’ বিনতে আবূ বাকরের (রা) একটা ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন। আসমা (রা) কাযযাব বলতে মুখতার সাক্বাফীকে বুঝিয়েছেন। আর মুবীর বলতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে বুঝিয়েছেন। কিন্তু হাদীস এখনো উন্মুক্ত। এই ধরণের কাযযাব ও মুবীর সাক্বীফে আরো আসতে পারে।
২। কিয়ামতের আলামতের আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে এই সব আলামত প্রকাশ হওয়ার অর্থ এই নয় যে এই গুলো হওয়ার মাত্র কিছুদিন পরেই কিয়ামত শুরু হবে। মূলত এই চিন্তা মানুষকে তার কাজ কাম করা থেকে বিরত রাখে।
আসলে কিয়ামতের আলামত তিন ধরণেরঃ প্রথমতঃ যা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন আমাদের নবী (স) এর জন্ম ও ইন্তেকাল। দ্বিতীয়তঃ যা এখনো দুই একটা প্রকাশ পাচ্ছে যেমন ব্যাভিচার বেড়ে যাওয়া, বাজনার সামগ্রী অঢেল হওয়া। তৃতীয়তঃ যা এখনো প্রকাশ পায়নি, যেমন ইমাম মাহদী, ঈসা (আ)।
কাজেই এই আলামত বেড়ে গেলো বলে আমল বাড়াতে হবে, ওই গুলো কমানোর চেষ্টা করতে হবে, এবং ছোট আলামত গুলো বন্ধ হওয়ার পথ বের করতে হবে। বড় আলামত বের হলে আল্লাহর হুকুমেই সেই গুলোর সাথে নেতিবাচক হলে মুকাবিলা করতে হবে আর ইতিবাচক হলে সাহায্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে যারা কিয়ামতের আলামত প্রকাশ হচ্ছে দেখে নিষ্ক্রীয় হয়ে দুনিয়া ছেড়ে দেয়, বা পাহাড় জংগলে কাটাবার চিন্তা করে তার হতাশবাদী ঈমানদার, পেসিমিস্ট। ইসলাম এই ধরণের মানসিকতা পছন্দ করেনা। বরং ইসলাম বলে যদি তোমার হাতে একটা গাছের চারা থাকে, অথচ দেখতে পাচ্ছ কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে, চারা টা তুমি মাটিতে লাগায়ে দেবে।
৩। কিয়ামতের আলামত কে বর্তমান যামানার ঘটনা প্রবাহের সাথে মিলাতে যেয়ে কয়েকটা বিষয় মনে রাখতে হবেঃ
ক। আলামত সংক্রান্ত হাদীস গুলো পড়ার পরে যদি আপনি মনে করেন কোন যায়গার কোন বিষয় কিয়ামতের আলামতের মধ্যে পড়েছে, সেটাকে আপনি অন্যকে মানতে বাধ্য করবেন না, বা মানতে না চাইলে তাকে ইনকার করবেন না।
ইমাম সুয়ূতি ইইয়াক্বীনের সাথে বলে গেছেন, তার সময়ে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে, অথচ দেখুন পাঁচ শ’ বছরের বেশি হয়ে গেছে তার পর। ডঃ ইমরান হুসেইন বর্তমান বিশ্বে এই বিষয়ে খুব বড় পন্ডিত। তার অনেক ব্যখ্যা আছে দাজ্জাল বা এই সংক্রান্ত বিষয়ে। তার বুঝটা তার মধ্যেই থাকলে ভালো হত। কিন্তু তিনি ক্রমাগত ভাবে আলিম উলামাদের কে এত এটাক করে যাচ্ছেন, যা আমাকে ব্যথিত করে। তার দৃষ্টিভংগিতে বর্তমান বিশ্বের তাবৎ আলিম সমাজ ভুল পথে আছে। অথচ দাজ্জাল বেরিয়ে গেছে, ইয়াজুজ মাজুজ বের হয়েছে। এদের বাহিনী এখন দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। গ্যালিলি নদীর পানি শুকিয়ে গেছে, যাইয়োন বাদীদের সাথে সাঊদি এক হয়েছে ব্লা ব্লা ব্লা।
খ- কুরআন হাদীসে বর্ণিত আলামত গুলো কোন এক ব্যক্তি বা সমাজে পাওয়া গেলে আর কিয়ামত সেই অনুযায়ী না হলে যেন কুরআন ও হাদীস অস্বীকার করার প্রবনতা না আসে।
ইতিহাসে ইমাম মাহদী দাবী কারীর সংখ্যা অনেক। সুন্নি ধারার যেমন আছে, শিয়া ধারারও তেমন আছে। কিন্তু তাদের সময়ে তো ঈসা (আ) আসেন নি। দাজ্জালের আগমন নিয়েও অনেক কথা আগে ও পরে এসেছে। আমাদের নবী (সা) এর ইবনে সাইয়াদের ঘটনা অনেক দূর গড়িয়ে যায়। এই ইবনে সাইয়াদের জীবন মুসলিম হওয়ার পরেও সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। একবার হজ্জের সফরে তিনি ছিলেন সাহাবা গণের সাথে। সবাই তাকে দাজ্জাল দাজ্জাল করতে ছিলো। তিনি আনাসকে (রা) ডেকে বললেনঃ দেখ আনাস, আমাদের নাবী (সা) তো বলেছেন দাজ্জাল মুসলিম হবেনা, আমি তো মুসিলম। তিনি বলেছেন দাজ্জাল এক চক্ষু হবে, আমার দুইটা চোখ ই সক্রীয়। তিনি বলেছেন দাজ্জালের কপালে কাফির লেখা থাকবে, কই আমার কপালে তো তা নেই। সাইয়িদুনা আনাস এটা মেনে নেন এবং সবাইকে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন।
আমাদের নবী (সা) বলেছেন কম করে ৩০ জন দাজ্জালের আবির্ভাব হবে কিয়ামতের আগে। মহামিথ্যুক গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীও ‘দাজ্জাল ও তার গাধা’ নামক বই এ জোর দিয়ে বলে গেছে দাজ্জাল বের হয়েছে, এবং সেই হলো ঈসা (আ)। মাহদী ও ঈসা (আ) সংক্রান্ত এই জটিলতার কারনে অনেকে সামনে এগিয়ে যেয়ে এই সব বিষয়ে আসা হাদীস গুলোকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন যে গুলো চরম দ্রোহিতার মধ্যে গন্য।
গ- কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত হাদীস গুলো সবই প্রকৃত অর্থেই গ্রহন করতে হবে। কোনটাই রূপক অর্থে নয়। রূপক অর্থে যদি হত তাহলে আমাদের নবী (সা) ইবনে সাইয়াদ কে দাজ্জাল হতে পারে বলতেন না। ইমাম মাহদী তার বংশের এবং তার নামের হবে – এই কথা তিনি বলে যেতেন না। দাব্বাতুল আরদের বর্ণনা বলে যেতেন না। ইয়াজুজ মাজুজের শারীরিক বর্ণনা বলতেন না।
এই বিপদে কিছু কিছু আলিম বা গবেষক পড়ে আমাদের অনেক ক্ষতিও করেছেন। হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমনের সময় নাসীরউদ্দীন তূসী নামক সেই সময়ের সুফী সম্রাট এক মারাত্মক ফতোয়া দিয়ে বসেন। তিনি মংগোলিয়নদের চোখের ভাব দেখে ও তাদের দেহের বৈশিষ্ট লক্ষ্য করে বলেদেন এরাই হলো হাদীসে বর্ণিত ইয়াজুজ মাজুজ। আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর মনোবল এতে এমন ভাবে ভেঙ্গে যায় যে, মংগোলীয় বাহিনীর সামনে তারা দাঁড়াতে পারেনি, কিংবা দাঁড়াতে চায় ও নি। অথচ এর কয়েক বছর পর এদের একটা বাহিনী সুলতান কুতজ এর কাছে পরাজিত হয়। এবং ইতিহাস বিস্ময় নেত্রে তাকায়ে দেখে যে এই মংগলীয়রা বিজয়ী হয়েও বিজিতদের ধর্ম ইসলাম কিভাবে দলে দলে গ্রহন করেছে। সব উলামা কিন্তু এখনো ইয়াজুজ মাজুজ আসেনি এটা ধারণা করেন। অথচ ডঃ ইমরান দ্ব্যার্থহীন ভাবে বলেছেন গগ ম্যাগগ বা ইয়াজুজ মাজুজ এসে গেছে। ডঃ ইসরার ধারণা করেছেন চীন ও রাশিয়ার সখ্যতাই বুঝায় ইয়াজুজ মাজুজ ওরাই হবে। এই দৃষ্টিভংগীকে ‘ধারণার’ চেয়ে বেশী বলা যাবেনা।
এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে এই আলামত সমূহ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে কিয়ামতে মুক্তির জন্য কিয়ামতের আগে দুনিয়াতেই প্রস্তুতি নেয়া। আমাদের নবীর (সা) এর কাছে এনিয়ে প্রশ্ন উঠালেই তিনি বলতেনঃ "মাযা আ'দাদতা লাহা। তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছো?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন