ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ইতালি ছিল প্রতিভা আর প্রতিবাদের। ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইতালিতে মূলত মধ্য ফ্লোরেন্সের তাসকানী থেকেই এই পুনর্জাগরণের সূচনা। ফ্লোরেন্স লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-র শহর; ফ্লোরেন্স মিকেলাঞ্জেলোর শহর; ফ্লোরেন্স গ্যালিলিও গ্যালিলাই-এর শহর। এখানে আছে বত্তিচেল্লির ভেনাস, আছে দ্য ভিঞ্চির অনানসিয়েশন, আছে ‘আকাদেমিয়া দি আর্টিদেল দিসেগনো’ ইউরোপের সর্বপ্রধান শিল্পকেন্দ্র। এ ফ্লোরেন্সেরই জন্মেছিলেন আরেক প্রতিভাবান শিল্পী আর্টিমিসিয়া জেন্টিলেসি।
আর্টিমিসিয়া নাম তেমন পরিচিত নয়। বত্তিচেল্লি, ম্যাকিয়াভিলি, লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিনতোরেত্তো, পারমাঞ্জালো, কারাভাজ্জিও প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে একত্রে এ নাম উচ্চারিত হয়নি দিনের পর দিন তার কারণ প্রতিভার ফারাক নয় বরং লিঙ্গ রাজনীতি। আর্টিমিসিয়া নারী। সমকাল তাকে গ্রহণ করতে চায়নি, কিন্তু স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। ফ্লোরেন্স আকাদেমির প্রথম মহিলা সদস্যা তিনি। ফ্লোরেন্সের উফিজি সংগ্রহশালায় কেবলমাত্র নারী অঙ্কিত একটি চিত্রই স্থান পেয়েছিল তা আর্টিমিসিয়ারই।
আর্টিমিসিয়ার সময়ে ইতালিয় চিত্রশিল্পে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়, আর্ট হিস্ট্রির ভাষায় তা বারোক স্টাইল। গতিময় এ চিত্রে বিলাসময় জাঁকজমক উত্তেজনা তথা নাটকীয়তা তৈরি করা হত। মূলত আলো আঁধারির খেলায় এই নতুন ধারার সৃজন; যা চিত্রাবলীকে করত এতটাই বাস্তবসম্মত যে মনে হত বোধহয় চরিত্রগুলি ক্যানভাস ছেড়ে এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে। তিনি শিখেছিলেন পারস্পেক্টিভের অঙ্ক, ত্রিমাত্রিক বিষয়বস্তুকে দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসে তুলে আনার পদ্ধতি। বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে সঠিক কৌণিকে, দর্শক থেকে দূরত্ব অনুযায়ী সঠিক অনুপাতে ধারণ করতে চিত্রানুপাতের ভূমিকা সহজেই উপলব্ধ।
নারীর এই শিল্পদক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন পুরুষ সমাজ মানতে পারেনি। নারীর প্রতিভাকে দমন করতে তার বিরুদ্ধে উদাসীন থেকেছে। কিন্তু কতদিন! সাংসারিক তথা সন্তানের বন্ধন স্বীকার করেও আর্টিমিসিয়া একের পর এক ‘কমিশনড’ কাজ করেছেন। নারী অঙ্কিত প্রথম ন্যূড স্টাডি তারই। আর্টিমিসিয়ার সমকালে নারীরা যে একেবারেই ছবি আঁকতেন না তা তো নয়। তারা মূলত করতেন অলংকরণ তথা ইলুমিনেশনের কাজ। ফুল-লতা-পাতা দিয়ে বাইবেল সজ্জিতকরণ কিংবা পোর্ট্রেট আঁকাতেই তাদের দক্ষতা সীমিত ছিল। ছিলেন ক্যাথরিন অফ বোলোগনা, গিয়োভান্না জারজোনি। প্রথমজন চার্চের নান, দ্বিতীয়া টেম্পেরা এবং ওয়াটার কালারে স্টিল লাইফ অঙ্কণে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
আর্টিমিসিয়ার সবকটি ছবি নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। আত্মপ্রতিকৃতি কিংবা মেরী ম্যাগদালেনের মতো শান্ত ছবিতেও তিনি আলো-অন্ধকারের মাধ্যমে গতিময়তা আনতে ত্রুটি করেননি। প্রতিটি ছবিতেই কিছু ঘটছে। এই ঘটমানতা তথা চলমানতাই যে জীবন তা বোধহয় চল্লিশোত্তীর্ণা রমণী বুঝেছিলেন মর্মে মর্মে। রুবেন্স, রেমব্রান্ট, কিংবা ভেরমিয়ারের আগেই আর্টিমিসিয়া কারাভাজ্জিওর আলো-আঁধারি তথা ছায়াময়তা, ম্যানারিজম এবং ন্যাচারালিজম-এর একলব্য শিষ্য হয়েছিলেন। অথচ অসম্মান এবং বিস্মৃতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিল মহান এই শিল্পীর শেষ জীবন। এমনকি তার মৃত্যুর সঠিক সময়ও জানা যায় না। ঐতিহাসিক চার্লস মোফাত বলেছেন, ১৬৫৬, মতান্তরে ১৬৫৩ সালে নেপলসে আর্টিমিসিয়া আত্মহননের মাধ্যমে বিড়ম্বিত জীবনের ইতি টেনেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন