শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

জোড়া বিকেলের গল্প

মুহাম্মদ কামাল হোসেন | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৯, ১:৩০ এএম

আমি-মীরু। খুব শান্তশিষ্ট ও ভদ্রগোচের লাজুক একটি ছেলে। অবশ্য এটা আমার নিজের কথা না। লোক মুখে শ্রুত কথা। কথায় বলে, লোকের মুখে জয় আবার লোকের মুখে ক্ষয়! কিন্তু আমার ব্যক্তিগত উপলব্দীতে একটু ভিন্নতা রয়েছে। আমি মোটেও অতটা বল্গাহীন শান্তশিষ্ট নই। কিছু চারিত্রিক মিতব্যয়িতা থাকলেও উড়নচন্ডী মনোভাব মজ্জাগত। আমি প্রেমে পড়েছি ফুড়ুৎ করে। যদিও কথাটা হবে প্রেম-ই আমার ওপর এসে পড়েছে। যাহোক, এই মুহূর্তে আমি ঘোরতর ঝামেলায় পড়ে আছি নিজের জিএফ’কে নিয়ে। জিএফ মানে গার্লফ্রেন্ড। দুস্তর গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে গেছি। নিশ্চিত ক্রাশ খাওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু এই বিপদসংকুল সময়ে যাকে সবচেয়ে কাছে পাবার কথা, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই ভদ্রলোকের মুখের চেয়ে আবার বামহাতখানা একটু বেশি-ই চলে।
অ্যাই মীরু, ওই ছেলেটা কে’রে? কথার মাঝখানে বামহাত ঢুকিয়ে দিল!? এ জাতীয় প্রশ্ন আমার জন্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ঃশ শুনতে হয়। কথার মাঝখানে সরাসরি বামহাত চালিয়ে দেয়া‘ও’র অভ্যাস। আমার বন্ধু রাতিকের কথা বলছিলাম। দু’দিন ধরে পণ করেছি রাস্কেলটার নাম মুখেই তুলব না। তবুও তুলতে হল। উপায়ান্তর নেই। সর্বনাম ও বিশেষণ দিয়ে একজন মানুষকে কতক্ষণ সম্মোধন করা যায়। সংগত কারণে চেপে রাখা বিরক্তিটুকু প্রকাশে মোটেও দ্বিরুক্তি করিনি। কথাবার্তার মাঝখানে বামহাত চালিয়ে দিতে রাতিক মস্তবড় ওস্তাদ। বরাবরি এবিষয়ে সিদ্ধহস্ত ও দু’ধাপ এগিয়ে। এই নিয়ে কারো কোনো প্রকার মতি-অনুমতির তোয়াক্কা করে না। একদম সরাসরি বামহাত ঢুকিয়ে দেয়! আপনি ভাবছেন, নির্ঘাত বদঅভ্যাস বুঝি? বেয়াদবও কিছুটা? হা হা হা..মোটেই সেরকম কিছু নয়। রাতিক যথেষ্ট ভদ্র ও আমুদে। সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখে। সেকেন্ডের ভুলে লোকে‘ও’কে প্রথমে একটু ভুল বুঝলেও,পরে ঠিকই শুধরে নেয়। আমার প্রিয়তমা সু’দরী তন্বী তরুণী গার্লফ্রেন্ড প্রথমাও একবার ভুল বুঝেছিল। সেও পরে নিজেকে শুধরে নিয়েছে। অবশ্য কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রমও এর জন্য দায়ী। পরক্ষণে সবাই বুঝতে পারে প্রকৃত বিষয়টা। আসলে রাতিকের ডান হাতের কব্জিখানাই নেই!! (কারো অঙ্গহানি নিয়ে হাসি-তামাশা করা প্রকৃতপক্ষে লেখকের আসল উদ্দেশ্য নয়। এগুলো লেখক কস্মিনকালেও সমর্থন করেনা) ছোটবেলায় কোনো এক অজ্ঞাত রোগের বলি স্বরূপ রাতিককে ডানহাতখানার অংশবিশেষ কেটে ফেলতে হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই আহ (!) উহ্ (!) কিংবা বেচারা-গোবেচারা (!) টাইপের শব্দগুলো রাতিকের উদ্দেশ্যে খর্চা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? একজন প্রকৃত মানবিক মানুষ হিসেবে সেটা করতেই পারেন। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। বরং আসল সত্যটা হলো, রাতিকের জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে। অত্যন্ত সুনামের সহিত মাথা উঁচু করে। সমাজের অন্যদশজন সুস্থ মানুষের চেয়েও ঢের ভালো। এক হাতেই তুলে নিয়েছে সে নিজের গোটা একটি পরিবারের দায়িত্ব। চাকুরী করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতন-মাইনেও ম’দ নয়। খুব ভালো। বেশ আয়েশে-আবেশে দিনকাল কেটে যাচ্ছে। যদিও গত দু’দিন ধরে রাতিকের টিকিটির নাগাল খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই অফিসের নানামুখী কাজের পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত ব্যস্ততার চাপ রয়েছে। কিন্তু এদিকে আমি পড়ে আছি মস্তবড় বিপদে। প্রথমার সাথে ব্রেকআপ হবার উপক্রম। দু’বৎসর যাবৎ ঢিমেতালে চলতে থাকা সম্পর্কটার শেষ রক্ষে বুঝি আর হল না! কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। পেট খারাপ হলে যেমন করে চেপে রাখা যায়না, তেমনি কাঁচুমাচু অবস্থা আমার। মওকা খুঁজে পাচ্ছি না, করবটা কী? পেট সারাতে আছে ঘনঘন ঔরস্যালাইন ও ফ্ল্যাজিল ফোর হান্ড্রেড ক্যাপসুল! ক্রাশ ঠেকাতে কী!?
এসব বিষয়ে আবার রাতিকের রয়েছে উর্বর শাণিত মস্তিষ্ক। যাবতীয় ঝুটঝামেলা ও ঝক্কিপক্কি থোড়াই কেয়ার। চট করে একটা উপায় ঠিকই খুঁজে বের করবে। শুধু কথার মাঝখানে বামহাতখানা চালাতে পারলেই হল।ব্যস,ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু অই কালপ্রিটটা গেল কই? মোবাইল ফোনটাও সুইচঅফ!
প’তে‘প্রথম’ শেখার অতটুকুন লাজরাঙ্গা বাচ্চা বয়সেও বুঝতে পারিনি আমার জীবনে‘প্রথমা’ বলে কোন সু’দরী তন্বী তরুণী অপেক্ষা করবে। প্রেমের বৃ’দাবনে সুখের আবেশে আমাকে নিয়ে ভেসে বেড়াবে। একদিন সত্যি সত্যি হলও তাই। আলো ঝলমল করে প্রথমা আসলো আমার জীবনে। এই নিয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুমহলে আমাকে নিয়ে কানাঘুষা ও হিংসে-ফিংসেও কম নয়। একেক জনের গা পিত্তি জ্বলে অঙ্গার। রাখঢাক না রেখে কেউ কেউ ত বলেই ফেলে,
মীরু একেই বলে, চাঁদ কপাল! কপালের নাম গোপাল!! আয় কাছে আয় আমাদেরটাও একটু ঘষি।
ঘষার জন্য বাজার থেকে শিরিষ কাগজ নে। খুব ভালো কাজ দেবে!
আমার তীর্যক তড়িৎ শ্লেষামিশ্রিত কথায় ওরা রণে ভঙ্গ দেয়। অযথা আমাকে আর গাটাতে আসেনা। প্রথমার সাথে আমার প্রথম দেখাটাও হয়েছিল একটু অন্যরকমভাবে। সাসপেন্স,ড্রামা ও থ্রিলার সবি ছিল। ছিল ভিলেন অমরেশপুরীও। বেচারি কলার খোসায় স্লিপ খেয়ে পড়তে পড়তেও পড়েনি। ফিল্মী স্টাইলে নায়কোচিতভাবে পেছন থেকে ওকে ধরে ফেলি।ব্যস, একধাক্কায় প্রেম! বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জনের ডিপার্টমে’ট ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রেমের গতিপথটা কিন্তু ওইদিন থেকে অভিন্ন ছিল। একই মোহনায় মিশে গিয়েছিল। এরপর থেকে আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দু’জনে দিব্যি চুটিয়ে প্রেম করে বেড়িয়েছি। ভালোবেসে প্রথমাকে আমি‘নিরুপমা’ বলে ডাকি। কিন্তু এখন আমি রীতিমতো ক্রাশ খাওয়ার অপেক্ষায়। ঘটনার সূত্রপাত হয়, ফেসবুকে এক সু’দরী রমণির প্রোপাইল পিকে‘লাভ রিঅ্যাকশনে’ লাইক দেয়া নিয়ে। ব্যস তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে প্রথমা। আমার স্বভাব চরিত্র নিয়ে সেদিনেই মুখের ওপর উপ্তপ্ত গোলাবর্ষণ শুরু করে। শুনিয়ে দেয় ডজনখানেক কথা। আজ বিকেলে শেষবারের মত আমার সাথে দেখা করে সম্পর্কের পুরোপুরি ইতি টানতে চায়। বুঝুন ঠ্যালা! আমার অবস্থা রীতিমতো লেজেগোবরে! ত্রাহি মধুসূদন!!
অবশেষে রাতিককে খুঁজতে বাতি নিয়ে বেরুতে হয়নি। সে অফিসের এক জরুরি মিটিং এ ঢাকা গিয়েছিল। মিটিং বলেই মোবাইল ফোনও সুইচ অফ ছিল। ও’কে কাছে পেয়ে সবিস্তারে ঘটনার পুরো ফিরিস্তি তুলে ধরি। রাতিক সবকিছু শুনে মুচকি হাসে।
কিরে হাসছিস কেন? কিছু একটা উপায় খুঁজে বের কর। আমাকে বাঁচা প্লীজ।
শোন মীরু, প্রেমে এত ভীরু হতে নেই। শিরদাঁড়াটা আরো একটু সোজা শক্ত রাখ।দেখিস কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু উপায়টা কী? কিছু তো একটা খুঁজে পেয়েছিস?
নিশ্চয়ই পেয়েছি। আচ্ছা শোন, নিরুপমাকে আজ দেখার পর তোকে সটান অজ্ঞান হয়ে যেতে হবে,ব্যস?
বলিস কী! ফাজলামো হচ্ছে?
হুমমম ঠিকই বলছি। এটাকে বলে বাইন ফর্মুলা। কিছুক্ষণ বাইন মাছের মতো ঝিম ধরে টাসকি মেরে থাকবি। দেখবি কাজের কাজ হয়ে গেছে।
কস কীরে..!
হুমম একদম ঠিকই বলছি।
ভেবে দেখলাম রাতিকের আইডিয়াটা খুব একটা ম’দ নয়। ভালোয় ভালো কাজটা করতে পারলেই এ যাত্রায় বেঁচে যাই। রাতিকের‘বামহাতের খেল’ একেই বলে। এখন শুধু দেখার পালা। আমি বিকেলের নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই পার্কে চলে আসি। আজ মানুষজনেরও উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে একটু কম। মাথামুতা আমার এম্নিতে ঠিক নেই। যথাসম্ভব আজ প্রথমার পছ’েদর প্যা’ট জামা ও জুতা থেকে শুরু করে সবকিছু পরে এসেছি। দেখাই যাক প্রেয়সী’র মনটা কোন কর্ণার দিয়ে গলে। বেঞ্চে বসে আছি ওল্টো মুখি হয়ে উদাস দেবদাস ভঙ্গিতে। এই চিরচেনা পার্কের সবকিছু আমার নখদর্পনে। প্রেয়সীর কোলে মাথা রেখে একটা সময় রোজ ওর মুখে জোড়া বিকেলের গল্প শুনতাম। বৈকালিক হিমেল হাওয়ায় ওর অবাধ্য দুষ্টু এক গোছা চুল বারবারই ওর চোখেমুখে গিয়ে পরতো। আমি আলতোভাবে মুগ্ধের মতো ছুঁয়ে দিতাম। কিছুক্ষণ পরে ছোট্ট একটা কাঁশি দিয়ে আলো ঝলমলিয়ে প্রথমা এসে আমার পেছনে দাঁড়ায়। ঘাড় ফিরিয়ে আমি স্বর্গের অপ্সরীকে‘হা’ করে চেয়ে থাকি। কারো মুখে কোনো প্রকার সাড়াশব্দ নেই। এভাবে কেটে যায় আরো কিছুটা সময়। হঠাৎ প্রপোজ দেয়ার ভঙ্গিতে জমিনে হাঁটু গেড়ে বসি। প্রথমার ডানহাতের অনামিকা আঙ্গুলখানা ধীরে ধীরে নিজের হাতে তুলে নিই।
ওগো নিরুপমা, এই অধমকে শেষবারের মতো ক্ষমা করা যায় না? আমি যে আর পারছি না।প্লীজ....
ব্যস, কথা শেষ করতে পারিনি (আসলে চাইনি)। মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে পার্কের সবুজ চত্বরে লুটিয়ে পড়ি। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমা হতভম্ব হয়ে পড়ে। একা একটি মেয়ে মানুষ কী করবে বুঝেও ওঠতে পারছে না। আমি বাইন মাছের মতো কিছুক্ষণ ঝিম ধরে খিচ মেরে থাকি। মাঝে মধ্যে চোরা চোখে পরিস্থিতিও আঁচ করার চেষ্টা করছি।
অ্যাই মীরু অ্যাই, হঠাৎ করে তোমার কী হয়েছে! প্লীজ কথা বল। কথা বল বলছি। তোমার কিছু হতে পারেনা!! তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না। নির্ঘাৎ মরে যাব।
এসব বলতে বলতে প্রথমা আমায় গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে। শুরু করে কান্নাকাটি। চোখের জলে নাকের জলে একাকার। বিষয়টাকে আর বেশিদূর এগোতে দেয়া যায় না। লেবু বেশিক্ষণ কচলালে তেতো হয়ে যায়। আপাতত কাজের কাজ যেটুকু হবার তাতো হয়ে গেছে। ভালোবাসা এখন জমে ক্ষীর। হিতে বিপরীত হওয়ারও সমূহ চান্স আছে। আশেপাশের লোকজনও নিশ্চয়ই এতক্ষণে চলে আসতে পারে। আমি অল্প অল্প করে চোখ মেলে তাকাই। নিরুপমার হাত ধরে আস্তে আস্তে ওঠে বসার চেষ্টা করি। আলতোভাবে ওর চোখের পানি মুছে দিই। আর কেঁদো না সোনা, আমি ঠিক আছি। খুশিতে ও’র চোখজোড়া চিকচিক করে ওঠে। পরম যতে্ন ও বিগলিত ভালোবাসায় আমাকে শক্তবাঁধনে জড়িয়ে ধরে। নিমিষে অস্বস্তির বাতাবরণ কেটে গিয়ে দেহমনে একপশলা বৃষ্টির স্বস্তির সুবাতাস ফিরে আসে। অনাবিল প্রশান্তির ছোঁয়ায় আমার চোখজোড়া ক্রমশ বুজে আসে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন