দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক বখাটেরাজ (রাজত্ব) কায়েম সহ আইন শৃংখলার বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতার সর্বশেষ নজির বরগুনা শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত হত্যাকাণ্ড। এ অভিমত বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ ছাড়া আমজনতারও। গত কয়েকটি বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ছিচকে মাস্তান, উঠতি মাস্তান সহ বখাটেদের দৌরত্বের কাছে সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়লেও তা থেকে উত্তরণের কোন উদ্যোগ নেই। এমনকি অনেক এলাকাতেই এসব বখাটে ও ছিচকে মাস্তানরাই সমাজ সহ আমজনতার ভাগ্য নিয়ন্তা বলেও অভিযোগ রয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব বখাটেদের নানামুখী অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজকে কলুষিত করার পাশাপাশি সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করলেও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় অসহায় সাধারণ মানুষ। বরিশাল মহানগরী সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ইভটিজিং ইতোমধ্যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও কোন প্রতিকার নেই। মাদক ব্যবসাও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
গত ২৬জুন বরগুনা শহরে কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় প্রকাশ্য দিবলোকে স্ত্রী সহ কয়েক’শ লোকের সামনে নৃসংশভাবে কুপিয়ে রিফাতকে জখম করার পরে ঘাতকের দল সদর্পে এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাস্থল থেকে বরগুনা সদর থানার দুরত্ব দশ মিনিটের বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ঘাতকরা রিফাতকে কুপিয়ে জখম করে মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে যাবার পরে এলাকাবাসী ও তার স্ত্রী হাসপাতালে নেয়ার পরেই সেখানে পুলিশ পৌছে। তবে বরগুনার এসপি দাবী করেছেন, ‘পুলিশই রিফাতকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়’। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, ‘গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের কোন শহরে বিরোধী রাজনৈতিক দল সভাÑসমাবেশ বা মিছিল বের করতে পারেনি। অতি দ্রুত ও কঠোর তৎপড়তার সাথে পুলিশ রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিহত করার কৃতিত্ব অর্জন করলেও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে নারকীয় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা নিরাপদে চলে গেলেও সেই পুলিশের তৎপড়তা চোখে পরেনি’।
প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক’শ মানুষের সামনে ১২-১৪টি বখাটে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করলেও কেউ এগিয়ে না আসার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধীক ব্যাক্তি জানিয়েছেন, ‘হামলাকারী নয়ন বন্ড সহ তার সহযোগীদের ‘গড ফাদার’ বরগুনা শহরে এতটাই প্রভাবশালী যে কেউ ঐসব খুনিদের কাছ থেকে রিফাতকে উদ্ধারে এগিয়ে যাবার সাহস করেনি’।
রিফাতের হত্যাকান্ডের পরে দেশ যুড়ে ব্যাপক তোলপার শুরু হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। দেশের উচ্চ আদালত থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এপর্যন্ত এজাহারভূক্ত এক আসামী সহ সন্দেহভাজন চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ৩জনকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি বরগুনায় ছুটে গিয়ে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সরেজমিনে খোজ খবর নিয়েছেন। এমনকি এক ঘাতকের সাথে চেহারায় মিল থাকায় সন্দেহজনকভাবে বরিশাল নৌ টার্মিনাল থেকে তিন কিশোরকে আটক করলেও পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
রিফাতের এ নৃসংশ হত্যাকান্ড দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের স্বরূপ কিছুটা হলেও প্রকাশ্যে এনেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। কিন্তু এতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের বর্তমান অবস্থান কতদিন অব্যাহত রাখবেন সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে সাধারন মানুষের মধ্যে।
গত কয়েক বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল যুড়ে এক শ্রেণীর বখাটে সহ ছিচকে মাস্তানের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রনে আইনÑশৃংখলা বাহিনীর উদাসীনতা নিয়েও বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রশ্ন উঠেছে। আর এত দিনের উদাসীনতায় এসব মাস্তান ও বখাটেরা ক্রমশ নিয়ন্ত্রনের বাইরেই চলে গেছে। সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল যুড়ে এসব মাস্তানরা বৈধ অবৈধ মোটার বাইক নিয়ে দিন রাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে ট্রাফিক আইনের কার্যকরিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এমনকি নিকট অতীতে যে বৃহত্তর বরিশাল শিক্ষা ক্ষেত্রে সারা দেশের শীর্ষে অবস্থান করত, ইতোমধ্যে তা ক্রমবনতির দিকে। গত কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল নিয়েও হতাশা রয়েছে সাধারন মানুষের মধ্যে। এ বোর্ডের পাশের হার সারা দেশের মধ্যে নিচের দিকে। কৃতকার্য ছাত্রÑছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ-৫’এর হার ৩%’এর বেশী নয়। বছরের পর বছর ধরে ছাত্ররা ছাত্রীদের চেয়ে পিছিয়ে পরছে। আর যে বরগুনা এখন সর্বাধীক আলোচিত, সেখানে পাশের হার শিক্ষা বোর্ডের ৬টি জেলার মধ্যে নিচের দিকে। এমনকি গত দশ বছরের ফলাফল বিশ্লেষনে কোন কোন বছর বরগুনা জেলায় পাশের হার সারা দেশের মধ্যে ১০%-এরও কম দেখা গেছে।
তবে শুধু বরগুনাই নয়, বরিশাল মহানগরী সহ সমগ্র দক্ষিনাঞ্চল যুড়েই সামাজিক অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। মাদক, ইভটিজিং সহ সুস্থ্য সমাজ ব্যাবস্থার বিরোধী কর্মকান্ড ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করছে। বরিশাল মহানগরীর বিভিন্ন পার্ক ও মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে দিনরাত স্কুল ও কলেজগামী ছাত্রÑছাত্রীরা অড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে। বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি শহরের পার্কগুলোতে অনেক রাত পর্যন্ত ছাত্রÑছাত্রীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। খোদ বরিশাল মহানগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও স্বাধীনতা পার্ক সহ বিভিন্ন পার্কে অনেক রাত পর্যন্ত যেভাবে স্কুলÑকলেজগামী শিক্ষার্থীদের আড্ডা চলে, তাতে ঐসব স্থানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ বিলুপ্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানের ছাতার নিচে অনেক রাত পর্যন্ত কারা কিভাবে অবস্থান করে তা নিয়ে একাধীকবার পুলিশÑপ্রশাসনের সভায় প্রশ্ন উঠলেও প্রতিকার হয়নি। ফলে ঐ উদ্যানের ওয়াক ওয়েতে হাটার পরিবেশ ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বরগুনায় নৃসংশভাবে রিফাত হত্যাকান্ড গোটা দেশকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তার পেছনের সবগুলো কারন খতিয়ে দেখে অবিলম্বে প্রতিকারে তৎপড় হলে পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। এবিষয়ে জোড় তাগিদ রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের আম জনতারও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন