সকল মানুষেরই স্বপ্ন থাকে। সুন্দর ও সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আমরা শুধু নিজেদের ভবিষ্যতের কথাই চিন্তা করি না, অধীনস্ত ও সংশ্লিষ্টদের কথাও ভাবি। বাবা তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করেন। কিন্তু ভবিষ্যত সম্পর্কে সবার ধারণা এক নয়। অনেক মানুষ ভবিষ্যত বলতে শুধু দুনিয়ার জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকুই বোঝে। আর তা সুখী ও সমৃদ্ধ করার জন্য স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে সুদূর বিদেশের মাটিতে প্রবাসী জীবন কাটায় এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের দৃষ্টিতে বান্দার প্রকৃত ভবিষ্যত জীবন কোনটি, যাকে সুখময় ও উজ্জ্বল করার জন্য সে সারা জীবন মেহনত-মোজাহাদা করবে? আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বারবার বিভিন্নভাবে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তার প্রকৃত জীবন হল আখেরাতের জীবন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত পরকালের আবাসই হল চিরন্তন (ও প্রকৃত আবাস।) যদি তারা জানত।’ (সূরা আনকাবূত : ৬৪)। অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, পার্থিব এ জীবনের নেয়ামতরাজি তো কেবল জীবন ধারণের সামান্য উপকরণমাত্র। বস্তুত পরকালই হচ্ছে স্থায়ী আবাস। (সূরা মুমিন : ৩৯)।
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনার জন্য ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম। (সূরা আদ-দ্বোহা : ৪)। এজন্য আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাকে বারবার তার প্রকৃত ভবিষ্যত, পরকালের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেকে ভেবে দেখুক, আগামী দিনের জন্য সে কী প্রেরণ করেছে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সম্যক অবগত। (সূরা হাশর : ১৮)।
তদ্রুপ রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্নভাবে তাঁর বাণী ও কর্মের দ্বারা মানুষকে ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে সচেতন করেছেন। এক হাদীসে রাসূলে কারীম সা. বলেছেন, হে আল্লাহ, আখেরাতের জীবনই একমাত্র জীবন। অতএব তুমি আমাদের ও মুহাজিরদের সংশোধন কর। (সহীহ বুখারী ২/৯৪৯)।
একবার হযরত উমর রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট এসে দেখলেন যে, তিনি খালি চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। ফলে তাঁর পার্শ্বদেশে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে হযরত উমর রা. কেঁদে ফেললেন। রাসূলে কারীম সা. বললেন, উমর কাঁদছ কেন? উমর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কিসরা ও কায়সার কত ভোগ-বিলাস ও আরাম আয়েশের মধ্যে ডুবে আছে। অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল! (দোজাহানের সরদার আপনার এই অবস্থা!) তখন নবী কারীম সা. বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া, আর আমাদের জন্য আখেরাত? (সহীহ বুখারী : ২/৭৩০) মুমিনের জন্য দুনিয়া ভোগ ও উপভোগের জীবন নয়। দুনিয়াতে সে একজন পথিক, যার গন্তব্য সামনে। রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন, দুনিয়াতে এমনভাবে থাক, যেন তুমি একজন পরদেশি আগন্তুক অথবা পথিক-মুসাফির। (সহীহ বুখারী : ২/৯৪৯)।
অতএব বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করে এবং চিরস্থায়ী জীবনের শান্তি ও সফলতার জন্য সচেষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ সা. কে এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ কে?’ উত্তরে নবীজী বললেন, যারা মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং মৃত্যুর জন্য অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, বস্তুত তারাই বুদ্ধিমান। তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সম্মানিত। (আলমু’জামুস সগীর তবারানী : ২/৮৭)।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মৃত্যুর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে যায় এবং দুনিয়ার সাধ ও অভিলাষ চরিতার্থ করার পিছনে পড়ে জীবনের মূল্যবান সময় শেষ করে দেয়, ভবিষ্যতের জন্য পাথেয় সংগ্রহের কোনো ফিকিরই করে না, উপরন্তু চিরস্থায়ী বঞ্চনা ও অসহনীয় কঠিন আযাবকে গ্রহণ করে, তার মতো নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী আর কে আছে? তাই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বিচক্ষণ ওই ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে। আর অক্ষম (নির্বোধ) ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে আর আল্লাহ তাআলার কাছে অমূলক আশা করে। (জামে তিরমিযী : ২/৭২)
সাহাবায়ে কেরামের জীবন যাপনে উপরোক্ত আদর্শের উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জনৈক বুযুর্গ বলেছেন, তুমি দুনিয়ার জন্য এই পরিমাণ শ্রম দাও যতদিন তুমি তাতে থাকবে। আর আখেরাতের জন্য ততটুকু শ্রম দাও যত সময় তোমাকে তাতে থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কুরআন-হাদীসের মর্মবাণী যথাযথ অনুধাবন করার এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে প্রকৃত জীবন তথা আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন