ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৫০ ওভারে ৩২১/৮
বাংলাদেশ : ৪১.৩ ওভারে ৩২২/৩
ফল : বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী
ওশানে থমাসকে দর্শনীয় কাভার ড্রাইভে বাউন্ডারি ছাড়া করে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে দেশের হয়ে এর আগে যে কীর্তি আছে কেবল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। শতকটিও এলো ঝড়ো গতিতে। কিন্তু সাকিবের উদযাপনে কোনো উন্মাদনা নেই। বাঁ-হাতে ব্যাট উঁচিয়ে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিলেন মাত্র। বিশ্বসেরা অল-রাউন্ডারের দৃষ্টি যে তখন আরো দূরেÑ রেকর্ড তাড়া করে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে বাংলাদেশের জন্য জয় ছিনিয়ে আনা।
প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২১ রানের পাহাড় টপকে সেই ক্ষণ যখন এলো সাকিবের নামের পাশে তখন অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংসটা ঝলমল করছে। আর সঙ্গী লিটন দাশ? একে তো বিশ্বকাপে এটি তার প্রথম ম্যাচ, তারপর নতুন পজিশন। কিন্তু এর কিছুই তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতেই খেললেন ৬৯ বলে ৯৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস। বাংলাদেশও রান তাড়ায় নিজেদের রেকর্ড গড়ল ৫১ বল আর ৭ উইকেট হাতে রেখে।
বিশ্বকাপেই এর চেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড রয়েছে মাত্র একটি। ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের দেওয়া ৩২৯ রান তাড়া করে জিতেছিল আয়ারল্যান্ড। আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সফলতম রান তাড়ার রেকর্ড ছিল গত আসরে, স্কটল্যান্ডের দেওয়া ৩১৯। পাঁচ ক্যারাবীয়ান পেসারকে সামলে এর সবকিছুই এবার বাংলাদেশ পেরিয়ে গেল মাত্র ৪১.৩ ওভারেই! এই জয়ে সেমিফাইনালের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। দশ দলের পয়েন্ট তালিকায় টাইগারদের অবস্থান এখন পাঁচে।
বিশ্বকাপের ২৩তম ম্যাচের এই স্কোরবোর্ডটা সত্যিই বাঁধিয়ে রাখার মত। বাংলাদেশের রানের পাশে থাকা উইকেট আর বাকি ওভারগুলোর দিকে বার বার চোখ গিয়ে আটকে যায়। সত্যি দেখছি তো! তার চেয়েও বড় সত্যিটা হলো, সাকিব-লিটন কাল যে মুডে ছিলেন তাতে তিনশ ষাট-সত্তুর রান তাড়া করাও যেন ছিল নস্যি ব্যাপার। রেকর্ডময় একটা ম্যাচ জয়ের পর তাদের উদযাপনেও কী দারুণ পূর্ণতা। বাড়তি কোনো আবেগ তাদের ছুঁয়ে যায়নি। যেন ম্যাচটা তাদের জেতার কথাই ছিল।
টন্টনের এই মাঠটা বিশ্বকাপের অন্য মাঠগুলোর তুলনায় অনেক ছোট। যে কারণে ক্রিস গেইল এবং আন্দ্রে রাসেলকে দ্রæত ফেরানোই ছিল বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ জিতলেও বড় স্কোর গড়া থেকে তাদের আটকানো যায়নি। টপ ও মিডিল অর্ডারের বাকি ব্যাটসম্যানদের মিলিত প্রচেষ্টায় ৮ উইকেট হারিয়ে ৩২১ রান সংগ্রহ করে ক্যারিবীয়রা।
রেকর্ড লক্ষ্য তাড়ায় শুরুটা যেমন হওয়ার দরকার ছিল তেমনটাই করেন দুই টাইগার ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। সৌম্যের আক্ষেপের বিদায়েই ভাঙে ৫২ রানের উদ্বোধনী জুটি। সৌম্যের রেখে যাওয়া সুরটাই বাকি সময় ধরে রাখেন সাকিব। ১৩ ওভারে আসে দলীয় শতক। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত নিজেকে চেনাতে শুরু করা তামিমের আত্মবিশ্বাসী ইনিংস থেমে যায় ফিফটি থেকে দুই রান দূরে দলীয় ১২১ রানে দুর্ভাগ্যজনক রান আউটে। ১২ রানের ব্যবধানে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের বড় স্তম্ভ মুশফিকুর রহিমও বিদায় নিলে হঠাৎই কালো মেঘ জমে টাইগার ভক্তদের মনের আকাশে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেই মেঘ সরিয়ে দিয়েছেন সাকিব আল হাসার আর লিটন দাশ। দর্শনীয় সব শটে দুজনে বাউন্ডারী ছাড়া করেছেন হোল্ডার-গ্যাব্রিয়েল-টমাসদের। গড়েছেন বিশ্বকাপে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১৮৯* রানের জুটি। চলতি আসরেও এর চেয়ে বড় জুটির দেখা মেলেনি এখনো। এই জুটির মাঝেই সাকিব পেরিয়েছেন ব্যক্তিগত ছয় হাজার রানের মাইলফলক। টানা চার ম্যাচে করেছেন পঞ্চাশোর্ধো ইনিংস। বিশ্বকাপে যে কীর্তি আছে কেবল নভজাত সিং সিধু (১৯৮৭), শচিন টেন্ডুলকার (১৯৯৬) ও গ্রায়েম স্মিথের (২০০৭)। চলতি আসরে সর্বোচ্চ রানের তালিকাতেও ৩৮৪ রান নিয়ে ফিরেছেন শীর্ষন্থানে।
শুরু থেকেই বোলারদের উপর চড়াও হয়ে থাকা সাকিব ৪০ বলে করেন ফিফটি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে যা দ্বিতীয় দ্রæততম। দ্রæততম ফিফটি মুশফিকের, ২০১৫ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, ৩৮ বলে। তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন ৮৩ বলে। আসরে এর চেয়ে দ্রæততম শতক কেবল জস বাটলারের, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭৫ বলে।
দ্য কুপার অ্যাসোসিয়েট কাউন্টি গ্রাউন্ডে টসজয়ী বাংলাদেশের শুরুটাও ছিল দারুণ। মাঝের সময়ে কখনো মনে হয়েছে উইন্ডিজ তিনশর বেশি করতে পারবে না। আবার কখনো মনে হয়েছে সংগ্রহটা সাড়ে তিনশ পেরিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এর মাঝামাঝি সংগ্রহ পায় তারা। ৫ ওভারে উইন্ডিজের স্কোরবোর্ডে জমা পড়ে গেইলের মত উইকেট হারিয়ে মাত্র ৮ রান। ১০ ওভার শেষে স্কোর ছিল ১ উইকেটে ৩২। মাশরাফি কোনো উইকেট না পেলেও কিপটে বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের উপর চাপ ধরে রাখেন। দ্বিতীয় উইকেটে ইভিন লুইস ও হোপের ১১৬ রানের জুটিতে চাপটা ভালোমত সামলে নেয় হোল্ডার বাহিনী। ৬৭ বলে ৭০ করা লুইসকে ফিরিয়ে রাশ টেনে ধরেন সাকিব আল হাসান।
৩০ থেকে ৪০- এই ১০ ওভারে ম্যাচের সুর পাল্টে দেন শিমরান হেটমায়ার ও জেসন হোল্ডার। ১০ ওভারে তারা তুলে নেয় ৯২ রান। বিশাল বিশাল ছক্কায় দুজন মেতে ওঠেন একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায়। হেটমায়ার ১০৪ মিটার ছক্কার টুর্নামেন্ট রেকর্ড গড়ে যাওয়ার পর ব্যাটে এসে ১০৫ মিটার দীর্ঘ ছক্কা হাঁকান হোল্ডার। ৩০ ওভার শেষে যে স্কোর ছিল ২ উইকেটে ১৫১, সেটাই ৪০ ওভার শেষে ফুলে ফেঁপে দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ২৪৩! শেষ দিকে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন মুস্তাফিজ-সাইফরা।
পুরো উইন্ডিজ ইনিংসের মূল জ্বালানি ছিল শাই হোপের ১২১ বলে ৯৬ রানের ব্যক্তিগত ইনিংসটি। চতুর্থ উইকেটে তার সঙ্গে ৪৩ বলে ৮৩ রানের জুটি গড়ে ম্যাচের চিত্র পাল্টে দেন হেটমায়ার। হোল্ডার এসে ১৫ বলে ৩৩ রান করে রানের চাকা সচল রাখেন। তার ফেরার পর দলীয় সংগ্রহটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। শেষ ৩৮ বলে তারা নিতে পারে মাত্র ৩৯ রান।
বোলারদের মধ্যে কেবল মাশরাফিই রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ছয়ের নিচে। তিনটি করে উইকেট নেন সাইফউদ্দিন ও মুস্তাফিজ, দুটি নেন সাকিব। কিন্তু দিন শেষে সাকিব-লিটন যা করলেন তাতে বাকি সবকিছুই হয়ে গেছে ¤øান। ২৪ জুন পরবর্তি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলে অন্য প্রতিপক্ষগুলো টাইগারদের বাড়তি সমীহের দৃষ্টিতে দেখবে বৈকি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন