বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ সংখ্যা

কোরবানি ও আমাদের করণীয়

আতিকুর রহমান নগরী | প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

ঈদুল আজহা ও কোরবানি এ দুটি ব্যাপার আল্লাহ প্রদত্ত বান্দার জন্য এক স্পেশাল নেয়ামত। আর তা জিলহজ মাসেই পালন করা হয়। তাই প্রথমে সংক্ষিপ্তাকারে এ মাসের ফযিলত দিয়ে আলোচনা শুরু করছি।
হাদিসের আলোকে জিলহজ মাসের ফযিলত: (১) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, “ইবাদত-বন্দেগির জন্য জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন ব্যতিত আল্লাহর নিকট উত্তম দিন আর নেই”।
(২) হযরত যাবের (রা.) হতে বর্ণিত নবিয়ে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, “ইবাদতের জন্য আল্লাহর নিকট জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর নেই”।
(৩) অন্য এক হাদিসে আছে রাসূলে মক্ববুল (সা.) বলেন, “আরাফার দিনের রোযা দুইশত বছর রোযা রাখার সমতুল্য আর আশুরার দিনের রোযা এক বছর রোযা রাখার সমতুল্য”।
(৪) হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত- আল্লাহপাক দিন সমূহের মধ্যে চারটি, মাসসমূহের মধ্যে চারটি, নারিদের মধ্যে চারজন, সর্বপ্রথমে যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের মধ্যে চারজন এবং স্বয়ং জান্নাত যেসকল নেক বান্দাদের প্রত্যাশি তাদের মধ্যে চারজনকে নির্বাচন করেছেন তাদেরকে সবার থেকে ভিন্ন মর্যাদার অধিকারি করেছেন।
মর্যাদাপ্রাপ্ত দিনগুলো: (১) জুমআরদিন (২) আরাফার দিন (৩) ঈদুল ফিতরের দিন ও (৪) ঈদুল আজহার দিন।
মর্যাদাপ্রাপ্ত মাসসমূহ: (১) মুহাররম (২) রজব (৩) জিলকদ ও (৪) জিলহজ মাস।
মর্যাদাবান চার রমণী: (১) হযরত মারয়াম বিনতে আমিরান (২) হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (৩) হযরত আসিয়া বিনতে মুযাহিম (যিনি ফেরাউনের স্ত্রী ছিলেন) (৪) হযরত ফাতেমা (রা.) তিনি জান্নাতবাসি সকল নারীকুলের সর্দার।
যারা সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ করবেন: (১) সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (আ.) (২) পারস্যবাসিদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসি (রা.) (৩) রুমীয়দের মধ্যে হযরত সুহায়েব রুমি (রা.) (৪) হাবশাবাসিদের মধ্যে হযরত বেলাল হাবশি (রা.)।
ঈদের আগে রোজা রাখার ফযিলত: হযরত রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, “যারা ৮ই জিলহজ রাখলো আল্লাহপাক তাকে হযরত আইয়ুব (আ.)-এর কঠিন রোগ পরিক্ষায় সবর করার সমতুল্য সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আরাফার দিনে রোযা রাখলো আল্লাহপাক তাকে হযরত ঈসা (আ.) এর সওয়াবের ন্যায় সওয়াব দান করবেন’’।
ঈদ ও ঈদের খুশি: ‘ঈদ’ শব্দটি ‘আল-আউদু’ ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত। যার অর্থ ফিরে আসা। আর যেহেতু বছরে দুবার আসে তাই তাকে ঈদ বলে। ঈদ মানে হাসি-খুশি, আনন্দ ইত্যাদি। তবে এ আনন্দ যেন না হয় শরিয়ত বিরোধি।
ঈদের আনন্দে যেন মিশ্রিত না হয় বিজাতিয় সংস্কৃতি। এ আনন্দে বেহায়াপনা বা অশ্লীল চিত্তবিনোদনের কোনো সুযোগ নেই। মহামানব মহানবী (সা.) যেভাবে ঈদ উদযাপন করেছেন আমাদেরকেও ঠিক সেভাবে করতে হবে। কেননা এতেই রয়েছে ইহ ও পরকালীন শান্তি।
ঈদের দিনের সুন্নতসমূহ: (১) গোসল করা (২) সুগন্ধি ব্যবহার করা (৩) ঈদের নামায না পড়া পর্যন্ত আহারকার্যকে পিছিয়ে রাখা। (৪) তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া। (৫) তাকবিরে তাশরিক আরাফার দিনে অর্থাৎ জিলহজের ৯ তারিখ ফযরের পর হতে শুরু হবে এবং শেষ হওয়া নিয়ে ইমাম আব হানিফা (রহ.) বলেন,‘নহরের’ দিন তথা ১২ তারিখ আসর পর্যন্ত। ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর মতে বলেন, ‘‘আইয়্যামে তাশরিকের শেষ দিন হচ্ছে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত”। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবির বলা। আর তাকবির হল এই-“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াাল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্”।
ঈদের নামাজের পূর্বে নামাজের বিধান: ঈদের নামাজের পূর্বে ঈদগাহে অথবা নিজ গৃহে ইজমায়ে উম্মতের মতে মাকরুহ।
ঈদের নামায কখন পড়বে: ঈদের নামাজের সময় হচ্ছে সূর্য ঊর্ধ্বে উঠার পর থেকে পশ্চিমাকাশে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ নামাজ ঈদুল ফিতরের নামাজের মত। নামাহ শেষে ইমাম সাহেব দুটি খুৎবা পাঠ করবেন যা কোরবানির মাসআলা-মাসাঈলে ভরপুর থাকবে।
মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতা’লা ইরশাদ করেন, “আমি প্রত্যেক দলকে এই উদ্দেশে কোরবানি করার নির্দেশ দেই যেন তারা ঐ নির্দিষ্ট পশুগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন (সুরা: হাজ্ব)।
শরিয়তের পরিভাষায়: আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের নিমিত্তে নির্দিষ্ট সময়ে পশু যবেহ করাকে কোরবানি বলে।
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব: প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক, মুক্বিম ও মালেকে নেসাব স্বীয় প্রয়োজন ব্যতিরেখে অর্থাৎ খাওয়া, পরা, বাসস্থান ও উপার্জনের উপকরণ ইত্যাদি ব্যতিত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা বায়ান্ন তোরা রোপা কিংবা সমপরিমাণ সম্পদের অধিকারির উপর কোরবানি ওয়াজিব।
কোরবানির দিন: কোরবানির ইবাদত কেবলমাত্র তিনদিনের মধ্যে সীমিত। দশ, এগারো এবং বারো জিলহজ এ তিনদিন কোরবানি করা যাবে। দশ জিলহজ ঈদের নামাযের পর হতে বারো জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত এই তিনদিনের যে কোনো দিন কোরবানি করা যাবে। (হেদায়া:৪/৪২৯)
কোরবানির পশু কেমন হবে: (১) ছাগল-ভেড়া, দুম্বা, গরু-মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু দ্বারা কোরবানি করা শুদ্ধ। তাছাড়া হরিণ খরগোশ ইত্যাদি অন্যান্য হালাল প্রাণী দিয়ে কোরবানি আদায় হবে না। (ফতওয়ায়ে আলমগিরি: ৫/২৯৫)
(২) কোরবানির জন্য মোটা তাজা ও সুন্দর পশু ক্রয় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে আকরাম (সা.) খুব সুন্দর হৃষ্ঠ-পুষ্ঠ পশু দিয়ে কোরবানি আদায় করতেন। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২০৯)
(৩) অন্ধ, বধির, অতিরিক্ত দুর্বল, কানের বেশিরভাগ অংশ কাটা, লেজ কাটা পশু দ্বারা কোরবানি জায়েয হবে না। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২৮২)
(৪) যেসব প্রাণী দিয়ে কোরবানি দেয়া বৈধ নয় সেসব প্রাণীকে কোরবানির নিয়তে যবেহ করা মাকরুহে তাহরিমি। (আলমগিরি)
(৫) যেসব পশুর শিং জন্মগতভাবে ভাংগা অথবা মধ্যভাগে ভাংগা তা দ্বারা কোরবানি সহিহ হবে। আর যদি শিং গোড়া থেকে একেবারে নির্মূল করা হয়ে যায় তবে তা দ্বারা কোরবানি জায়েয হবে না। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২৮০)
(৬) কোরবানির পশু যদি বকরি হয়, তবে তা পূর্ণ এক বছরের হবে। আর যদি গরু-মহিষ হয় তবে তা দুই বছর হতে হবে। উট পাঁচ বছরের কম হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
কিভাবে পশু যবেহ করব: কোরবানির পশুকে ক্বেবলামুখি শুয়াইয়া প্রথমে “ইন্নি ওয়ায যাহতু ওয়াযহিয়া লিল্লাযি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার”। বলে যবেহ করতে হবে।
ঈদের নামাযের আগে কোরবানি করা শুদ্ধ নয়। (কুদুরি:পৃ.১৯৮)
নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতে যবেহ করা উত্তম। নিজে না করলে সামনে থাকা ভাল। (আলমগিরি:৪/১০৬)
আল্লাহর নাম ব্যতিত অন্য নামে কোরবানি করলে তা হারাম হয়ে যাবে। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/৫১২)
কোরবানির গোশত কি করবে: কোরবানির তিনভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য, অন্যভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য আর অপরভাগ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করে দিবে। (শরহে বেদায়া:৪/৪৩৫)
চামড়া কি করবে: কোরবানির পশুর চামড়া দিয়ে জায়নামাজ, ব্যাগ বা যে কোনো ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করে নিজে ব্যবহার করা যেতে পারে। নতুবা এটা বিক্রি করলে তা গরিব-মিসকিনদের হক্ব হয়ে যায়। নিজের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি কাউকেই চামড়ার টাকা দান করতে পারবেন না। তবে কি করবেন? এ প্রশ্নের সহজ জবাব এটা গরিবদের মধ্যে নিকটাত্মীয় গরিবই চামড়ার টাকা পওয়ার বেশি হক্বদার। তবে দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দেয়া খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করাটাই সবচেয়ে ভালো।
পরিশেষে, আমি মহান প্রভূর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ঈদ ও কোরবানি আদায় করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন