গ্যাং কালচারে কাবু কুমিল্লা। তথাকথিত ‘বড় ভাইদের’ ছত্রছায়ায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে স্কুল না পেরুনো কিশোরদের একটি অংশ। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে। আধিপত্য নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটছে।
রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার সুবাদে তথাকথিত বড় ভাইদের আনুক‚ল্যও পাচ্ছে এরা। ঈগল স্টার, আরজিএসসহ অন্তত ১০টি গ্যাং দাবড়ে বেড়াচ্ছে কুমিল্লা। শুরুতে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়ানো, রাস্তার ধারে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ও স্থানীয় ছোটখাটো সমস্যায় যুক্ত করার মধ্যেই তাদের কর্মকান্ড সীমিত ছিল।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, প্রকাশ্যে ধূমপান, গাঁজা সেবনসহ খুনখারাবির মতো ঘটনায়। সঙ্ঘাত-হানাহানিও রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে স্কুলছাত্র আহত হয়েছে নগরীর কুমিল্লা সিটি পার্কে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে ছুরিকাঘাতে আহত ছাত্রের নাম মো. মারুফ। সে কুমিল্লা পাঁচথুবী ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের মজিবুর ইসলামের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল থেকে পার্কের পূর্বে দিকে বেশ কয়েকজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল, হঠাৎই এরা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে জড়িয়ে যায়। মারুফের পায়ে ও পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করে তার বন্ধুরা। মারুফের পা থেকে রক্ত ঝরে পার্কের রাস্তায় পরে থাকতে দেখা যায়। পরে স্থানীয় কয়েকজন মিলে মারুফকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় নগরজুড়ে আবারো আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে গেল বছর দু’জন ছাত্রের নির্মম হত্যার পর পুলিশ ও জেলা প্রশাসন কঠোর হয়েছিল
কথিত ‘বড় ভাইদের’ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর। ঠুনকো ঘটনা ঘিরেও জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, স্কুল-কলেজের সামনে আড্ডা, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদক সেবন, এক স্টাইলে চুল কাটাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতে গড়ে তুলছে ‘কিশোর গ্যাং’। দিন দিন তারা হয়ে উঠছে ভয়াবহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে এসব গ্রুপ গড়ে উঠছে হরদম। ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধ দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তারা ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হানাহানি, মাদক সেবন ও মাদক কেনাবেচাসহ কুপিয়ে জখমসহ খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে। কিশোরদের এ ভয়ঙ্কর রূপ ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশকে।
কুমিল্লা জেলায় র্যাক্স, এক্স সিএসএইচএস, এলআর এন, মডার্ণ স্কুল ওয়ান, মডার্ণ স্কুল টু ও ঈগলসহ অন্তত ১০টি গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর ঘোষণা দিয়ে থাকে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের উপর হামলা চালায়। কিশোর গ্যাং গ্রুপের দৌরাত্ম্যে একদিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্থির, অন্যদিকে এলাকাবাসীও আতঙ্কিত।
আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে গত ২১ এপ্রিল মোন্তাহিন ইসলাম মিরন (১৬) নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে এ বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে ১৫ এপ্রিল প্রেম সংক্রান্ত দ্ব›েদ্বর ঘটনা নিয়ে ছুড়িকাঘাতে কুমিল্লার জিলা স্কুলের ছাত্র মারুফ (১৫) কে হত্যা করে।
মনোবিদরা মনে করছেন, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের যত্মশীল না হওয়া এবং পড়াশোনার বাইরে ভিডিও গেমস, ফেসবুক ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটছে।
জানা গেছে, কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় নজরুল এভিনিউ রোডের কর ভবন, মডার্ণ হাই স্কুলের সামনে, আড়ং য়ের সামনে, ডায়বেটিক হাসাপাতালের সামনে এবং লিপি ডিজিটালের সামনে এসব গ্যাং গ্রুপের আড্ডা। স্কুল শুরুর সময় থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকাল থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত এই গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা আড্ডা মারে। প্রতি গ্রুপে ২০ থেকে ৩০ জন সদস্য রয়েছে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিশু এবং কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এ গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। এ জন্য অভিভাবকদের সচেতনতা এবং সহযোগিতা দরকার। এতদিন এ গ্রুপগুলোর সদস্যরা চুরি, ছিনতাই এবং মারামারিসহ ছোটখাটো অপরাধ তৎপরতায় জড়িত ছিল।
শুধু গ্রুপ বা গ্যাং নয়, এসবের বাইরেও যদি কেউ ফৌজদারি অপরাধ করে থাকে তাকেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গ্রুপগুলোকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। কোনো গ্রুপের সদস্যই যেন কোনো অপরাধ তৎপরতায় না জড়াতে পারে সে বিষয়ে পুলিশ তৎপর আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন