দুর্নীতিবিরোধী অভিযানটি শুরু হয়েছিল কার্যত: দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’কে পাশ কাটিয়েই। এলিট ফোর্স র্যাব-পুলিশই হানা দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলো ক্যাসিনোর ঘূর্ণয়মান চড়কা। ক্লাব-ঘরে অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। ভল্ট থেকে উদ্ধার করেছে কোটি কোটি টাকার বান্ডিল। আর এ সময় অবৈধ অর্থের উৎসের সন্ধান এবং ‘অনিয়ম’ খুঁজতে ব্যস্ত দুদক।
অভিযান চালায় সিটি করপোরেশনের ফুটপাথের উপর স্থাপিত টং দোকান উচ্ছেদে। রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে ব্যস্ত অবৈধ কার পার্কিং আর নকশাবহির্ভূত ভবন খুঁজতে। কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পায় তখনই যখন দুদক নামক প্রতিষ্ঠানটির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যখন প্রশ্ন ওঠে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠনকারীর হাতে হাতকড়া পরাতে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। আর এমনি পড়িমরি করে জেগে ওঠে সংস্থাটি। মরিয়া হয়ে ওঠে ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং ব্যর্থতা ঢাকতে।
র্যাব-পুলিশের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাইকারী হারে ঠুকতে থাকে মামলা। অথচ মামলা রুজুর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬(১) ধারায় যাচাই-বাছাই পর্ব রয়েছে। রয়েছে একটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের বিষয়ও। সেটিকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখায় দুদক।
গণমাধ্যম আগের দিন সংবাদ প্রকাশ করলে পরদিনই সেটির ভিত্তিতে দুদক মামলা করছে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন’র অভিযোগে। বিচারে টিকবে না- কি না, তদন্তে প্রমাণ করা সম্ভব কি না, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি নাÑ এ প্রশ্ন যেন এখন অবান্তর। চলছে দুদক আইনের ২৭(১) ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগের মহোৎসব। অথচ দুর্নীতির বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাওয়ার মতো দুদকের নিজস্ব কোনো উৎস নেই। একটি গোয়েন্দা ইউনিট থাকলেও সেটিকে কাজে লাগানো হয় না। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত তথ্যই দুদকের ভরসা।
অন্যের ওপর নির্ভরশীল এ হেন প্রতিষ্ঠান এখন তথ্য-ভিক্ষা চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার স্বাক্ষরবিহীন প্রতিবেদন হয়ে উঠছে দুদকের অবলম্বন। অথচ প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাটের দুর্নীতি রয়েছে। এলসি’র বিপরীতে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, পদস্থ আমলা বিশেষত: প্রশাসন ক্যাডারের দুর্নীতিরও কোনো ইয়ত্তা নেই। এখানে দুদক যেন অন্ধ।
এছাড়া সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, ওয়াসা, তিতাস, বিটিআরসি, বিআরটিসি, বিটিসিএল, গণপূর্ত, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, রাজউক, হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন, রেলপথ, সেতু বিভাগ, বিমান বন্দর, ডাক অধিদফতর, এলজিইডি, বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ, আইনমন্ত্রণালয়ের প্রকল্প, কাস্টমসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি চিত্র গণমাধ্যমের পৃষ্ঠাজুড়ে। দুদক এসব খুঁজে পায় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি এবং প্রকল্প পরিচালকদের অবাধ লুণ্ঠনকেও ‘দুর্নীতি’ বলে মনে করে না দুর্নীতিবিরোধী এ প্রতিষ্ঠানটি। কেবল সারাবছর মিডিয়াজুড়ে আলোচনায় থাকতে সচেষ্ট দুদক চেয়ারম্যান। মানববন্ধন, ‘সততা স্টোর’ চালু, সেমিনার, বিদেশ সফর, কর্মশালার বক্তৃতা-বয়ানেই বেশি আগ্রহ তার। ‘১০৬’ নামক হাস্যকর এক আবিষ্কার নিয়েও তার রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার।
‘এনফোর্সমেন্ট টিম’ দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভীতি প্রদর্শন তার সস্তা বাহবা নেয়ার কৌশল হিসেবে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাঘব-বোয়ালদের কেশাগ্র স্পর্শ না করে চুনোপুটিদের ধর-পাকড়ের মাধ্যমে স্বীয় অস্তিত্বের জানান দেয়া এবং তৎপরতার প্রমাণ আর ‘ফাঁদ মামলা’ নামে দুর্নীতিবাজ পাকড়াওয়ের নাটক মঞ্চায়ন যেন খেয়ালি রাখাল বালককেও হার মানায়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকেরই সরাসরি ব্যবস্থা নেয়ার কথা। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দমন দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। সেটি না করে দুর্নীতির খাত চিহ্নিতকরণের নামে উল্টো দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠানের কাছেই দুর্নীতিবন্ধের সুপারিশ পেশ করছে দুদক। যা গত সাড়ে ৩ বছরে দুদককে একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।
সরকারি অফিসের পিয়ন, উমেদার, সার্ভেয়ার, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র নার্স, স্টোর কীপারকে ৫-১০ হাজার টাকাসহ হাতেনাতে পাকড়াওয়ের কৌশল বেছে নেন দুদকের বর্তমান নেতৃত্ব। প্রশিক্ষণ আর সেমিনারে অংশ নেয়ার নাম করে ঘন ঘন বিদেশ সফর এবং সভা-সেমিনার করে ভালোই সময় পার করছিলেন এই কমিশন। কিন্তু যখনই প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তির দক্ষতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলো, ব্যর্থতার দায় নিয়ে যখনই দুদক ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠলো তখনই তিনি ‘দক্ষতা’ প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে উঠলেন। গণহারে ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করছেন।
গণমাধ্যমে প্রেসনোট পাঠিয়ে ফলাও করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কার কার ব্যাংক একাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘটক পাখি ভাইয়ের দুর্নীতি খোঁজা, নিকাহ রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে মামলা, সেগুনবাগিচার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পাকড়াও, প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মাদরাসা শিক্ষকের দুর্নীতি খোঁজা, নকশাবহির্ভূত কারপার্কিংয়ে দুর্নীতি খোঁজা হচ্ছে।
দুদক যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘আপসহীন’ এসব দিয়ে হয়তো সেটিই প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মিলছে প্রচার-সুবিধা। কিন্তু সার্বিক বিচারে এসব কর্মকান্ড দুদকের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নিয়ে যাবে। সংবিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটিকে হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে- এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে তালিকা প্রকাশ বিরূপ প্রভাব ফেলছে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে।
বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে। কমিশনের আইন ও সংশ্লিষ্ট ধারা রয়েছে। রয়েছে প্রতিটি দপ্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। তা সত্ত্বেও দুদক কখনো নিষ্ক্রিয়। কখনো অতিমাত্রায় সক্রিয়। কখনো ‘ধীরে চলো’ নীতি। কখনো বা বিশেষ রকম তৎপর। এর যেকোনো অবস্থানই রহস্যময়, সন্দেহজনক, দুরভিসন্ধিমূলক, অস্বাভাবিক এবং বিপজ্জক।
দুদকের সাবেক আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তাই দুদকের পক্ষে কোনো খেয়ালি রাখাল বালক হওয়ার সুযোগ নেই। কাউকে ধরা কাউকে ছাড় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই আইনে। বাস্তবতা হলো, বর্তমান কমিশন সেটি করছে। এর পরিণামে প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
দুদকের আরেক সাবেক আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, দুর্নীতি দমনই দুদকের কাজ। এটি তাদের নিয়মিত কার্যক্রম। সারাবছর ঘুমিয়ে থাকা, ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে রীতিমতো তালিকা ধরে ধরে পাকড়াও- এটি কখনো কোনো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের পেশাদার আচরণ হতে পারে না। এই যে ধরুন, গতকালই শুনলাম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জব্দকৃত একাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়েছে। কার কার তথ্য চাওয়া হয়েছেÑ এমন কিছু নামও প্রকাশ হয়েছে দেখলাম। এই নামগুলো নিশ্চয়ই দুদক মিডিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এর ফলে যাদের নাম প্রকাশ হলো তাদের বিরুদ্ধে একটি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেলো। তিনি হয়তো দুর্নীতিবাজ কিংবা দুর্নীতিবাজ নন। আদালতই সেটি বলতে পারবেন। অথচ বিচারের আগেই তার ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে তকমা লাগিয়ে দেয়া হলো নাম প্রকাশের মাধ্যমে। একদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার হানি হলো। দ্বিতীয়ত: ব্যাংক যদি তার তথ্য প্রদান করে তাহলে ব্যাংকের ওপরও তার আস্থা হারালো। ফলে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা আর ব্যাংকে টাকা রাখবেন না। তাকে দুর্নীতিবাজ বলা হলে তিনি অ্যাকাউন্ট করবেন না। স্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনও করবেন না। চূড়ান্ত পর্যায়ে যা দেশের উন্নয়নকেই ধাক্কা দেবে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের কাছে কখনো আবেগী আচরণ প্রত্যাশিত নয়। দেশে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তারাও কাজ করেন। কিন্তু তাদের তৎরপতার কথা কিন্তু মিডিয়ায় আসে না। পক্ষান্তরে দুদক একটি বিশেষায়িত স্বাধীন তদন্ত সংস্থা। এ সংস্থা কারো বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করলেই মিডিয়ায় ফলাও প্রচার হয়। এ ক্ষেত্রেও দুদককে আরো সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ।
‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার ব্যর্থতা থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশন নামক স্বশাসিত স্বাধীন কমিশনটির প্রতিষ্ঠা। দুদক আইনের ঘোষণাতেই রয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করছে না।
এদিকে দুদকের সাম্প্রতিক কর্মকা- সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সংস্থাটির সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, দুদক তার তফসিলভুক্ত বিষয় নিয়েই কাজ করছে। কারো আদেশ-নির্দেশ-অনুরোধের বশবর্তী হওয়ার সুযোগ নেই। কাজ করলে সমালোচনা হতেই পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন