বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সকল সরকারই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়ার কথা দৃঢ়তার সাথে বার বার নিশ্চিত করেছেন, যদিও কথাগুলি একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। পর্যালোচনার বিষয় এই যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কি নিশ্চিত হয়েছে, না কি দিন দিন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে? বিচারপতি নিয়োগে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কি (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৫ মোতাবেক) নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সাথে সুপারিশ করতে পারছেন, না কি সরকারের সিদ্ধান্তই প্রধান বিচারপতির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের দাবি সরকার কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে বার বার, যদিও সরকার অইনমন্ত্রীর মাধ্যমে কমিটমেন্ট করেছে। এ সস্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, ‘উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নকার্যক্রম থেমে আছে। কিন্তু থেমে নেই নিয়োগ। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীসহ বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষাপটে প্রায় দুই বছর আগে আইনটির খসড়া প্রণয়নের কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল সরকার। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগকে প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়ে ২০১৭ সালের মে মাসের মধ্যে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করার টার্গেটও দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে খসড়াটি তৈরি করা হয়। বিচারক নিয়োগে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত থাকলেও গত দুই বছরের অধিক সময়ে এর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।’
প্রভাব বিহীন বিচার ব্যবস্থা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠির সদিচ্ছার উপরে। কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ যতই স্বাধীন হোক না কেন, সেখানে রাষ্ট্রের নির্বাহীকে কোনো না কোনো কারণে অযাচিত খুশি রাখা যেন একটি অলিখিত কনভেনশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্ব সভ্যতা অনেক এগিয়ে, যুগ যুগ ধরে অনুকরণ করার মত দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও না কোথাও এখনো রয়েছে। যেমন, তিউনিসিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ তার বিচারক স্ত্রীকে পাঁচ বছরের জন্য ছুটিতে যেতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তার স্ত্রী যত দিন ছুটিতে থাকবেন তত দিন তাকে কোনো বেতনভাতা দেওয়া হবে না। কায়েস সাঈদ জানিয়েছেন, তিনি পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ সময়টায় বিচার বিভাগে তার স্ত্রীর উপস্থিতির কারণে ওই বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠুক তিনি তা চান না। বিচার বিভাগ যাতে প্রভাবিত না হয় এ জন্য রাষ্ট্রের নির্বাহীকে উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষ বিভিন্ন কারণে প্রভাবিত হয়, আবার অবচেতন মনেও প্রভাবিত হতে পারে। এ বিষয়গুলি মাথায় রেখেই বিচার বিভাগকে প্রভাবমুক্ত রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিউনেসিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করতে চান না বলেই তার পক্ষে উক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়েছে।
বিচার বিভাগ সভ্যতার সোপান। বিশ্ব বিচার ব্যবস্থার দিকে যদি দৃষ্টি দেওয়া যায় তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগে কতটুকু স্বাধীন তা অনুমান করা যায়। এখানে আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, দাতব্য তহবিলের অর্থ নির্বাচনী প্রচারণায় খরচ করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেছে নিউ ইয়র্কের একটি আদালত। এতে বিচারক স্যালিয়ান স্কারপুলা জরিমানার এই অর্থ ট্রাম্পের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এমন আটটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্বার্থে তার নামের ওই দাতব্য সংস্থাটি ব্যবহৃত হতো বলে কৌসুলিদের অভিযোগ করার পর ২০১৮ সালে দ্য ডোনাল্ড জে ট্রাম্প ফাউন্ডেশনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। স্কারপুলা তার রায়ে ট্রাম্প এবং তার তিন সন্তান পরিচালিত এ দাতব্য প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন। ভেটেরানদের জন্য তোলা অর্থ ২০১৬ সালের আইওয়া প্রাইমারিতে খরচ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘জিম্মাদারের দায়িত্ব লঙ্ঘন’ করেছেন, বলে জানিয়েছেন এ বিচারক। ট্রাম্পকে জরিমানার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনটির বাকি তিন পরিচালক ডোনাল্ড জুনিয়র, এরিক ও ইভাংকাকে ‘দাতব্য সংস্থার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও পরিচালকদের’ কাছ থেকে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিতেও বলা হয়েছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ভিন্নতাও আছে। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইদি আমিনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার ৪ দিন পর ওই রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির লাস ড্রেনে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদায় ঘণ্টাও এর ব্যতিক্রম হয় নাই। তবে তিনি কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছেন। এ ধরনের ব্যতিক্রম নিয়েই বিচার বিভাগকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
আস্থা-অনাস্থার বোঝা এখন শুধু বিচার বিভাগের উপরে নয়, বরং প্রকারন্তরে এই বোঝার ভার বিচার প্রার্থীদেরও বইতে হচ্ছে। ফলে মানুষ এখন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে ঝুঁকছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ‘হবিগঞ্জে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পন্থা। বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। গত এক বছরে শুধু সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায়ই নিষ্পত্তি করা হয়েছে একশটি বিরোধ। এর মাধ্যমে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দাঙ্গা, খুন-খারাবি, মামলা-মোকদ্দমা কমেছে। মনিটরিং থাকার কারণে অল্পদিনেই তা এখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা কমছে। এখন ছোটখাট বিষয় নিয়ে আর মানুষ মামলা-মোকদ্দমায় জড়ায় না। সালিশের মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তি করা হয়।’
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র নিয়ে অনেক কথা থাকলেও তার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠে নাই। সেখানে এক নায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিচার বিভাগ। অথচ এ দৃষ্টান্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ দেখাবে এটাই সভ্যতা প্রত্যাশা করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়েও অনেক কথা আছে। কঠিন থেকে কঠিনতার আইন প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের হাতকে সংকুচিত করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সাংবাদিকদের লেখনী নিজেরাই সংকুচিত করে ফেলেছেন, এর পিছনের কারণও বলা যাবে না। বাংলাদেশের কিছু প্রধান সমস্যা, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও আশংকা করছেন, যেমন-ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন। তিন ফসলী জমিতে কোনো মিল কলকারখানা গড়ে তোলা বা আবাসন প্রকল্প সৃষ্টি না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ফলাওভাবে প্রচার করার পরও বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প করার জন্য ভূমিদস্যুরা কৃষকের জমি ভরাট করে পরিবেশকে হুমকির সম্মুখে ফেলে দিচ্ছে। প্রতি নিয়তই লোভী ব্যক্তিরা রাজনীতির ব্যানারে জনগণের রক্ত চুষে খাচ্ছে। এসব ঘটনায় সাংবাদিকতার কলম যেভাবে গর্জে উঠার কথা ছিল সে অনুপাতে গর্জে উঠছে না। এর পিছনেও বিস্তর ঘটনা ও সংবাদ ভাইরাল হচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রোধ করার জন্য কৌশলে সরকার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিভিন্ন জটিল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। ফলে দেশে যেমন এখন রাজনীতি নাই, সে রূপই গণমাধ্যমের জগতেও বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতায় ভাটা পড়েছে।
গত ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টসের (ডব্লিউজেপি) জরিপে দেখা গেছে, বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশ তালিকার নিচের দিকে অর্থাৎ অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে এ সত্যটি ক্ষমতাসীন দল স্বীকার করতে নারাজ। ডব্লিউজেপির অনুসন্ধানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২তম। সংস্থাটির জরিপে চলতি বছরে নতুন আরো ১৩টি দেশ যুক্ত হয়ে মোট ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম স্থানে এসেছে। সূচকের শীর্ষে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিন্যান্ড। সূচকের নিচে আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভেনিজুয়েলা। ডব্লিউজেপি সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে সূচক তৈরি করেছে। কিন্তু এই অপরিহার্য উপাদানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের কোনো সরকারই মনোযোগ দেননি। মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। অথচ সরকারের আইনমন্ত্রী ডব্লিউজেপির জরিপকে পক্ষপাতমূলক হিসেবে অভিহিত করেছে। যে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই, সে দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাধ্য কার? যারাই ক্ষমতায় থাকে তারা দেশি বা বিদেশি কোনো সংস্থার সূচকে ইতিবাচক কথা থাকলে লুফে নেয়। এমনকি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে। কিন্তু সূচকে নেতিবাচক কথা থাকলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। সত্যকে গ্রহণ করতে যেমন হৃদয় কাঁপে তেমনি মিথ্যার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দেউলিয়াত্ব।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন