বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

সে আছে

বিজয়ের গল্প

অয়েজুল হক | প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৮:৪৩ পিএম

একমাত্র মেয়ে তাসবিহা বাবাকে গোমড়া মুখে শুয়ে থাকতে দেখে বলে, তুমি শাহেদের সাথে গল্প করতে পার না? আমাকে শুধু জ্বালায়। তোমার কাছ থেকে গল্প শুনতে চায়। কথা শেষ করেই তাসবিহা বাবার পাশে এসে বসে।’ তোমার কী মন খারাপ বাবা?’

এনায়েত হোসেনের মন খারাপ নয়। তবে ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারী, র্মাচ মাস গুলোতে কিছু স্মৃতি অবচেতন মনে শ্রুভ্র স্বপ্ন হয়ে দোলা দেয়।
-না, মন ভালো আছে।খারাপ তো নেই।
-তোমার মুখ কেমন মলিন?
-হু।
-মায়ের সাথে কথা বলছ?
-তুই বিশ্বাস করিস?
-বাবা.... সকালের কুয়াশা ভেদ করে দূর আকাশে উড়ে যায় একটা দীর্ঘশ্বাস।
- কোনদিন কী বলেছি তুমি মিথ্যা বলছ?
- না, বলিস নি।তারপরও মনেহয়।
- বাদ দাও, শাহেদকে গল্প শোনাও।কাঁদছে।
এনায়েত হোসেন শাহেদকে বুকে টেনে গল্প শুরু করেন। শাহেদ ছয় বছরের ছোট্ট ছেলে নানার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলক।
-তোর মা তখন তোর চেয়ে একটু বড়। এখন মা কে দেখে বুঝতে পারবি না তোর মা তাসবিহা ঠিক কতো সুন্দর ছিল। আর তোর নানুকে তো দেখিস নি। দেখবি কিভাবে! তখন ১৯৭১ সাল। ২৯ মার্চ আমাদের গ্রামে ঢুকলো মিলিটারি।
- মিলিটারি কী নানা?
- কেন বইতে পড়িস নি-পাক হায়েনা।
- হু। ওরা তো খুব খারাপ।রক্ত খায়।
- হ্যাঁ। গ্রামে ঢুকেই রক্ত খাওয়া শুরু করল।ওদের দালাল গুলোর সাহায্যে একের পর এক, বেছে বেছে । যারা আজকের এই বাংলাদেশ টা চেয়েছিল তাদের হত্যা করা শুরু করল।
তোর মা তখন বড় আদরের।দিন-রাত আমার আর তোর নানুর কোলেপিঠে পড়ে থাকে।সারাদিন কতো আব্দার।তোর নানুর নাম বলত?
- গুলশানারা পারভিন।
- হু। গুলশানারা পারভিন। আমি আদর করে গুলশান বলে ডাকতাম।
জবাবে শাহেদ খুব খুশি বলে মনেহয়। খিলখিল করে হাসিতে মাতায়। যেন শাহেদের এই হাসির জন্য একটা যুদ্ধ। হাসি থামিয়ে বলে, তারপর?
- তোর নানু আমাকে বললো , যাও দেশের জন্য লড়াই কর। একটা লাল সবুজের বাংলাদেশ চাই আমার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে। প্রাণ ভরে হাসতে পারে। আমি আর আমাদের গ্রামের সাতজন তরুণ যুবক চলে গেলাম ট্রেনিং করতে। বিহারে আমাদের ট্রেনিং হলো। তিনমাস। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধে নামি। এই যে বিজয়ের মাস। আগামীকাল ১৬ ই ডিসেম্বর। বিজয় দিবস।
শাহেদ ঘাড় নাড়ে, হু।
এনায়েত হোসেন বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করেন, দিনে দিনে তুমুল যুদ্ধ। শেষমেশ আর পেরে উঠতে পারেনা। অস্ত্র ফেলে বলে, তোদের সাথে কে পারে! রক্ত সাগরে যারা ভাসতে জানে তাদের হারাবে এমন শক্তি, সাধ্য কার? আমরা জিতে গেলাম।
গল্পে গল্পে শাহেদ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পাননি।তাসবিহা আসে। শাহেদ কে গভীর ভাবে ঘুমাতে দেখে মুচকি হেসে বলে, ছেলেটা খুব কষ্ট দিচ্ছে আব্বু?
- কই, নাতো।
তাসবিহা যেন এনায়েত হোসেনের কথা শুনতে পায়না, কী করি বল! নানার কাছে ছাড়া ঘুমাবে না।
- ভালোবাসা রে... এনায়েত হোসেন কথা শেষ করতে পারেন না। তার চোখ দুটো ছলছল করে।
তাসবিহা প্রতিদিনের মতো মশারী টানিয়ে লাইট বন্ধ করে শাহেদ কে কোলে নিয়ে চলে যায়।বিছানায় শুয়ে শুয়ে এনায়েত হোসেন অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েন।মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। একটার পরে একটা আতশবাজির শব্দ। বিজয় উদযাপন। গুলশান কোথায় আছে কে জানে! কোন খুশিতে? সে তো প্রান ভরে চেয়েছিল - একটি বাংলাদেশ। বিছানা ছেড়ে খুব সঙ্গোপনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। আজ সারারাত হাটবেন। মাথার ভেতর গুলশান। হাটতে হাটতে সময় পেরিয়ে যায়। অনেক রাত। প্রায় আড়াইটার মতো। রাতের শহরে তখনো মানুষ। বিজয় দিবসের আনন্দ করছে। ৭১ এর ডিসেম্বরে যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন সেদিন এমন পিচঢালা মসৃণ রাস্তা ছিলনা। গভীর রাতে আলো ছিলনা। মানুষ ছিলনা। সদ্য স্বাধীন রক্তস্নাত একটি বাংলাদেশ। ঝোপের ভেতর; ডোবা নালা থেকে বেরিয়ে আসা মনুষ পচা লাশের গন্ধে ভারী বাতাস। শুধু একটি মিল - সেদিনও শীত জেঁকে বসেছিল। সব কিছুর পর একটা আনন্দ ছিল বিজয়ের। গোটা পূর্ব পাকিস্তান হায়েনার বিষাক্ত ছোবল মুক্ত; একটি বাংলাদেশ। আগামী প্রজন্ম বুকভরা খুশি নিয়ে এতটুকু অন্তত বলতে পারবে, আমরা স্বাধীন।
বাড়ি ফিরে শোনেন গুলশান নেই। গুলশান কই?
বাবা সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, তুই যাওয়ার পর পরই মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।
এনায়েত হোসেন চিতকার দেন। তার গোঙানির শব্দে আকাশ, বাতাস প্রকম্পিত হয়। ‘ কবে, কোথায়, কোন ক্যাম্পে?’
কবিরুল হোসেন ছেলেকে সান্তনা দেন, তোরা না জিতে গেছিস, কাদিস না। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাবাকে দেখে ছুটে এসে বুকের ভেতর মাথা গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে তাসবিহা। মা আনোয়ারা বেগম মমতা মাথা সুরে বলেন, অনেক রাত হয়েছে। কষ্ট করে এসেছিস। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়।
এনায়েত হোসেন নিজেকে প্রবোধ দেন, দেশের জন্য কিছু হারিয়ে হাহাকার করতে নেই। তিনি নিজেই তো নিষ্ঠুর, নির্মমতার জীবন্ত এক সাক্ষী। এক পাহাড় সাক্ষী। চোখের সামনে একসাথে যুদ্ধ করা অনেক বন্ধু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কতো মা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে সন্তান ফিরে আসার। আসবে না, ফিরবে না। মাটির জন্য, মাটিকে ভালোবেসে মাটিই হয়ে গেল!তবু অশ্রু ঝরে ভালোবাসার। মানুষ স্বাধীন দেশ পেয়েছে। খেতে ইচ্ছা করেনা। তাসবিহা কে নিয়ে শুয়ে পড়ে। ছোটদের মিষ্টি সুরের কথা যখন ভীষণ মনকাড়া, সেই বয়স তাসবিহার। পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বু তুমি এসেছ, আম্মু আবার কোথায় গেল?
এনায়েত হোসেন চমকে উঠেন! আবার গেল মানে কী? বলেন, তোমার মা.... সে তো কবেই চলে গেছে।
- রাতে আসলো যে। সবাই খুব রাগ করলো।
- কী বলিস?
- হু। অনেক সময় কাঁদলো।
- তারপর?
- আমাকে বুকে চেপে ধরে বলেন, তাসবিহা; চলে যাচ্ছি আম্মু। আর কোনদিন দেখা হবেনা। তোমার আব্বু যদি ফিরে আসে তোমাকে খুব আদর করবে।
এনায়েত হোসেন লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে কবিরুল হোসেনের রুমের সামনে হুড়মুড়িয়ে পড়েন, বাবা দরজা খোল। দরজা খোল বাবা।
চিতকার শুনে ঘুমভাঙা চোখে দরজা খুলে কবিরুল হোসেন বলেন , আবার কী হল?
- গুলশান এসেছিল?
- হু।
- কোথায় সে?
- বলে যায়নি। সবাই কটু কথা বলছিল।
- কেন!
- ওই যে কার না কার সন্তান পেটে নিয়ে আসল। কতো মাস তো ক্যাম্পে ছিল।
- সাধ করে গিয়েছিল?
- তোমার কথা আমি বুঝেছি এনায়েত, মানুষের মুখ কী তুমি বন্ধ করতে পারবে? যে সন্তান তার গর্ভে নিয়ে এসেছিল কী হবে তার পরিচয়!
এনায়েত হোসেন যেন মাটির নিচে গেড়ে যান। অশ্রু ভেজা চোখে শুধু বলেন, নির্দোষ একটা মেয়েকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারলে বাবা? স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা একজোড়া চোখের কবর দিলে এভাবে!
- তাড়িয়ে দেইনি তো। নিজেই চলে গেছে। লোকজনের কটুকথা শুনে চলে গেছে।
এনায়েত হোসেন ক্ষনিকের জন্য বোবা হয়ে যান। কোথায় তার গুলশান। সে রাতে, তারপর টানা কয়েকমাস গ্রাম, গঞ্জ ঘুরে ঘুরে গুলশান কে খুঁজে বেড়ান। না, নেই। কোথাও নেই গুলশান। হঠাত এক রাতে মাথায় আলতো স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই দেখে গুলশান। তার মাথার কাছে বসা। মুচকি হাসছে।
- গুলশান!
- হু।
- তুমি এসেছ?
- আমি তো তোমার সাথেই থাকি। দেখতে পাওনা?
- এখন পাচ্ছি। তুমি....
- ওরা বলে আমি চরিত্রহীন। তোমারও কী তাই ধারণা?
- ছিঃ গুলশান। এমন কথা মুখে আনবে না। তুমি আমার প্রেরণা, দেশের গৌরব।
গুলশানের সাথে প্রথম দেখার পরেই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। শহরে আসার পরও গুলশান এসেছে। মাঝে মাঝে আসে। কোথায় গুলশান? গুলশান। হঠাত মুখ ফসকে একটু জোরেই শব্দটা বের হয়। শব্দ না ব্যাথা। বুকচেরা আর্তনাদ! আচমকা থমকে দাঁড়ায়। শেষ রাতের সাদাটে কুয়াশায় অপার্থিব বিষণ্ণতা! একটু দূরে দাঁড়িয়ে চাদর আবৃত আবছা একটা মুখ। মুখে মুচকি হাসি। এনায়েত হোসেন বিড়বিড় করে বলেন, হারিয়ে যায়নি, সে আছে। নাকি দিনের পর দিন অসমাপ্ত এক রূপকথা সাজাচ্ছে প্রকৃতি!

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন