মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কেবল মেধাবী শিক্ষকরাই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে

গোলাম রহমান চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

মনীষীরা বলেন, যে জাতি শিক্ষা দীক্ষায় যত উন্নত সে জাতি ততটাই এগিয়ে। এ শিক্ষার মূল ভিত্তিই হলো প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার একথা অনস্বীকার্য। বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে চালু হয়েছে মিড ডে মিল। এ শিশুদের দক্ষ মানুষ হিসাবে দক্ষ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে চাই দক্ষ শিক্ষক। একমাত্র মেধাবীরাই পারে এই কোমলমতি শিশুদের দক্ষ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখাতে। প্রাথমিক শিক্ষা মজবুত না হলে মাধ্যমিক, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা সফল হবে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন মেধাবী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক। শিক্ষকের যথাযথ বেতন ও মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল এসব মেধাবী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব। তা হলেই সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হবে। সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করণে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই বাধ্যবাধকতা মানতেও প্রাথমিক শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।

বলা হয়ে থাকে, যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি সে দেশ তত উন্নত। প্রাথমিক স্তরের প্রতিটি শিশুই দেশের সম্পদ। এ সকল শিশুকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় ও উন্নত হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের আধুনিক পদ্ধতি, কৌশল ও আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে আরো কার্যকর করা দরকার। প্রতিটি শিশুকে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো প্রায়োজন। প্রয়োজন ধর্মীয়, নৈতিক ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক, বাব-মা, অভিভাবক, শিক্ষা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিগণের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান যুগে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল, জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্য স্থির করেছে মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া সেটি অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি নীতি পর্যালোচনাপত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম, দুই তৃতীয়াংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের চেয়ে কম; দুই তৃতীয়াংশের প্রাথমিকের চেয়ে কম। প্রাথমিক পাশ শ্রমশক্তির মাত্র এক তৃতীয়াংশের গণনা ও সাক্ষরতায় প্রত্যাশিত জ্ঞান রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান শিক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিশুর সার্বিক কল্যাণ তরান্বিত হয়। গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় আর্থসামাজিক অবস্থা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন এবং আদর্শ অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন কিনা তা ভেবে দেখা জরুরি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল তো বটেই, এমনকি দুই আড়াই দশক আগের তুলনায় এ বৈচিত্র্য এখন অনেক বেশি। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশের অভিভাবকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আরেকটি অংশের বাবা-মায়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেছেন। বাকি একটি অংশ আসছে এমন পরিবার থেকে যাদের বাবা-মা প্রাথমিক পরবর্তী শিক্ষায় শিক্ষিত ।

বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে আসা ছাত্রছাত্রী যাতে শ্রেণিকক্ষে একটি সমধারা/ অভিন্ন ধারার পরিবেশে জ্ঞানার্জন করতে পারে তা শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হয়। শিক্ষক যাতে সেই ভুমিকা পালন করতে পারেন সেজন্য তাঁর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি যে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন তা সহায়ক শিক্ষকের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষাদানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সরকারের প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিক্ষক প্রশিক্ষণে ভূমিকা পালন করছে সত্য, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও উদ্ভাবন চলছে তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমাদের শিক্ষকদের কতটুকু? আমাদের দেশে চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, গবেষণা ইত্যাদি পেশায় জড়িতদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য তা তৈরি হয়েছে কি? আবার পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গী জড়িত যার সুযোগ শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এ পেশায় আসতে আগ্রহ বোধ করছে না। কাজের স্বীকৃতি যে কোন পেশার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ব্যক্তির পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে তা অনুপ্রেরণা যোগায়। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বছরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্কীকৃতির বিদ্যমান সরকারি ব্যবস্থাটিকে এজন্য আরও উদ্ভাবনমূলক ও প্রসারিত করা প্রয়োজন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ অনেকখানি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রাইভেট টিউশনির দাপট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার ঝোঁক, শিক্ষকের পদশূন্যতা, শিক্ষকমন্ডলীরও আন্তরিকতার অভাব ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষিকার শিক্ষণ পরিবেশের অভাব এবং এ কারণে গুণমানের অভাব থাকলে শিক্ষিত হবার ক্ষেত্রটি থেকে যায় সঙ্কুচিত। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, তবে শিক্ষকবৃন্দ সে মেরুদন্ডের ¯্রষ্ট্রা। গোটা মানুষ্য সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত ও শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটিও নেই। শিক্ষকরা সমাজের প্রাণ। দেশ-জাতি-সমাজ-রাষ্ট্রের দুঃসময়ে সবার চেতনার উম্মেষ ঘটিয়ে জাতিমুক্তির কান্ডারি হিসেবে শিক্ষক সমাজ গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। তাই পৃথিবীর যত সম্মান জনক পেশা আছে, তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা।

মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ শ্রেণীর, তারা সার্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কোন না কোন শিক্ষকের কাছে ঋণী। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, পাসের আধিক্য থাকলেও গুণগত মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা সব শিক্ষা দান নিশ্চিত করা জরুরি। মানসম্মত শিক্ষার মূল উপাদান হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষার উপকরণ ও মানসম্মত পরিবেশ। শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দই শিক্ষার্থীদের রোল মডেল। তাই শিক্ষকদের আউট ফিট হওয়া উচিত সেরকমই। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে সেদিকে শিক্ষকদের নজর দেয়া সম্ভব হয় না। সরকার ইতোমধ্যে কিছুটা পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। শিক্ষকরা জাতি গঠনে ভূমিকা রাখেন। আর এ কারণে এ পেশায় আরও মেধাবীদের আসা উচিত। কিন্তু মেধাবীরা তো সচ্ছল জীবন যাপন করতে চায়। পেশায় এসে যদি সেটা না পায়, তাহলে আসবে কেন? শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরী। যোগ্যতা ও অবদান অনুযায়ী শিক্ষকদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তা না হলে যতই বেতন বৃদ্ধি বা কারিকুলাম বদল করা হোক, কোন লাভ হবে না। প্রতিবছর বই বদল হচ্ছে, ভুল বই বের হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার লক্ষ্যটা প্রশ্নের সন্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। কিন্তু প্রশিক্ষণের নামে উপহাস্য প্রশিক্ষণই হচ্ছে; তাতে যোগ্য শিক্ষক তৈরি হয় না। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যোগ্য শিক্ষক দরকার। সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যৎ বিশ্বে ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির একটি বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের শঙ্কা শুধুমাত্র শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে অনেক প্রতিশ্রæতির সেই ভবিষ্যৎ মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাই আমাদের উদ্যোগী হতে হবে এবং তা এখনই।
লেখক: শিক্ষা অফিসার, মীরসরাই, চট্টগ্রাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Alamgir Hossain, Lecturer , manikpir fazil madrash, boda,Panchagarh ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৫:০১ পিএম says : 0
khub valo laglo Sir,but nari quota+ others quota primary sector k crash krtese.. So remove quota
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন