ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা অনেক আদিম ও পুরনো। সমাজব্যবস্থাপনায় গোত্রের প্রধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের প্রধান বা শাসনকর্তার দিকনির্দেশনায় বিচারকার্য পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে বিচার বিভাগ সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে। বিচারকার্য পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের প্রধান। তিনিই আইন প্রণয়ন করেন, বিচারকার্য পরিচালনার ব্যয়ভারসহ বিচারপতিদের নিয়োগ, প্রমোশন, বেতনভাতা এবং স্থাপনা নির্মাণ সবই তার নিয়ন্ত্রণে।
বিচার বিভাগ কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডসহ যেকোনো সাজা দিলে সেই সাজা রাষ্ট্রপ্রধান বিনাশর্তে মওকুফ করে দিতে পারেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোনো দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যেকোনো দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ [তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশ কার্যকর হবে। কারণ বাস্তবে সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা] এ ছাড়াও দেশের প্রচলিত আইন ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক, আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তিকে কারামুক্ত করে শর্তসাপেক্ষে বা শর্তবিহীন সরকার মুক্তি দিতে পারে। The Probation of offenders ordinance, 1960 এবং The Probation of offenders Rules, 1975 মোতাবেক আদালতের আদেশ ব্যতিরেকে সরকার যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে অনুরূপভাবে কারামুক্ত করতে পারে।
গালভরা বুলি আউড়িয়ে বলা হয় যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু বিচার বিভাগ ততটা স্বাধীন নয় যতটুকু কাগজে-কলমে প্রকাশ করা হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রনায়কের প্রভাব প্রতিপত্তি তো রয়েছেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ পিরোজপুরের সাবেক এমপি আ. আউয়ালের সস্ত্রীক জামিন এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিদায়লগ্ন স্মরণ করলেই বিস্তারিত বিষয় সার্বিকভাবে উপলব্ধি করা যাবে। অন্যদিকে বিচার বিভাগ বা কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা ততটুকু ভোগ করে যতটুকু সে তার মেরুদন্ডকে দৃঢ় রাখতে পারে। তবে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে বিচারকদের বিচারিক স্বাধীনতা একরকম নয়। গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার জন্য পাকিস্তানের বিচার বিভাগ যে ভূমিকা রেখেছে, উপমহাদেশের অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সে ভূমিকা রাখতে পারেনি।
প্রসঙ্গটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মান, পরিমাণ, নিরূপণ করা নয়, বরং যুগ যুগ ধরে বিচারকার্যের সেন্টিমেন্ট বা গতিধারা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তা নিয়ে ইতিহাসের আলোকে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে বর্তমান চলমান প্রেক্ষাপট নিরূপণ করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইতালিয়ান স্কলার বিকুরিয়া এবং বেনথহ্যাম ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কারের ওপর আলোকপাত করে বিচারকার্যে অভিযুক্তের (আসামি) বিচারিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে মানবিক হওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেন। ১৯২০ সালে আমেরিকান সোসিওলজিস্ট মিউরিস পারমুলি সর্বপ্রথম ‘ক্রিমিওনোলজি’ শিরোনামে একটি বই লিখে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর আলোকপাত করেন। সাধারণত বিচার বিভাগ সমাজের স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট থাকে, লিবারেল ক্রিমিওলজিস্ট অপরাধীদের স্বার্থরক্ষার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করছে, অন্য দিকে র্যাডিকেল ক্রিমিওলজিস্টদের দাবি, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি ভিকটিমকে (ক্ষতিগ্রস্ত) ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান বিচারব্যবস্থায় অবশ্যই থাকতে হবে। আধুনিক ভিকটিমিওলজিস্টদের মতে, কোনো ঘটনায় একজন মানুষ মানসিক, শারীরিক, বৈষয়িক ও সমাজিকভাবে ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তারা এটাও মনে করেন, কোনো ঘটনায় একজন ব্যক্তি ভিকটিম হওয়ার পাশাপাশি একই ঘটনায় একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সংগঠন, সমাজ, এমনকি একটি জাতি সম্পূর্ণভাবে ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত ৮ জুলাই বিকেল ৫টায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় রূপগঞ্জস্থ হাশেম ফুড অ্যান্ড ব্যাভারেজ লিমিটেডের কারখানায় (সেজান জুস) অগ্নিকান্ডে সরকারি ভাষ্য মতে, ৫২ জনের মৃত্যুতে কারখানা ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের উদাসীনতার তথ্যমূলক সংবাদ বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয় রানা প্লাজার এত বড় অমানবিক ঘটনার পরও কারো হুঁশ হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর শোক জানানোর পাশাপাশি কিছু অনুদান তো ভিকটিমদের মন ও পেট ভরে না। অথচ, একই কারণে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে তো ঘটছেই। সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) তথ্য মতে, ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে শুধু পোশাক শিল্পে ৪৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগুন, কারখানার কাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ ইত্যাদি লোমহর্ষক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা যায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভাষ্য মতে, রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানা নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, জরুরি বহিরাগমন সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কারখানার কোনো ফ্লোরে ছিল না। এসব বিষয় মনিটরিং করার জন্য জনগণের বেতনভুক্ত ‘কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর’ নামে একটি দায়িত্বশীল অ্যাজেন্সি রয়েছে, যাদের দায়িত্ব শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে সর্বাবস্থায় কারখানাগুলো যথানিয়মে চলছে কি না তা পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করা। কিন্তু তারা প্রত্যেক কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন না করে সবই ঠিকঠাক মতো চলছে বলে মন্তব্য করে, বিনিময়ে এক পেট ভালো-মন্দ খেয়ে পকেটভারী করে চলে আসে। এ অবস্থা শুধু কারখানা পরিদর্শক অধিদফতরের নয়, বরং সরকারের প্রতিটি দফতরে। স্থানীয় প্রশাসন চাঁদাবাজিতে কম যায় না। মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আটজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যামামলা রুজু করে বলেছে যে, যাদের দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে তাদেরও বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সরকার ও প্রশাসনের কান গরম হয়। গালভরা বুলি নিয়ে প্রতিটি ঘটনায়ই বলা হয় ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’। মন্ত্রীদের এটি একটি কমন বক্তব্য। তদন্ত কমিটি করা হয়, কিন্তু প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না, জনগণ কোনো কিছুই জানতে পারে না। সরকার সামান্য ক্ষতিপূরণ দেয়। এ ক্ষেত্রে ভিকটিম নির্ধারণ করাও একটি পর্যালোচনার বিষয়। রূপগঞ্জের এ ঘটনায় নিহতের পরিবার প্রতি আড়াই লাখ ও আহতদের জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, যা জনদাবি অনুযায়ী পরিমাণে অনেক স্বল্প।
আগেই বলেছি যে, আধুনিক ভিকটিমিওলজিস্টরা মনে করেন, যেকোনো ঘটনায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্র ও জাতি ভিকটিম হতে পারে। আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনায় গোটা জাতি ভিকটিম, এই ভিকটিমের (জাতির) ক্ষতিপূরণ কে করবে? গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন তল্লা মসজিদে এশার নামাজের সময় তিতাস গ্যাস লিকেজ থেকে গ্যাসের সাথে বিদ্যুৎ স্পার্ক হয়ে ৩৭ জন নামাজি অগ্নিদগ্ধ হলে তার মধ্যে ৩৪ জন শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট হসপিটালে মৃত্যুবরণ করে। নিহতের জনপ্রতি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের তৎকালীন সদস্য ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম খন্দকার ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ‘জনগুরুত্বপূর্ণ’ (Public Interest Litigation)-এর আওতায় রিট পিটিশন নং ৫৪৩৩ দায়ের করেন। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো: খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন ব্যাঞ্চ শুনানি শেষে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ দিয়ে প্রত্যেক অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিকে ৫০ লাখ টাকা করে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়া হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর জন্য তিতাস কোম্পানি, রাজউক ও সরকার এবং রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতি রুল জারি করেন। তিতাস গ্যাস কোম্পানি ও সরকার ওই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ স্থগিত চেয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ অ্যাপিলেট ডিভিশনে লিভ-টু-আপিল নং-১২৯০ এবং ১২৯১ দায়ের করলে অ্যাপিলেট ডিভিশন অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ স্থগিত করে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠালে ১ ডিসেম্বর ২০২০ পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি করে জরুরি ভিত্তিতে রুল শুনানির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে পাঠান। তবে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্র্বতীকালীন ক্ষতিপূরণ আদেশ স্থগিত রাখা হয়। রুলটি কার্যতালিকায় থাকলেও এখনো শুনানি হয়নি। জনগুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের অনেক ক্ষতিপূরণ রিট শুনানির জন্য ঝুলে আছে।
আধুনিক বিচারব্যবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভিকটিম ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে ১৯৬৩ সালে, গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৬৪ সালে, অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৬৭ সালে ভিকটিম ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু হয়। ইংল্যান্ডে ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণের জন্য কমপ্যানসেশন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে স্পেশাল কমপ্যানসেশন ট্রাইব্যুনাল।
ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া অনেকগুলো রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে দায়েরকৃত আপিলগুলো শুনানির অপেক্ষায় আছে, যা জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হওয়া আবশ্যক। নতুন ভিকটিমরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। কারখানা ও মিলমালিকরা যুক্তি প্রদর্শন করে থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা। কারখানায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের জন্য আইন রয়েছে, যা শত বছরের পুরনো এবং পরিমাণে নামেমাত্র। সম্প্রতি দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা নয়, বরং এগুলো অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড বলে আমি মনে করি। পর্যালোচনাপূর্বক জরুরি ভিত্তিতে এ মর্মে অ্যাপিলেট ডিভিশনের একটি সিদ্ধান্ত এখন সময়ের দাবি।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন