ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এ অভিযানের সূচনা হয়। প্রথম দিনের ঢিলেঢালা এ অভিযানে মাত্র ৭টি মামলা হয়। এরপর জনবল সঙ্কট দেখিয়ে বন্ধ করা হয় অভিযান। যে কারণে অভিযানের কোনো প্রভাব পড়েনি পুরো দক্ষিণ সিটি এলাকায়। বরং দিন দিন নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ক্যাবল অপসারণ করতে গিয়ে তারা ব্যস্ত। জনবল সঙ্কটের কারণে অবৈধ যান অপসারণ অভিযান থমকে আছে।
সরেজমিন ঘুরে ঢাকা দক্ষিণের সুত্রাপুর, কোতয়ালী, লালবাগ, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মতিঝিলসহ পুরো দক্ষিণ সিটি এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, দিন যতো যাচ্ছে ততোই বাড়ছে এসব নিষিদ্ধ যান। আগে পাড়া মহল্লায় চললেও এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। অবাধে চলছে পুরো রাজধানীজুড়ে। মতিঝিল এলাকাতেও গতকাল অবাধে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে একজন চালক বলেন, আগে ট্রাফিক পুলিশ ব্যাটারির রিকশা দেখলে বাধা দিতো। এখন আর দেয় না। করোনায় লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সব নিয়ম উঠে গেছে বলে ওই রিকশাচালকের ধারণা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শ্যামপুর এলাকায় দেখা গেছে, আগের মতোই শত শত ইজিবাইক ও হাজারো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। রিকশার দাপটে রাস্তায় পায়ে হাঁটার মতো অবস্থা নেই। যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া থেকে কদমতলীর ধোলাইপাড় পর্যন্ত শত শত ইজিবাইক ও কয়েক হাজার রিকশা চলাচল করে। সেই সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। অভিযানে ধরা পড়ার ভয়ে অনেক রিকশা ও ইজিবাইক কদমতলী এলাকায় এসেছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগিরা। তবে ইজিবাইক ও রিকশার চালকদের সাথে কথা বলে সে সম্পর্কে কোনো ধারনা মেলেনি। জসীম নামে একজন ইজিবাইক চালক বলেন, কিসের আবার অভিযান? আমরা তো টাকা দিয়েই ইজিবাইক চালায়। যারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলে তারা অভিযান ঠেকাতে না পারলে টাকা দিবো কেন? রিকশাচালক মতিয়ার জানান, তিনি কোনো অভিযানের কথা শোনেন নি। মালিক তাকে কিছুই জানায় নি। শনিরআখড়া বাজার স্ট্যান্ডে রবিউল নামে একজন ইজিবাইক চালক বলেন, শুনেছি অভিযান শুরু হবে। তবে আমাদের এই দিকে হবে বলে মনে হয় না। নেতারা উপরে যোগাযোগ করেছেন। এজন্য অতিরিক্ত টাকাও নিয়েছেন তারা। এরপর অভিযান হয় কি করে?
এদিকে, সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগিরাও আশা করেছিলেন দক্ষিণের মেয়রের ঘোষণার পর নিশ্চয় রাস্তা থেকে এসব অবৈধ যান উঠে যাবে। এক মাসে তা না হওয়ায় তারা হতাশ। মীরহাজিরবাগের বাসিন্দা মোত্তালেব বলেন, সবকিছু আগের মতোই চলছে। বরং এই এলাকায় অবৈধ যানের সংখ্যা বেড়েছে। আশা করেছিলাম এগুলো বন্ধ হবে। কিন্তু কোনো উন্নতি তো দেখছি না। শ্যামপুরের পোস্তাগোলায় হাজার হাজার এসব অবৈধ যান চলাচল করছে পুলিশের চোখের সামনেই। দেখা গেছে, পুলিশই এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরান ঢাকার নয়াবাজার থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত চলছে শত শত ইজিবাইক। এ প্রসঙ্গে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, এসব যান চলে ক্ষমতাসীনদের ম্যানেজ করে। যারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলে তারা প্রভাবশালী এবং রজনৈতিক মদদপুষ্ট। এ কারণে আমরা ইচ্ছা করলেই এগুলো বন্ধ করতে পারি না। একটু এদিক-ওদিক হলেই এরা রাস্তা আটকে দিবে। তখন পুলিশ পড়বে বিপদে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এসব অবৈধ যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মেয়র ওই দিন বলেন, এ ধরনের রিকশা বা যানবাহন ডিএসসিসি’র সড়কে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে মালিকদেরকে এসব অবৈধ যান অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। এক মাস ধরে সেই ঘোষণাতেই আটকে আছে ডিএসসিসির কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কমপক্ষে ১৭ লাখ। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান। বাকি ৭ লাখ ইজিবাইক। আর ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রিকশা বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। এসব অবৈধ যান থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই চাঁদা তুলে থাকে। চাঁদার একটা বড় অংশ পায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।
নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশায় সয়লাব ঢাকা। মহাসড়কসহ সারাদেশসহ ঢাকার অলিতে-গলিতে এখন শত শত ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসবের কারণে যানজট, দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনা মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। রাজধানীতে ইজিবাইকের দৌরাত্ম দেখলে আর মনেই হয় না এগুলো নিষিদ্ধ কোনো যান। এর সাথে যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ১০ লাখ রিকশার শহর ঢাকায় এখন মোটরচালিত রিকশার সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে অথচ এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ডিএমপি সদর দফতরের ট্রাফিক বিভাগ থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা যাতে না চলে সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। সেই নির্দেশনাও বহুদিন ধরে মানে না পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন