শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যের সাক্ষী দেশের বৃহত্তর ‘নবরত্ন মন্দির’

মুসলিম শাসকের অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হয়

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১:০০ পিএম

মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে আগ্রার তাজমহল কিংবা চীনের মহাপ্রাচীর সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হাজারও ছোট-বড় স্থাপত্যকর্ম মানুষকে আকৃষ্ট করে। ভারতীয় উপ-মহাদেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত শত স্থাপত্য শিল্পকর্ম যা আজও পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমীদের কাছে টানে। এসব শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে রাজ-রাজাদের বিশাল আকৃতির প্রাসাদ, মসজিদ কিংবা মন্দির।

তেমনই মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন সিরাজগঞ্জ জেলার সলংগা থানার অন্তর্গত হাটিকুমরুল ‘নবরতœ মন্দির’। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এ মন্দিরটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরটি স্থাপনে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির এক অনন্য নজির পরিলক্ষিত হয়। একজন মুসলিম শাসকের অর্থায়নে তারই হিন্দু তহশিলদার দ্বারা এটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে এটি ‘দেলমঞ্চ’ নামে পরিচিত।

সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরে উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির সর্বাঙ্গ পোড়ামাটির কাব্য গাঁথা। নবরতœ মন্দিরকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি শিব মন্দিরসহ আরও তিনটি ছোট মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালই পোড়ামাটি কারুকার্য খচিত। বাংলাদেশে প্রাচীন মন্দিরগুলোর অন্যতম এটি।
প্রত্নতত্ত‌্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মন্দিরটি নির্মাণকালীন কোনো শিলালিপি না থাকলেও কিছু পাঠজাত বিবরণ থেকে জানা গেছে, ১৭০৪-১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদ কুলি খানের শাসনামলে তার তহশিলদার রামনাথ ভাদুরী স্থাপন করেন এই নবরত্ন মন্দিরটি। উঁচু একটি বেদীর উপর তিনতলা বিশিষ্ট এ মন্দিরটি ইট, চুন সুরকি মসল্লা দিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এ মন্দিরটি। প্রায় ১৫ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৫.৪ মিটার এবং প্রস্থ ১৩.২৫ মিটার। নিচতলায় চারদিকে চারটি বারান্দা বিশিষ্ট একটি গর্ভগৃহ রয়েছে। শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন হাটিকুমরুল ‘নবরত্ন মন্দির’। প্রতিটি বারান্দার বাইরের দিক থেকে সাতটি ও ভেতরের দিকে রয়েছে পাঁচটি খিলাল প্রবেশ পথ। ছাদপ্রান্তে আংশিক বাঁকানো রয়েছে। মূল অবস্থায় মন্দিরের দেয়ালের ইট ও টেরাকোটার উপরে দেব-দেবী, লতাপাতা ও ফুলের চিত্রখচিত পোড়ামাটির অপূর্ব কারুকাজ। যা ইতিহাসবিদ ও দর্শণার্থীদের আকৃষ্ট করেছে। তবে বার বার সংস্কারের কারণে অধিকাংশ কারুকার্য ধ্বংস হয়ে গেছে। নির্মাণকালীন সময়ে স্থাপনাটির উপরে পোড়ামাটির ফলক সমৃদ্ধ নয়টি রত্ন বা চূড়া নির্মাণ করা হয়েছিল। যার সবগুলোই এখন ধ্বংস হয়ে গেছে।

এ মন্দিরটি ঘিরে আরও তিনটি মন্দির রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে শিব-পার্বতী মন্দির, দক্ষিণপাশে পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে টেরাকোটায় কারুকার্য খচিত আরও একটি শিব মন্দির। পশ্চিমে রয়েছে জোড় বাংলা মন্দির। এসব মন্দিরগুলোও একই ধরনের পোড়ামাটির কারুকাজে সুসজ্জিত ছিল। নবরত্ন মন্দিরের পাশেই কৃষক কাসেম আলী শেখের বাড়ি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই নবরত্ন মন্দিরটি দেখে আসছি। এর গায়ে অনেক ছোট ছোট মূর্তি ছিল, সেগুলো খসে পড়ে গেছে। শিব মন্দিরটির উপরে একটি পোড়া মাটির কলসির মতো চূড়া ছিল। সেটাও ভেঙে পড়ে গেছে। একই এলাকার প্রবীর কুমার দাস ও দিলীপ কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় এ মন্দিরটি অবহেলিত ছিল। এখানকার হিন্দুরাও পূজা-অর্চনা করতো না। প্রায় ৮ বছর ধরে এখানে দুর্গা পূজা করা হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম সবাই এখন আনন্দঘন পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করে। শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন হাটিকুমরুল ‘নবরত্ন মন্দির’। নবরত্ন মন্দিরের কেয়ার টেকার মহাব্বত আলী শেখ বলেন, এ মন্দির দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে এখনো পরিদর্শন করতে আসেন। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রভাষক বলেন, ধারণা করা হয় এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মন্দির। মন্দিরের দেয়াল এবং প্রবেশদ্বার কারুকার্য খচিত মধ্যযুগীয় শিল্পকর্মে পরিপূর্ণ। মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীন শিল্পকর্মের মধ্যে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম অন্যতম। যেটা এই মন্দিরে ছিল এবং এখনো কিছু কিছু রয়েছে। সে সময় পাথর এবং ধাতব অপ্রতুলতার কারণেই হয়তো ভারতীয় শিল্পীরাও মৃৎশিল্পের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল।

তিনি বলেন, এ মন্দিরটি নির্মাণকে ঘিরে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির এক অনন্য নজির দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা, বিহার উড়িষ্যার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁনের শাসানামলে তারই অর্থায়নে এটি নির্মাণ করেন তহশিলদার রামনাথ ভাদুরী। শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান বলেন, অপূর্ব কারুকার্য খচিত নবরত্ন মন্দিরটি সব ধরনের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এটিই সব থেকে প্রাচীন ও চমৎকার একটি মন্দির। ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষণ করেছে। এ স্থাপনাটির সৌন্দর্য্যবর্ধন ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। খুব শিগগিরই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে এ মন্দিরটি পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন