অভিযান জোরদারে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছে ডিএসসিসি
সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কমপক্ষে ১৭ লাখ। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান। বাকি ৭ লাখ ইজিবাইক। আর ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রিকশা বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। এসব অবৈধ যান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই চাঁদা তুলে থাকে। চাঁদার একটা বড় অংশ পায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।
অটোরিকশার চালক ও মালিকরা বলেছেন, বিধি অনুযায়ী অবৈধ হলেও রাস্তায় চলতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ একদিকে যেমন এলাকার নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে চলেন, তেমনি সড়কে তাদের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সেই পুলিশ তাদের কাছে ‘ম্যানেজড’। অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হলে এই দুই পক্ষ, নেতা ও পুলিশ-উভয়ে বড় অঙ্কের মাসোহারা হারাবে। সে বিবেচনায় অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা সহজ নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজুলে নূর তাপস ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন। চলতি মাসের ৫ তারিখ থেকে সীমিত পরিসরে অভিযানও শুরু হয়েছে। তবে ঢিলেঢালা অভিযানের আঁচ লাগেনি এখনও অনেক এলাকায়। আগের মতোই অবাধে চলছে নিষিদ্ধ এসব যান। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ ক্যাবল অপসারণ অভিযানের কারণে নিষিদ্ধ যান আটক অভিযানে ভাটা পড়েছে। জনগুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ক্যাবল অপসারণ অভিযান চালাচ্ছে ডিএসসিসি। নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও রিকশা আটক অভিযান জোরদারের জন্য ইতোমধ্যে আরও ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছে ডিএসসিসি। একজন কর্মকর্তা বলেন, আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি জোড়ালো অভিযান শুরু হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় চলাচলরত ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয় নিয়মিত। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে বছরে আড়াই থেকে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন অটোরিকশার চালক-মালিকরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব টাকার ভাগ স্থানীয় নামধারী কিছু নেতা, মাস্তান, সন্ত্রাসী, থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে ‘ভাগ-বাটোয়ারা’ হয়। এ কারণেই এই বিপুল অঙ্কের অর্থের উৎস সহজে বন্ধ করতে রাজি নন কেউ। অনেকেরই ধারনা, এসব কারণেই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাজধানীর রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীরা যদি অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়, তবে প্রতিবাদকারীদের নিরব দর্শক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীরাই তখন অপরাধী বনে যান। অটোরিকশার ক্ষেত্রে ঘটছে সেটিই। সরেজমিনে রাজধানীর মুগদা, মান্ডা, হাজারীবাগ, জিগাতলা, কামরাঙ্গীরচর, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, ডেমরা, বাসাবো ও মাদারটেকসহ রাজধানীর ছোট বড় প্রায় ৫০টি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকাতেই ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বিভিন্ন এলাকার রিকশাচালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
চালক-মালিকরা জানান, অটোরিকশা চালানোর জন্য প্রতিটি এলাকাতেই সুনির্দিষ্ট ‘ব্যবস্থা’ আছে। থানা পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের যৌথ উদ্যোগে ‘লাইনম্যান’দের মাধ্যমে প্রতিটি ইজিবাইক ও রিকশার জন্য একটি করে কার্ড ইস্যু করা হয়। এই কার্ডে উল্লেখ থাকে, কোন ইজিবাইক বা রিকশা কোন এলাকা পর্যন্ত চলতে পারবে। আর এই কার্ডের জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে এক হাজার টাকা করে দিতে হয় লাইনম্যানকে। তবে যেসব এলাকা ভিআইপি হিসেবে পরিচিত (ধানমন্ডি, মতিঝিল, মিরপুরের মতো ), সেসব এলাকায় এই ‘লাইন খরচ’ তথা মাসিক চাঁদার পরিমাণ ২ হাজার টাকা। এই টাকা না দিলে নির্ধারিত এলাকার মধ্যে ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো সম্ভব হয় না। অন্যদিকে কোনো রিকশার কার্ডে উল্লেখ করা এলাকার বাইরে গেলে সেটি ধরা পড়লে আবার ট্রাফিক পুলিশকে ‘খুশি করে’ গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হয়। তাতে একেকবার খরচ সর্বনি¤œ ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত।
রামপুরা এলাকায় ইজিবাইক চালান এমন একজন বলেন, প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে দিচ্ছি। প্রায় আড়াই বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। কিন্তু কয়েক মাস আগে এক যাত্রী নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। সেখানে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে এক ট্রাফিক পুলিশ ইজিবাইক আটকায়। এরপর কার্ড দেখাই। উনি বলেন, এইটা শুধু বিশ্বরোডের মাথা পর্যন্ত চালানোর জন্য। পরে দেড় হাজার টাকা দিয়ে ইজিবাইক ছাড়াতে হয়। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার এক রিকশাওয়ালাও জানান, মাসে ‘লাইন ভাড়া’ গুনতে হয় এক হাজার টাকা। শনিরআখড়া থেকে দোলাইপাড় রুটে রিকশা চালানোর অনুমতি আছে তাদের। এলাকার বাইরে গেলে খরচ বেড়ে যায়।
ব্যাটারিচালিক রিকশাচালকরা জানান, প্রতিটি এলাকার জন্য কার্ডের রঙ হয় আলাদা। আবার একেক এলাকার কার্ডে চিহ্নও থাকে আলাদা আলাদা। কোনো এলাকার কার্ডে থাকে কাঁঠাল, তো কোনো এলাকার কার্ডে ইলিশ মাছের ছবি। একইভাবে নানা ধরনের ফুল ও ফল ব্যবহার করা হয়ে থাকে বিভিন্ন এলাকার চিহ্ন হিসেবে।
রিকশা নিয়ে কাজ করে-এমন সংগঠনগুলোর তথ্য, নিষিদ্ধ এসব রিকশাকে প্রতি মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। সেক্ষেত্রে ন্যূনতম দুই লাখ রিকশার প্রতিটির জন্য মাসে একহাজার টাকা চাঁদা ধরলেও সেখান থেকে আসে ২০ কোটি টাকা। তিন লাখ রিকশা ধরলেই সেই অঙ্ক ৩০ কোটি! সে হিসাবে বছরে আড়াই থেকে সাড়ে তিনশ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে এসব অবৈধ যানকে ঘিরে। রিকশাচালকদের মতো একটি প্রান্তিক পেশাজীবীর পকেট থেকেই এই বিপুল অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না একটি টাকাও।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী বলেন, গত প্রায় এক দশকে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য বেড়েছে। কিন্তু এসব রিকশার ব্যাটারি তিন থেকে ছয় মাস পর অকেজো হয়ে যায়। সেই অকেজো ব্যাটারি নিঃশেষ করার কোনো উপায় দেশে নেয়। যে কারণে এটি পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতি। আবার এ রিকশার ব্যাটারি চার্জ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ খরচ হয়। তাই আমরা চাই না, এসব অটোরিকশা চলুক। আমরা দুই সিটি করপোরেশনকে একাধিকবার লিখিতভাবে বলেওছি এসব রিকশা উচ্ছেদ করার জন্য।
ইজিবাই ও ব্যাটারিচালি রিকশার ‘লাইন ভাড়া’ থানায় থানায় জমা হওয়ার বিষয়ে জানতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটা নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। অবৈধ এসব যান উচ্ছেদে অভিযানও শুরু করেছে পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন