ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা নিষিদ্ধ হলেও রাজধানীজুরে দাপট চলছে এসব অবৈধ যানের। এর ফলে রাজধানীর মূল সড়ক ছাড়াও অলি-গলিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। সারাদেশে প্রায় ১০ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা চলছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে ধরপাকর করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে আসে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে স্ট্যান্ড। স্থানীয় প্রশাসন, প্রভাবশালী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন একশ্রেণির অসাধু নেতাদের ম্যানেজ করে চলছে এসব যান। অস্বাভাবিক যানজট ছাড়াও দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎ চুরি ও বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজির অন্যতম উৎস এসব নিষিদ্ধ যান।
পরিবহন সংশ্লিষ্ট ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, ১ আগস্ট ২০১৫ সাল থেকে গুরুত্বপূণ সড়ক-মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা মূল সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও এলাকা ভিত্তিক সিন্ডিকেট গড়ে এসব অবৈধ নিষিদ্ধ যান চালু রাখা হয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশের নাকের ডগায় বসে চালানো হচ্ছে ইজিবাইক-অটোরিকশা। দেখেও না দেখার ভান করছেন তারা। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। এর সাথে বিদ্যুৎ চুরি ছাড়াও রাস্তায় অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি রয়েছে। মূল সড়কে এসব যানের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে একচোটিয়া দাপট। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। কোন ধরনের রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স ছাড়াই অদক্ষ ও অল্প বয়স্কদের হাতে চলছে। প্রায়শঃ দ্রুতগতির যানের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালাকরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকার অলি-গলিতে এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশার ছড়াছড়ি। নগরীর যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, বাসাবো, কদমতলা, মাদারটেক, হাজারীবাগ, মিরপুর-১, ১০, বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখান, বনশ্রী, আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, রামপুরা, খিলগাঁও, সিপাহীবাগ, বনশ্রী, বাড্ডা, মেরুল বাড্ডা, মেরাদিয়াসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ হাজার হাজার ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করে। নগরীর শ্যামপুর, কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার ইজিবাইক ও মোটরচালিক রিকশার পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা। কদমতলী থানা এলাকায় ইজিবাইকের বেশ কয়েকটি রুটের মধ্যে রায়েরবাগ ও মোহাম্মদবাগ রুটে চলাচল করে কমপক্ষে পাঁজ হাজার ইজিবাইক ও রিকশা। এখানে ইজিবাইক প্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা আর রিকশা প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া বড়ইতলা থেকে বিক্রমপুর প্লাজা, পোস্তগোলা থেকে পাগলা, ধোলাইরপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেইন রাস্তা থেকে মুরাদপুর হয়ে কোদারবাজার পর্যন্ত আছে একটি করে রুট। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দু’শো টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চার হাজারেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারির চার্জ দেয়ার জন্য মুরাদপুর এলাকাতেই আছে কয়েকটি গ্যারেজ। যেগুলোতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া আছে বিদ্যুত বিভাগের স্থানীয় প্রকৌশলীতে ম্যানেজ করে।
স্থানীয়রা জানান, পাটেরবাগ, দনিয়া, রায়েরবাগ, ডেমরা, কাজলা, ভাঙ্গাপ্রেসসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করা হয়। এসব যানবাহনের কারণে মানুষ চলাচলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। সকালে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সময় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় একই সাথে মানুষ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করছে। জানা গেছে, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মোটরচালিত রিকশার নিয়ন্ত্রণ করছে। গোপন চাঁদার মাধ্যমে চলে এসব যানবাহন। এ টোলের পরিমাণ স্থানভেদে ভিন্ন। প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে দুশো’ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা আছে এলাকাভেদে। নগরীর মিরপুর ১০ নং গোলচক্কর থেকে ইজিবাইক, প্রাইভেট সিএনজি ও চ্যাম্পিয়ন নামের কিছু বাস চলাচল করে। কোন ধরণের রুট পারমিট ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই চলছে এসব যান। সিন্ডিকেটের লোকেরা লাইনম্যান নিয়োগ করে ইজিবাইক থেকে টাকা আদায় করে। ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে আশকোনা এলাকায় কয়েকশ’ ইজিবাইক চলাচল করছে। বিমানবন্দর রেল ক্রসিং থেকে আশকোনা হয়ে বউড়া ও হলান পর্যন্ত চলাচল করে আড়াইশ ইজিবাইক। বিমানবন্দর রেল ক্রসিং থেকে দক্ষিণখান ও কাঁচকুড়া পর্যন্ত চলাচল করে প্রায় সাড়ে ৩শ’। এই এলাকায় ইজিবাইক চালানোর জন্য প্রতিদিন ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
চালকরা জানান, এই এলাকায় ইজিবাইক নামানোর সময় স্থানীয় নেতাদের ১৬শ’ টাকা করে দিতে হয়। রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে সিপাহীবাগ চলাচল করে শতাধিক ইজিবাইক। এ ছাড়া বেশ কিছু লেগুনা চলাচল করে। যেগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এবং সেগুলোর ফিটনেসও নেই। লেগুনাগুলো রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছ থেকে বনশ্রী হয়ে মাদারটেক প্রজেক্টের মুখ পর্যন্ত যায়। একজন ইজিবাইক চালক জানান, বাইক চলাচলের জন্য তারা প্রতিদিন ৫০ টাকা করে দেন। এ ছাড়া তারা মাসে ২০০ টাকা করে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয়। সবুজবাগ থানার খিলগাঁও বিশ্বরোড থেকে বাসাবো হয়ে মাদারটেক, নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ ইজিবাইক চলাচল করে। প্রত্যেকটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রিকশা ও ইজিবাইকগুলো যে শুধু বিদ্যুতের অপচয় করছে তা নয়, এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে দেশের ১০ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। আর চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তা রিচার্জ করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আজিমপুর এলাকার চালকরা জানান, গাড়ি প্রতি ৫০০ টাকা জমা ছাড়াও চার্জের জন্য বিদ্যুত বিল দেড়শ থেকে দু’শো টাকা এবং প্রভাবশালীদের আরও ৬০০ টাকা দিতে হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, থ্রি-হুইলারসহ এসব নিষিদ্ধ যানবাহনের কোনটারই রাজধানীর সড়কে অনুমোদন নাই। তবুও স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি পুলিশকে চাঁদা দিয়ে এসব যান চলছে।
এসব প্রসঙ্গে বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা যে হারে বাড়ছে তা সত্যিই ভয়ের বিষয়। অনেকে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করে স্থানীয়ভাবে এগুলো তৈরি করছে। আবার কোনো কোনো যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী নিষিদ্ধ করা গেলেই এর উৎস বন্ধ করা যাবে। তা না হলে এগুলোকে আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হানিফ খোকন বলেন, সিংহভাগই ইজিবাইকের ব্যাটারি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে চার্জ করা হয়। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। আর জনগণ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়া এগুলোর কারনে রাস্তায় যানজট, পরিবেশ দূষণ ও লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটছে।
রাজধানীর কয়েকটি থানার ওসিরা বলেন, বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ধরপাকরের পর কয়েকদিনের জন্য বন্ধ থাকলেও আবারও চলতে শুরু করে। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, একদিনে এসব যান বন্ধ করা সম্ভব নয়। নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে তুলে দিতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীতে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ। তবে অলিগলিতে এখন চলার বিষয়টি জানা নেই। এ বিষয় স্থানীয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন