শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেন প্রয়োজন

মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

বিচার বিভাগের দায়িত্ব যদি ঠিকভাবে পালন করতে হয়, তাহলে ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। সাক্ষ্য হচ্ছে আদালত কর্তৃক কোন বিচার কার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর রেকর্ড বা দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সর্ম্পকে আদালতের মনে বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়াসে আইন সঙ্গতভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের কোন নমুনা। প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই অপরাধীকে সাজা দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু নিরাপত্তা বা অন্যান্য কারণে বিপুল সংখ্যক মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে বলে জানা যায়। সাক্ষী অনুপস্থিত থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোসহ জীবননাশের হুমকির কথাও শোনা যায়। এমনকি সাক্ষীর জীবননাশের ঘটনারও নজির আছে। আসামি পক্ষের হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদানসহ নানা কারণে সাক্ষীরা হাজির হয় না। এছাড়া কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় যথাসময়ে সমন না পৌঁছায় হাজির হতে পারে না অনেক অফিসিয়াল সাক্ষী। আবার সমন পেয়েও সাক্ষ্য দিতে অনীহা বোধ করে কেউ কেউ। সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না, পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও। এমনকি মামলার আসামিরা খালাসও পেয়ে যায়। সাক্ষীর যথাযথ নিরাপত্তা ও সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হচ্ছে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

বারবার সমন দিয়েও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ মামলার বিচার। ফৌজদারী কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮ ও দন্ডবিধি, ১৮৬০ সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১৫১ ও ১৫২ ধারায় কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়। দেশে প্রচলিত অন্যান্য সকল আইনের ন্যায় সাক্ষ্য আইন একটি সংবিধিবদ্ধ দলিল। এর উপর ভিত্তি করে বিচারকার্য পরিচালিত হয়। বিচারককে সুনিশ্চিত করার জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিচার কার্যের উদ্দেশ্য হল, সত্য প্রতিষ্ঠা করা। সত্য অন্বেষনের স্বার্থেই সাক্ষ্য আইনের প্রয়োজন। দেশে প্রচলিত দেওয়ানি, ফৌজদারি আইন এবং সংবিধানের সঠিক ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে সাক্ষ্য আইনকে কার্যকর করা হয়। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে, প্রত্যেক মামলায় বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর বিচারক বিচার্য বিষয় স্থির করেন। স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট মামলার পক্ষগণ তাদের ইচ্ছামত কোন সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে না। সাক্ষ্যদানকালে তাদের সাক্ষ্য আইনের বিধিবদ্ধ বিধান মেনে চলতে হয়। বস্তুতপক্ষে সাক্ষীর উদেশ্য হলো আইনানুগ সাক্ষ্য প্রদান গ্রহণ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে পক্ষগণের দায়দায়িত্ব, দেনা বা অধিকারসমূহের নিশ্চিয়তা দান করে। মামলা নিষ্পত্তি তথা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাক্ষ্যের ভূমিকা সবিশেষে উল্লেখযোগ্য। কারণ, মামলা নিষ্পত্তির মূল ভিত্তি হলো সাক্ষ্য।

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে দোষী ব্যক্তিদের বিচারকালীন নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের কথা বলা আছে। এখানেও সংক্ষুব্ধ বা সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ২০১১ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। প্রস্তাবটি বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে তৈরি করা হয়। জাতিসংঘের ১৯৮৫ সালের সনদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন (UN declaration of basic principles of justice for victims of crime and abuse of power)। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩ আইনসমূহে ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। সরকার ২০১১ সালে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ শিরোনামে আইনটি তৈরির উদ্যোগ নেয় এবং জাতীয় আইন কমিশন এ সংক্রান্ত আইন তৈরির খসড়া পাঠায়। ২০০৬ সালে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হয় এবং ২০১১ সালে উক্ত আইন প্রয়োগে বিস্তারিত সপারিশ হিসাবে ১৯ দফা সুপারিশ করলেও অদ্যবধি তা আলোর মুখ দেখেনি। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমানো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সাক্ষীর সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে মামলার অভিযোগ প্রমাণ কষ্টসাধ্য হবে। একই কারণে ভবিষ্যতে কোনো সাক্ষী মামলার সাক্ষ্য দিতে আসবে না। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীকে ব্যক্তিগত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সাক্ষীদের থানায় না ডেকে ঘটনাস্থলে ও তাদের কর্মস্থল বা বাসস্থানে বা আইনজীবীর চেম্বারে সাক্ষ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নাগরিক স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি মামলায় কাউকে সাক্ষী করার পূর্বে অবশ্যই সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে কিনা মতামত নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাক্ষীর সুরক্ষায় উন্নত আইন রয়েছে। কোন মামলায় সাক্ষী কেন আসেনি, জানা দরকার। সাক্ষীরা একটি মামলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যাতে তারা নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন