আইসিসির উপর ভারতের একচ্ছত্র প্রভাবের ফলশ্রুতিতে আম্পায়ারদের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের কারণে গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে থেমে গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা। সেদিনই বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদের হৃদয় থেকে হারিয়ে গেছে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি সমর্থন। চার বছর পুষে রাখা সেই যন্ত্রনা আর কষ্ট এবার প্রথম ম্যাচেই দুর করে দিয়েছে টাইগার বাহিনী। তবে দুর্ভাগ্য যে, প্রথম ম্যাচে তারা পায়নি সেই ভারতকে। লন্ডনের কেনিংটন ওভালে গতকাল বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দুর্দান্ত সূচনা করেছে বাংলাদেশ। রেকর্ডের ফুলঝুরি ছুটিয়ে প্রথম ম্যাচেই আসরের অন্যতম ফেভারিট দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়েছে মাশরাফির দল।
ম্যাশ বাহিনীর শুরুটাই ছিল বীরোচিত রেকর্ডের মধ্য দিয়ে। কখনোই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়নি বাংলাদেশের। সব দিক মিলিয়েই যোগ্যতর দল হিসেবে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। টস হেরে ব্যাটে নেমে সাকিব-মুশফিকের রেকর্ড জুটির উপর দাঁড়িয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৩০ রানের সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে তো বটেই যে কোনো ধরণের একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড এটি। জিততে হলে বিশ্বকাপে রান তাড়ার রেকর্ড গড়তে হত দক্ষিণ আফ্রিকাকে। বিশ্বকাপে তিনশ রান তাড়া করেই জয়ের রেকর্ড নেই তাদের। সাকিব-মিরাজের ঘূর্ণী আর মুস্তাফিজ-সাইফউদ্দিনের পেস তান্ডবে তা আরো অসম্ভব হয়ে ওঠে। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩০৮ রানে থেমে যায় ফাফ ডু প্লেসিস বাহিনীর ইনিংস। আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে তারা স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ১০৪ রানে হেরেছিল। এর আগে ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬৭ রানে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এমন দিনে দ্রুততম ৫ হাজার রান ও আড়াইশ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছানো সাকিব আল হাসান হয়েছেন ম্যাচসেরা।
টস ভাগ্যে হারলেও অধিনায়ক মাশরাফির অনুমানটা সঠিক ছিল, বলেছিলেন, ‘এই পিচে রান আসবে’। এরপরও একটা শঙ্কা ছিলই। এর আগে উপমহাদেশের দুই দল প্রথমে ব্যাট করে দেড়শর আগে গুটিয়ে হেরেছে বড় ব্যবধানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাউন্সারের সামনে রেকর্ড ব্যবধানে হেরে বিশ্বকাপ শুরু করে পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কাও নিউজিল্যান্ডের পেসের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। উইন্ডিজ ও কিউদের পেস বোলিং অ্যাটাকের চেয়ে প্রোটিয়া বোলিং আক্রমণ কম শক্তিশালী নয়। যদিও ইনজুরির কারণে এদিন ছিলেন না ডেল স্টেইন। কিন্তু লুঙ্গি এনগিডি, কাগিসো রাবাদা ও আন্দিলে ফেলুকাওয়েদের বোলিংয়ের সঙ্গে সবাই পরিচিত। আর ইমরান তাহিরের জাদুকরী ঘুর্ণী বল তো ছিলই। কিন্তু সবকিছু দারুণভাবে সামলানোর পর আসে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং লাইন-আপ রুখে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জেও জিতে বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসরে দুর্দান্ত সুচনা করে লাল-সবুজের দল।
ওভাল গতকাল যেন রূপ নেয় মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। ২৩ হাজার দর্শক ধারণক্ষম গ্যালারির প্রায় ৮০ শতাংশ দর্শকই ছিলেন লাল-সবুজের প্রতিনিধি। মুহূর্মুহু আওয়াজে সাকিব-মুশফিকদের প্রেরণা দিয়েছেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা প্রবাসী বাংলাদেশীরা। দেশ থেকে খেলা দেখতে যাওয়া দর্শকরা তো ছিলেনই। আর বাংলাদেশ তো বটেই পুরো পৃথিবীতে টিভি পর্দায় ছিল কোটি কোটি টাইগার ভক্তদের দৃষ্টি। ঈদের ব্যস্ততা আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ম্যাচের দিকেই ছিল তাদের নজর। তাদের হতাশ করেননি মাশরাফি-সাকিবরা।
স্কোর বোর্ডটাই বাঁধাই করে রাখার মতো। সবার নামের পাশেই রান। তামিম-সৌম্যের ব্যাটে ৬০ রানের ঝড়ো শুরু। ১৫ রানের ব্যবধানে দুজনের বিদায় নেয়ার পর সাকিব-মুশফিকের সেই রেকর্ড জুটি। একটু একটু করে বাংলাদেশের স্বপ্নকে এগিয়ে নেন অনেক ম্যাচের দুই কাণ্ডারী।
গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশের হয়ে যে কোনো উইকেটে ১৪১ রানের রেকর্ড জুটি গড়েছিলেন সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ। এবার তার চেয়ে এক রান বেশি করলেন সাকিব-মুশফিক। সব মিলে এটি তাদের রেকর্ড পঞ্চম শতরানের জুটি। ৮৪ বলে আট চার ও এক ছয়ে ৭৫ রান করা সাকিবকে বোল্ড করে জুটি বিচ্ছিন্ন করেন তাহির। তার আগে তামিম ইকবালের পর দেশের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এগারো হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব। পরে বল হাতে একটি উইকেট নিয়েই এক দিনের ক্রিকেটে দ্রুততম পাঁচ হাজার রান ও ২৫০ উইকেটের রেকর্ডের মালিকও বনে যান বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
ঠিক আড়াইশ রানে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে ডিপ পয়েন্ট ক্যাচ দেন মুশফিক। তার আগে উপহার দেন ম্যাচ সর্বোচ্চ ৮০ বলে আট চারে ৭৮ রানের ইনিংস। বাকি সময়টা ছিল মাহমুদউল্লাহ শো। মোসাদ্দেক ও মিরাজকে নিয়ে শেষ ৪৭ বলে যোগ করেন ৮০ রান। ৩৩ বলে তিন চার ও এক ছক্কায় ৪৬ রানের অপরাজিত থাকেন মাহমুদউল্লাহ।
প্রোটিয়াদের শুরুটাও ছিল দারুণ। টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের দৃড়তা প্রথম চার উইকেট থেকে আসে চারটি চল্লিশোর্ধো রানের জুটি। কিন্তু যখনই জুটি চোখ রাঙাতে গেছে তখনই উইকেট খুঁইয়েছে। শুরুর দিকে সাইফউদ্দিন-মুস্তাফিজরা মার খেলেও শেষদিকে দুরুণ বোলিংয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন। ৬৭ রানে ৩ উইকেট নেন মুস্তাফিজ, ৫৭ রানে ২টি নেন সাউফউদ্দিন। মিতব্যায়ী বোলিংয়ে একটি করে উইকেট নেন মিরাজ ও সাকিব। সর্বোচ্চ ৬২ রান করেন অধিনায়ক ডু প্লেসিস। চল্লিশোর্ধো ইনিংস খেলেছেন মার্করাম (৪৫), ভন ডার ডুসেন (৪১), ও জেপি ডুমিনি। ৪৮তম ওভারে মুস্তাফিজের বলে ডুমিনি বোল্ড হতেই এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জয়।
আগামী ৫ জুন এই মাঠেই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। একই দিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করবে ভারত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন